নিউজ ডেস্ক, প্রথম আলো
একটা সময় ছিল, যখন ‘রোবোটিক্স’ শব্দটি বাংলাদেশের সাধারণ পাঠকের কাছেই ছিল দূরের কোনো ধারণা। আর পানির নিচে কাজ করতে পারে এমন স্বয়ংক্রিয় যান—তা যেন ছিল কল্পবিজ্ঞান! কিন্তু আজ বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের একদল তরুণ গবেষক ও প্রকৌশলী বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা RoboSub 2025-এর সেমিফাইনালে সরাসরি জায়গা করে নিয়েছে।
এই সাফল্যের নাম ব্র্যাক ডুবুরি।
গল্পটা শুরু হয়েছিল স্বপ্ন দিয়ে
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একদল শিক্ষার্থী, যাদের প্রযুক্তিপ্রেম আর নতুন কিছু করার ইচ্ছা এক হয়ে জন্ম দিয়েছিল দেশের প্রথম Autonomous Underwater Robotics Research Team—”ডুবুরি”। এই দলটি শুধু একটি প্রোজেক্ট নয়, বরং একটি আন্দোলনের নাম, যেখানে প্রযুক্তিকে দেশের বাস্তব প্রয়োগে কাজে লাগানোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করা হয়।
২০২৩ সালে তারা বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিল। আর এবার, ২০২৫ সালের প্রতিযোগিতায় তারা সরাসরি সেমিফাইনালে পৌঁছে গেছে, বিশ্বের সেরা সেরা গবেষণা দল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিযোগিতা করার মতো সক্ষমতা নিয়ে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই অর্জন?
RoboSub প্রতিযোগিতা শুধু একটি রোবোটিক্স প্রদর্শনী নয়, এটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি গবেষণার মঞ্চ, যেখানে মাটির নিচে নয়, বরং সাগরের তলদেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে সক্ষম যানগুলো তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করে। যন্ত্রগুলোকে নানা জটিল মিশন, বাধা, সংকেত বিশ্লেষণ এবং স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
ব্র্যাক ডুবুরি সেই কঠিন পরীক্ষায় প্রথম ধাপেই আন্তর্জাতিক বিচারকেরা কাছে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
প্রযুক্তির সাথে দেশপ্রেমের সমন্বয়
টিম লিডার আবিদ মাহমুদ এক কথায় বলেছেন, “এটা শুধু আমাদের দলের আরেকটি সাফল্য নয়, এটা বাংলাদেশের মুহূর্ত।” এর পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী দৃষ্টিভঙ্গি—দেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা, প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের প্রয়োগযোগ্য সমাধান তৈরি করা।
এই লক্ষ্যেই কাজ করছে Dubotech Digital Ltd, বাংলাদেশের প্রথম পানির নিচে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা কোম্পানি, যারা ডুবুরি দলের সাথে যৌথভাবে গবেষণা ও ডেভেলপমেন্টের কাজ করছে। Dubotech-এর সিইও নাঈম হোসেন সাইকাত বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে পানির নিচে উদ্ভাবনের নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়া।”
এই সহযোগিতা শুধু প্রোজেক্ট নয়, বরং একটি ইকোসিস্টেম তৈরির সূচনা, যেখানে প্রযুক্তি, শিক্ষা ও উদ্যোক্তারা এক হয়ে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ছে।
আমাদের নদীমাতৃক দেশের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। আমাদের রয়েছে বিশাল জলভাগ, অথচ পানির নিচের প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনের উদ্যোগ একেবারেই সীমিত। অথচ, এ খাতে রয়েছে অপার সম্ভাবনা—মেরিটাইম সিকিউরিটি, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, নদী ও সমুদ্রপথের অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, এমনকি ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের মতো গুরুতর ক্ষেত্র।
ব্র্যাক ডুবুরি এই ঘাটতির জায়গাটিতে এক ঝলক আশার আলো।

তরুণদের জন্য আহ্বান
আজকের তরুণদের জন্য এই সাফল্য শুধু আনন্দ বা উচ্ছ্বাসের খবর নয়, এটি একটি আহ্বান—নিজেদের আগ্রহ, স্বপ্ন, এবং মেধাকে দেশের কাজে লাগানোর সুযোগ আছে, দরকার শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা আর অধ্যবসায়।
ডুবুরি দলের শিক্ষার্থীরা কোনো বিদেশি ল্যাব বা বিদেশি অর্থায়নের সুবিধা নিয়ে শুরু করেনি। তারা শুরু করেছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকে, যেখানে ছিল কাগজে আঁকা ডিজাইন, প্রোটোটাইপের ব্যর্থতা, রাত জেগে কোড লেখা, আর সীমিত বাজেটে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। কিন্তু তারা হাল ছাড়েনি।
তরুণদের বলতে চাই, “প্রযুক্তি শুধু উন্নত দেশগুলোর খেলা নয়। এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশও উদ্ভাবনের মানচিত্রে জায়গা করে নেবে।”
নীতিনির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ
বাংলাদেশে এখন স্টার্টআপ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে, কিন্তু গবেষণা ও উদ্ভাবনকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো কাঠামো এখনও সীমিত। BRACU ডুবুরি এবং Dubotech-এর এই সাফল্য দেখিয়ে দেয়, বাংলাদেশের মেধাবী তরুণরা যদি প্রয়োজনীয় সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন পায়, তাহলে তারা বিশ্বের যেকোনো প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
সরকারি ও বেসরকারি খাতে যৌথভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি “Technology Incubation Program” গড়ে তোলা দরকার, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, এবং বিনিয়োগকারীরা একত্রে কাজ করবে।
শেষ কথা
ব্র্যাক ডুবুরি শুধু একটি রোবট বানায়নি। তারা দেখিয়েছে কীভাবে স্বপ্ন, কষ্ট আর দৃষ্টিভঙ্গি একত্রে একটি দেশকে এগিয়ে নিতে পারে।
প্রিয় শিক্ষার্থীরা, এই পথ তোমাদের জন্যও খোলা। প্রশ্ন করো, তৈরি করো, ব্যর্থ হও, আবার দাঁড়াও—একদিন এই বাংলার মাটিতেই দাঁড়িয়ে বিশ্ব জয় করো।
তোমাদের অপেক্ষায় আছে হাজারো ডুবুরি, যারা সমুদ্র পেরিয়ে না, বরং তার গভীরে বাংলাদেশের পতাকা গাঁথতে চায়।
Leave a comment