রাহাতের দাদু, আমেনা খাতুন, ছোটবেলা থেকেই খুব কর্মঠ ছিলেন। প্রতিদিন সকালে হাঁটতে যেতেন, বাগানের পরিচর্যা করতেন, এমনকি নিজের হাতে রান্নাবান্নাও করতেন। কিন্তু ৬৫ বছর বয়স পেরোতেই তিনি বুঝতে পারলেন, তার হাড় দুর্বল হয়ে গেছে। একদিন বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেলেন, আর তার কোমরের হাড় ভেঙে গেল। চিকিৎসক জানালেন, তিনি অস্টিওপরোসিস নামক এক জটিল সমস্যায় ভুগছেন—যে রোগে হাড় এতটাই দুর্বল হয়ে যায় যে, সামান্য আঘাতেও তা ভেঙে যেতে পারে।
রাহাত ভাবতে লাগল, এমন কোনো সমাধান কি নেই যা দাদুর হাড় দ্রুত মজবুত করবে? সাধারণ ওষুধ বা ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট তো মাসের পর মাস লাগিয়ে দেয়!
বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কার
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এমন এক ইনজেক্টেবল হাইড্রোজেল তৈরি করেছেন যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হাড়কে শক্তিশালী করতে পারে। সুইজারল্যান্ডের ইপিএফএল (EPFL) গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং Flowbone স্টার্টআপের বিজ্ঞানীরা এই হাইড্রোজেলটি তৈরি করেছেন, যা হাড়ের প্রাকৃতিক খনিজ উপাদানের মতো আচরণ করে এবং দুর্বল অংশগুলোকে শক্তিশালী করে তোলে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই হাইড্রোজেলটি মূলত হায়ালুরোনিক অ্যাসিড (Hyaluronic Acid) এবং হাইড্রোক্সিএপাটাইট (Hydroxyapatite) ন্যানোপার্টিকল দিয়ে তৈরি। এটি হাড়ের গঠন নকল করতে পারে এবং সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে সংযুক্ত হতে পারে।
পরীক্ষাগারে চমকপ্রদ ফলাফল
গবেষকরা প্রথমে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালান। দেখা যায়, মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ইঁদুরদের হাড়ের ঘনত্ব তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর, যখন এই হাইড্রোজেলের সঙ্গে Zoledronate নামের একটি অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধী ওষুধ মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়, তখন হাড়ের ঘনত্ব পাঁচগুণ বৃদ্ধি পায়!
এটি একটি বিপ্লবী ঘটনা, কারণ সাধারণত অস্টিওপরোসিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলো কাজ করতে বছরের পর বছর লেগে যায়, অথচ নতুন এই পদ্ধতিতে মাত্র কয়েক সপ্তাহেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে।
কেন এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বজুড়ে ২০ কোটির বেশি মানুষ অস্টিওপরোসিসে আক্রান্ত, যার মধ্যে বেশিরভাগই মেনোপজ-পরবর্তী নারীরা। বাংলাদেশেও এই রোগ বেশ প্রচলিত, বিশেষত বয়স্ক নারী ও পুরুষদের মধ্যে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী—
- প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে ১ জন এবং ৫ জন পুরুষের মধ্যে ১ জন তাদের জীবদ্দশায় অস্টিওপরোসিসজনিত হাড় ভাঙার সমস্যায় পড়েন।
- বিশ্বব্যাপী প্রতি ৩ সেকেন্ডে ১ জন মানুষ অস্টিওপরোসিসজনিত কারণে হাড় ভাঙার শিকার হন।
- ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের চেয়েও বেশি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে হাড় ভাঙার জটিলতা।
এই পরিস্থিতিতে নতুন হাইড্রোজেল-ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রোগীদের জন্য এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।
স্থায়ী সমাধান নাকি শুধু সাময়িক প্রতিকার?
গবেষকরা বলছেন, এই হাইড্রোজেলটি স্থায়ী সমাধান নয়, তবে এটি বিদ্যমান চিকিৎসাকে সহায়তা করতে পারবে এবং সুস্থ হওয়ার সময়কাল কমিয়ে আনতে পারবে। এটি মূলত অস্থি পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে, ফলে রোগীরা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন।
বর্তমানে গবেষকরা নিয়ন্ত্রিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা বিভিন্ন দেশে এই চিকিৎসার অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছেন, যাতে এটি মানুষের ওপর প্রয়োগ করা যায়।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
এই হাইড্রোজেলের সফল প্রয়োগ হলে—
- অস্টিওপরোসিস আক্রান্ত রোগীদের পুনরুদ্ধার দ্রুত হবে।
- সার্জারি ছাড়াই চিকিৎসা সম্ভব হবে, যা অনেকের জন্যই সহজ ও সাশ্রয়ী সমাধান হতে পারে।
- বয়সজনিত হাড় দুর্বলতার চিকিৎসা আরও কার্যকর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রযুক্তি শুধুমাত্র অস্টিওপরোসিস রোগীদের জন্য নয়, বরং ক্রীড়াবিদ, দুর্ঘটনায় আহত রোগী এবং বয়স্কদের জন্যও কার্যকর হতে পারে।
শেষ কথা
রাহাতের দাদুর মতো অসংখ্য মানুষের জন্য এটি এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিনিয়ত নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে, আর এই হাইড্রোজেল হয়তো অস্টিওপরোসিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের নতুন অস্ত্র হয়ে উঠবে।
আপনি কি মনে করেন, এই ধরনের গবেষণা ভবিষ্যতে আমাদের জীবন বদলে দিতে পারবে? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না!
তথ্যসূত্র:
Sciencedirect – Hydrogel Strengthens Bones in Weeks
Leave a comment