পরিবেশ ও পৃথিবীরসায়নবিদ্যা

বায়োপ্লাস্টিকের গল্পঃ সবুজ সমাধান নাকি সবুজ প্রচারণা?

Share
Share

লাঞ্চ শেষ করে সবেমাত্র ল্যাপটপটি অন করে বসেছি—এমন সময় হাতের কাছে রাখা ফোনটি বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র অনুজ কল দিয়েছে। ফোন ধরতেই অনুজ বলল, সদ্য অনুষ্ঠিত একটি সেমিনার নিয়ে তার কিছু আলোচনা আছে; আমার সময় হবে কি না জানতে চাইল। হাতে তেমন কোনো জরুরি কাজ না থাকায় আমি আলোচনা করতে রাজি হয়ে গেলাম এবং তাকে অনলাইন মিটিং চালু করে সেখানে যোগ দিতে বললাম।

মিটিং শুরু হতেই অনুজ জানাল, সেমিনারের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল প্লাস্টিক সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধান। সে বলল, সেমিনার থেকে অনেক কিছু শিখেছে, তবে কিছু বিষয়ে তার মনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। 

আমি তাকে বললাম, “প্লাস্টিক এবং এর সমস্যার বিষয়ে তুই কী কী জানতে পেরেছিস—আগে সেটা আমাকে বল।” 

অনুজ বলতে শুরু করল—

“১৯০৭ সালে প্রথম সিন্থেটিক প্লাস্টিকের উদ্ভাবন করেন লিও বেকল্যান্ড, যার নামকরণ করা হয় বেকলাইট (Bakelite)। সেখান থেকেই আধুনিক প্লাস্টিকের অগ্রযাত্রা শুরু। হালকা ওজন, টেকসই বৈশিষ্ট্য এবং তুলনামূলক কম খরচের কারণে আধুনিক সময়ে প্লাস্টিক আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। সকালে দাঁত মাজার ব্রাশ থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, ইলেকট্রনিক্স, নির্মাণশিল্প, এমনকি বিমান পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতের ভিত্তি হিসেবে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে। 

২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন ৫০ কোটি টনেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে, যা ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের তুলনায় আট গুণেরও বেশি। পলিথিন, পলিপ্রোপিলিন ও পলিইথিলিন টেরেফথালেটের (PET) মতো বহুল ব্যবহৃত প্লাস্টিক এই তালিকায় রয়েছে। তবে প্রকৃত সমস্যা শুরু হয় ব্যবহারের পর উৎপন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্পত্তি (waste disposal) নিয়ে। যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (waste management) ছাড়া এই প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান ব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ধারা অপরিবর্তিত থাকলে, আগামী এক দশকের মধ্যেই ল্যান্ডফিল কিংবা প্রাকৃতিক পরিবেশে জমে থাকা মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ১১০০ কোটি টনে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শুধু বর্জ্য সমস্যাই নয়, প্রচলিত প্লাস্টিক উৎপাদন প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনবায়নযোগ্য জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক (non-renewable fossil fuel)। এসব প্লাস্টিক উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ শক্তি ব্যয় হয় এবং উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) নিঃসরণ ঘটে। এছাড়া প্লাস্টিক কয়েক দশক থেকে শতাব্দীকাল পর্যন্ত টিকে থাকে এবং মাটি, নদী ও মহাসাগরে জমা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা খাদ্যশৃঙ্খলে (food chain) প্রবেশ করে বাস্তুতন্ত্রে (ecosystem) বিঘ্ন ঘটাতে পারে এবং মানবস্বাস্থ্যের ওপরও সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। একসময় যে স্থায়িত্বকে (durability) প্রযুক্তিগত সাফল্য হিসেবে দেখা হতো, সেটিই এখন পরিবেশগত দায়ে (environmental burden) পরিণত হয়েছে। এই পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত সমস্যাগুলোই বিজ্ঞানী, শিল্পখাত ও নীতিনির্ধারকদের এমন বিকল্প অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করেছে, যা বস্তুগত উপযোগিতাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ক্ষতি থেকে আলাদা করতে পারে।”

অনুজের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম এবং বুঝতে পারলাম, সে সেমিনারে যথেষ্ট মনোযোগী ছিল। 

আমি বললাম, “একথা সত্য যে প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ, বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিক বর্জ্য। তবে এর বিকল্প হিসেবে বিজ্ঞানীরা কিছু সমাধান প্রস্তাব করেছেন। তোর কি সে বিষয়ে কোনো ধারণা আছে?” 

“জি ভাইয়া—বায়োপ্লাস্টিক।” সাথে সাথে জবাব দিল অনুজ

জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম, “তুই কি জানিস, বায়োপ্লাস্টিক কাকে বলে?” 

অনুজ বলল—

“বায়োপ্লাস্টিক (Bioplastics) মূলত এক ধরনের বায়োপলিমার। প্লাস্টিক বা পলিমারের সঙ্গে ‘Bio’ শব্দটি যুক্ত হয়, কারণ সংজ্ঞাগতভাবে বায়োপ্লাস্টিক জৈব উৎস (biological resources) থেকে তৈরি হতে পারে—যেমন ফসলভিত্তিক কাঁচামাল (agricultural feedstocks); অথবা জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যেমন ফার্মেন্টেশন বা গাঁজনের মাধ্যমে উৎপাদিত হতে পারে; কিংবা এটি প্রাকৃতিক পরিবেশে পঁচনশীল বা বায়োডিগ্রেডেবল হতে পারে। প্রচলিত প্লাস্টিকের তুলনায় অনেক বায়োপ্লাস্টিক নবায়নযোগ্য কাঁচামাল (renewable feedstocks) থেকে তৈরি হওয়ায় সীমিত জীবাশ্ম সম্পদের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে। পাশাপাশি, সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে যদি প্রকৃত অর্থে বিয়োজন ঘটে, তবে বায়োডিগ্রেডেশনের মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য জমার ক্রমবর্ধমান সমস্যার একটি সম্ভাব্য সমাধান পাওয়া যেতে পারে।”

কথা শেষ করে অনুজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। 

আমি বললাম, “ভালোই তো পড়াশোনা করেছিস, তাহলে থামলি কেন?”

একটু ইতস্তত করে অনুজ বললো, “এখানে তো আমার খটকা লাগছে ভাইয়া। সেমিনারে একজন আলোচক বললেন, বায়োপ্লাস্টিকেরও নাকি পরিবেশের জন্য কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না—যে জিনিস নবায়নযোগ্য উৎস থেকে তৈরি এবং পঁচনশীল, সেটি আবার পরিবেশের জন্য হুমকি হয় কীভাবে?”

“এই বিষয়টি নিয়েই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হচ্ছে। বায়োপ্লাস্টিকের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরো জীবনচক্র বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশের ওপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় লাইফ সাইকেল অ্যাসেসমেন্ট (Life cycle assessment) বা সংক্ষেপে LCA।”

অনুজের মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝলাম, বিষয়টি তার কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আমি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা শুরু করলাম—

“বায়োপ্লাস্টিককে প্রায়ই প্লাস্টিক সংকটের সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তারিত পরিবেশগত মূল্যায়নের ফলে এই আশাবাদ কিছুটা সংযত হয়েছে। LCA গবেষণা দেখাচ্ছে, যথাযথ নকশা ও অপ্টিমাইজেশন ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বায়োপ্লাস্টিকের পরিবেশগত প্রভাব প্রচলিত প্লাস্টিকের সমান, এমনকি কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি হতে পারে। যেহেতু বায়োপ্লাস্টিক উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য (agricultural feedstock), তাই ভূমি ব্যবহার (adverse land use), পানির চাহিদা (water consumption), সার ও রাসায়নিক প্রয়োগজনিত সমস্যা—যেমন ইউট্রোফিকেশন (eutrophication) ও অম্লায়ন (acidification)—এবং বিভিন্ন ধাপে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। এতে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়—কেবল কোনো উপাদানের উৎস জৈব হলেই তাকে টেকসই (sustainable/green) বলা যায় না। কাঁচামাল উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্যবহার এবং ব্যবহার-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা—সমগ্র জীবনচক্র বিবেচনায় নিয়েই প্রকৃত মূল্যায়ন করতে হয়।”

“তাহলে বায়োপ্লাস্টিকের সুবিধাগুলো নিঃশর্ত নয়?” অনুজ কৌতূহলী চোখে প্রশ্ন করল,

আমি বললাম, “একদম ঠিক।”

এরপর আবার বলতে শুরু করলাম—

“বায়োপ্লাস্টিকের একটি বড় সুবিধা হলো নবায়নযোগ্য কাঁচামালের বৈচিত্র্য। এসব কাঁচামাল সাধারণত তিন প্রজন্মে (generation) ভাগ করা হয়। প্রথম প্রজন্মের কাঁচামাল হলো খাদ্যশস্যভিত্তিক ফসল—যেমন আখ ও ভুট্টা। দ্বিতীয় প্রজন্মের কাঁচামাল আসে কৃষিজ অবশিষ্টাংশ (agricultural waste) ও উপজাত (byproduct) থেকে—যেমন চিটাগুড় (molasses), আখের ছোবড়া (sugarcane bagasse) ও ভুট্টার খোসা (corn husk)। তৃতীয় প্রজন্মের কাঁচামাল—যেমন শৈবাল (microalgae) ও বিভিন্ন বর্জ্য (waste/sludge)—প্রযুক্তিগতভাবে আরও উন্নত এবং সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না। তাত্ত্বিকভাবে এসব উৎস জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে এবং সার্কুলার অর্থনীতিতে (circular economy) অবদান রাখতে পারে।

চাষের সময় এসব ফসল বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে, যা কিছু গবেষণায় পরিবেশগত সুবিধা হিসেবে বিবেচিত হয় (credit for sequestered CO2)। তবে অনেক গবেষণায় এই কার্বনকে ‘কার্বন-নিরপেক্ষ’ (carbon neutral) ধরা হয়, কারণ জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে এই কার্বন (biogenic carbon) আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। বর্জ্য উপাদানকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করলে অতিরিক্ত পরিবেশগত সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, কারণ এতে প্রচলিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কিছু প্রভাব এড়ানো সম্ভব হয় (avoided credit)। তবে এসব সুবিধা নিশ্চিত নয়। একটি বায়োপ্লাস্টিকের সামগ্রিক পরিবেশগত কর্মক্ষমতা কাঁচামালের ধরন, কৃষি পদ্ধতি এবং পুরো উৎপাদন শৃঙ্খলে ব্যবহৃত শক্তির ওপর অত্যন্ত সংবেদনশীল।”

কথা শেষ করে আমি অনুজের দিকে তাকালাম। সে প্রশ্ন করল,

“এই শক্তি কোন ধাপে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়?”

আমি বললাম, “বায়োপ্লাস্টিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফার্মেন্টেশন ও পলিমারাইজেশন ধাপ সাধারণত সবচেয়ে বেশি শক্তি-নির্ভর।”

বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে অনুজ বলল, “একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। যদি বায়োপ্লাস্টিকের কাঁচামাল ভিন্ন হয়, তাহলে কি পরিবেশের ওপর প্রভাবও বদলে যায়?”

আমি প্রশংসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

“খুবই ভালো প্রশ্ন। হ্যাঁ, কাঁচামাল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কারণেই বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আখ থেকে এক কেজি পলিল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপাদনে আনুমানিক ৪০০ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়। অথচ মাইক্রোঅ্যালগি বা ক্ষুদ্র শৈবাল থেকে একই পরিমাণ উৎপাদনে প্রায় ১২ কিলোগ্রাম পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হতে পারে, কারণ এই প্রযুক্তি এখনও পুরোপুরি অপ্টিমাইজড নয়। জলবায়ু প্রভাবের পাশাপাশি কাঁচামাল চাষে ভূমি ও পানিসম্পদের ওপরও চাপ সৃষ্টি হয়। সার ও কীটনাশকের ব্যবহার থেকে সৃষ্ট রাসায়নিক ধুয়ে জলাশয়ে প্রবাহিত হয়ে ইউট্রোফিকেশন ও অম্লায়নের (acidification) ঝুঁকি বাড়ায়। এসব সমঝোতা বা ট্রেড-অফই দেখায়, কেন কেবল ‘জৈবভিত্তিক’ তকমা লাগালেই কোনো প্লাস্টিককে পরিবেশবান্ধব (eco-friendly) বলা যায় না।”

অনুজ বলল, “উৎপাদন বিষয়টা এখন পরিষ্কার। কিন্তু বায়োপ্লাস্টিকের নিষ্পত্তি তো সহজ হওয়ার কথা, কারণ এটা তো পঁচনশীল।”

আমি মৃদু হেসে বললাম,

“এখানেই আসল জটিলতা। ব্যবহার-পরবর্তী ব্যবস্থাপনাও (waste management) বড় চ্যালেঞ্জ। বায়োপ্লাস্টিকের শেষ পরিণতি হতে পারে রিসাইক্লিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পোস্টিং, অ্যানারোবিক ডাইজেশন, ল্যান্ডফিল বা ইনসিনারেশন। প্রতিটি পথের নিজস্ব সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রিসাইক্লিং করলে নতুন বায়োপ্লাস্টিক (virgin bioplastic) উৎপাদনের চাহিদা কমানো যায়, তবে এতে উচ্চ শক্তি ব্যয় ও উন্নত বাছাই অবকাঠামোর (sorting infrastructure) প্রয়োজন হয়। কম্পোস্টিং বা ল্যান্ডফিল তুলনামূলক কম শক্তি ব্যবহার করে, কিন্তু কার্যকর হতে হলে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ (thermophilic condition 55-60°C) দরকার। তা না হলে অসম্পূর্ণ বিয়োজন (partial/incomplete degradation) ঘটতে পারে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বা মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ঝুঁকি বাড়ায়। পাশাপাশি, বায়োপ্লাস্টিক যদি নন-বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকের সঙ্গে মিশে যায়, তাহলে প্রাকৃতিক পচন ব্যাহত হয়। আরও একটি সমস্যা হলো—বাজারে কিছু পণ্য নিজেদের ‘সবুজ’ দাবি করলেও প্রকৃত অর্থে সেগুলো বায়োপ্লাস্টিক নয়। তাই দক্ষভাবে বর্জ্য পৃথকীকরণ এবং ভোক্তা সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।”

কিছুক্ষণ ভেবে অনুজ আবার প্রশ্ন করল, “ভাইয়া, বায়োপ্লাস্টিকের সঙ্গে এলাকার বা অঞ্চলের কোনো সম্পর্ক আছে কি?”

আমি বললাম,

“এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বায়োপ্লাস্টিকের পরিবেশগত কর্মক্ষমতা অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়। কৃষি পদ্ধতি, জলবায়ু, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি মিশ্রণ ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্যপূর্ণ। ফলে একটি দেশে কার্যকর বায়োপ্লাস্টিক অন্য দেশে একই সুবিধা নাও দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় এখনও ৬০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত হয়, যার ফলে খনি খনন ও জ্বালানি দহনের পরিবেশগত প্রভাব উল্লেখযোগ্য। থাইল্যান্ড বা বেলজিয়ামের বিদ্যুৎ উৎপাদন কাঠামো আবার ভিন্ন। তবে ইতিবাচক দিক হলো—বিশ্বজুড়ে দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে এগোচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তিতে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘Net zero emission’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।”

আমার কথা শেষ হতেই অনুজ বলল,

“তাহলে সব মিলিয়ে বলা যায়, সঠিক শর্তে বায়োপ্লাস্টিক প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন অপ্টিমাইজড কাঁচামাল নির্বাচন, শক্তি-দক্ষ উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং উপযুক্ত ব্যবহার-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা। এগুলো ছাড়া বায়োপ্লাস্টিক বাস্তব সমাধানের বদলে কেবল প্রতীকী উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। সত্যিকারের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণ—উভয় ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক প্রমাণকে ভিত্তি করতে হবে।”

আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম,

“একদম ঠিক। বায়োপ্লাস্টিকের উৎপাদন, ব্যবহার ও নিষ্পত্তি এখনও বিকাশমান (emerging) পর্যায়ে রয়েছে। সঠিক গবেষণার ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ করতে পারলে তবেই বায়োপ্লাস্টিক পরিবেশ রক্ষার কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।”

সুপারভাইজারের সঙ্গে মিটিংয়ের সময় হয়ে যাওয়ায় আলোচনাটি সেখানেই থামাতে হলো। অনুজ বলল, আজকের কথোপকথন তাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। কল শেষ করে আবার নিজের কাজে মন দিলাম। কিন্তু তখনও মাথার মধ্যে একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল—প্লাস্টিক সমস্যার মতো জটিল বিষয়গুলোর সমাধান এখনো আমাদের অপেক্ষায় আছে, আর সেই পথ তৈরি করাটাই আমাদের দায়িত্ব।

তথ্যসূত্রঃ 

  1. Islam et al. (2024). Impact of bioplastics on environment from its production to end-of-life. Process Safety and Environmental Protection, 188, pp.151-166.
  2. Islam et al. (2025). Environmental footprint of polylactic acid production utilizing cane-sugar and microalgal biomass: An LCA case study. Journal of Cleaner Production, 496, p.145132.
Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org