বাংলাদেশি গবেষকদের নেটওয়ার্ক—এই ধারণাটি হয়তো অনেকের কাছে নতুন শোনাবে, কিন্তু এর ভেতরে নিহিত রয়েছে অসাধারণ এক শক্তি। বিদেশে ছড়িয়ে থাকা গবেষকরা যখন এক জায়গায় এসে মিলিত হন, তখন তা শুধু জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে না, বরং দেশের উন্নয়নকেও নতুন গতিপথে এগিয়ে দেয়। জাপানে অবস্থানরত বাংলাদেশি গবেষকদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা Network of Bangladeshi Researchers in Japan (NBRJ) সেই শক্তিরই প্রতিফলন।
আগামী ১৩–১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ সালে জাপানের কাওয়াসাকি শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৪র্থ International Conference on Japan–Bangladesh Research and Practice (JBRP2025)। এই সম্মেলন কোনো সাধারণ একাডেমিক আয়োজন নয়, বরং এটি হয়ে উঠছে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে গবেষণা ও উদ্ভাবনের সেতুবন্ধন। একদিকে জাপানের প্রযুক্তিনির্ভর অগ্রযাত্রা, অন্যদিকে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা—এই দুই ভিন্ন অভিজ্ঞতা যখন একত্রিত হয়, তখন নতুন সমাধান, নতুন দিকনির্দেশনা ও নতুন সুযোগ তৈরি হয়।
বাংলাদেশ এখনো গবেষণার অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে। পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি নেই, উন্নত সরঞ্জাম বা বড় পরিসরের অর্থায়নও দুর্লভ। তবুও বাংলাদেশের তরুণ গবেষকেরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের দক্ষতার ছাপ রাখছেন। জাপানের মতো দেশে তাঁরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন, সেটিই বাংলাদেশের জন্য অমূল্য সম্পদ। JBRP সেই অভিজ্ঞতাকে দেশের সঙ্গে যুক্ত করার একটি মাধ্যম, যেখানে উপস্থাপিত হবে গবেষণার ফলাফল, আলোচিত হবে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ, আর কল্পনা করা হবে দুই দেশের যৌথ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ।
সম্মেলনের বিষয়বস্তুতেও দেখা যায় এই বৈচিত্র্য। এখানে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে চারটি দিককে—গবেষণার অর্জন, বাংলাদেশ ও জাপান সম্পর্কিত জরিপমূলক কাজ, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা, এবং বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান। এটি প্রমাণ করে যে JBRP কেবল একাডেমিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত প্রশ্নগুলোকেও সামনে আনছে। অর্থাৎ, এটি একইসঙ্গে একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলন এবং উন্নয়ন সংলাপ।
জাপান বহু দশক ধরে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থা—সব ক্ষেত্রেই জাপানি সহায়তা দৃশ্যমান। কিন্তু গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সম্পর্ক এখনো তেমন দৃঢ় হয়নি। JBRP সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। এখানে বাংলাদেশি গবেষকেরা জাপানি সহকর্মীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করলে উভয় দেশই উপকৃত হবে। জাপান তার অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি ভাগ করে দেবে, আর বাংলাদেশ প্রদান করবে গবেষণার জন্য নতুন ক্ষেত্র ও সামাজিক প্রেক্ষাপট।
এই আয়োজনের আরেকটি বড় শক্তি হলো আন্তঃবিষয়ক (interdisciplinary) দৃষ্টিভঙ্গি। আধুনিক গবেষণার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো বিভিন্ন শাখার সীমারেখা ভেঙে সহযোগিতা তৈরি করা। পরিবেশ সমস্যা সমাধানে যেমন প্রকৌশল ও সমাজবিজ্ঞান একসঙ্গে কাজ করে, তেমনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল প্রশ্ন মেটাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নেওয়া হয়। JBRP2025 সেই আন্তঃবিষয়ক আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করছে, যা তরুণ গবেষকদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এ ধরনের উদ্যোগ চালিয়ে যাওয়া সহজ নয়। বিদেশে থাকা গবেষকদের সময়, অর্থ ও শ্রমের সীমাবদ্ধতা থাকে। কিন্তু NBRJ ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি থাকলে বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। পূর্ববর্তী সম্মেলনগুলোতে দেখা গেছে, এখান থেকে অনেক যৌথ গবেষণা প্রকল্প শুরু হয়েছে, অনেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সহযোগিতায় যুক্ত হয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে, এ ধরনের সম্মেলন বাস্তব ফলাফল বয়ে আনে।
এবারের সম্মেলনের জন্য সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫। এটি শুধু একটি সময়সীমা নয়, বরং বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের জন্য একটি সুযোগ। হয়তো সবাই জাপানে গিয়ে সরাসরি অংশ নিতে পারবেন না, কিন্তু অনলাইনের মাধ্যমে অংশগ্রহণের দরজা সবার জন্যই খোলা। যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে, তবে বাংলাদেশের গবেষণার মান বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের পরিচিতি আরও বিস্তৃত হবে।
সবশেষে বলা যায়, JBRP2025 কেবল একটি সম্মেলন নয়, এটি একটি স্বপ্ন—বাংলাদেশি গবেষকদের বিশ্বমঞ্চে আরও শক্তিশালীভাবে তুলে ধরার স্বপ্ন। এখানে জ্ঞান ভাগাভাগি হবে, তৈরি হবে নতুন সহযোগিতা, আর উন্মোচিত হবে বাংলাদেশের জন্য গবেষণাভিত্তিক উন্নয়নের সম্ভাবনা। একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতি শুধু অর্থনীতির পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যায় না; এটি নির্ভর করে গবেষণা, উদ্ভাবন এবং জ্ঞানের গভীরতার ওপর। সেই অগ্রযাত্রায় JBRP একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা আমাদের গবেষণা সংস্কৃতিকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে।
বিস্তারিত পড়ুন: https://nbrj.jp/jbrp-2025/
Leave a comment