গবেষণায় হাতে খড়ি

আজকের বাংলাদেশ গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) খাতে খুবই নগন্য পরিমানের বরাদ্দ দেয় যা UNESCO, World Bank সহ অনেক সংস্থা হিসেবের মধ্যে নেয় না।

Share
Share

সাইফ ইসলাম
Professor and Chair, Electrical & Computer Engineering
University of California – Davis [email protected]

২০২১ সালে ভারত জিডিপির ০,৬২% (প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার) গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে খরচ করেছে। ভারত ২০৩০ সালে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের মোট বরাদ্দ জিডিপির ২% বা তার উপরে নিয়ে যাবে। এছাড়া, ২০২১ সালে থাইল্যান্ড জিডিপির ১,২%, মালয়েশিয়া ০,৯৫%, চীন ২,৪৩%, তুরস্ক ১,৪%, এবং দক্ষিণ কোরিয়া ৪,৯৩% খরচ করেছে।

কয়েক বছর আগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণা আর জিডিপি সম্পর্ক নিয়ে আমার কিছু ভাবনা একটা ব্লগে লিখেছিলাম, যেটাকে আবার এখানে তুলে ধরছি।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অর্থনীতিতে গবেষণার ভূমিকা

——————-সারাংশ——————-

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ আমাদের দেশের জিডিপি এবং অর্থব্যাবস্থাকে বহুগুনে বৃদ্ধি করবে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের হিসেবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (The Fourth Industrial Revolution) অটোমেশনের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ দুনিয়া জুড়ে প্রায় ৮০ কোটি শ্রমিক তাদের পেশা হারাবে। এদের মধ্যে আমাদের গার্মেন্টসের শ্রমিকরা, প্রবাসী এবং কৃষিকার্জে নিয়োজিত শ্রমিকরা পড়বে ব্যাপকভাবে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি প্রধানতঃ এই তিনটি শ্রেণীর পেশাজীবিদের কঠোর পরিশ্রমের ভিতের উপর দাড়িয়ে আছে। অপরদিকে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের পূর্বাভাস মতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া কাজের জন্য চারটি নতুন পেশার আবির্ভাব হবে যেগুলোর বেশিরভাগই হবে প্রযুক্তি নির্ভর।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব তার বিশালতা, প্রসার, সুযোগ, এবং জটিলতার মাধ্যমে অভূতপূর্ব সামাজিক এবং অর্থনৈতিক রূপান্তরের কারণ হবে – যা এর আগে মানব সভ্যতা কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত গবেষনায় বিনিয়োগ আমাদের অতিদ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতি অর্জনে সাহায্য করবে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করবে। গবেষণায় বিনিয়োগ কয়েকশত গুন বড়ো হয়ে সমাজে কর্মসংস্থান, নতুন রাজস্ব এবং বিশ্বময় বাণিজ্যের দ্বার উম্মোচন করে। যে কোনো দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করে.

(১) বাংলাদশের আজকের অর্থনীতির স্তম্ভগুলো।

আধুনিক সমাজের জন্য অত্যাবশ্যক যে স্তম্ভগুলোকে উপেক্ষা করলে সমাজ গুরুতরভাবে পেছনে পড়ে থাকে আর অর্থনৈতিক উন্নতির গতি অত্যন্ত মন্থর হয়ে আসে, বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত গবেষণা সে তালিকার শীর্ষে পড়ে। বিশেষ করে আমাদের মত বিশাল জনসংখা আর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় জর্জরিত একটি দেশের জন্য গবেষণালব্ধ মৌলিক সমাধান আরও গুরুত্বপূর্ণ। এ লেখাটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গবেষণা, গবেষণায় সমষ্টিগত এবং সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার গুরুত্ব, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সুদক্ষ প্রবাসীদের ভুমিকা এবং সবশেষে কিভাবে সর্বোচ্ছ পর্যায়ে আসীন নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত একটি শক্তিশালী বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণার নীতিমালা নাগরিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তার উপরে। সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি গবেষণানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিভাবে আমরাও অতিদ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতি অর্জন করতে পারব, কিভাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে পারবো, বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে তা তুলে ধরা হলো।

আলোচনার শুরুতেই আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খাতগুলো তুলে ধরা যাক। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি প্রধানতঃ তিনটি শ্রেণীর পেশাজীবিদের কঠোর পরিশ্রমের ভিতের উপর দাড়িয়ে আছে। এরা হলো গার্মেন্টসের শ্রমিকরা- যাদের অধিকাংশই নারী – যারা আর্থিক এবং শিক্ষাগত সুযোগ থেকে বঞ্চিত। দ্বিতীয় দলে আছে নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী শ্রমিকরা। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বছরগুলো তারা অধিকারহীন অভিবাসী হিসেবে পরিজন বিবর্জিত পরিবেশে অনাদর আর অবহেলায় শেষ করেন। তাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ভরে উঠেছে। সব শেষের দলটি এই দেশের কৃষক, – রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে যাদের বিরামহীন খাটুনির বিনিময়ে আমাদের জাতি খাদ্যের নিশ্চয়তা পাচ্ছে। এই তিনটি গোষ্ঠীই দেশের অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে। রূপকার্থে, এই তিনটি অর্থনৈতিক খাত হলো একটি গাড়ির তিনটি চাকার মতো। গাড়িটি গতিশীল হতে হলে একটি চতুর্থ চাকার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে বলীয়ান তরুণ প্রজন্মকে চতুর্থ চাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন যে নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তির অগ্রগতি কাজে লাগিয়ে দেশকে আরো সামনের দিকে নিয়ে যাবে।

উপরের এই গাড়ির উপমাটাকে আরেকটু প্রসারিত করা যাক। আজকের তিনটি অর্থনৈতিক খাতের যে তিনটি চাকা আমাদের দেশে আছে, তার সাথে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির চতুর্থ চাকা জুড়ে দিয়ে গাড়ী নির্মাণ করতে হলে একজন দক্ষ পরিকল্পকের দরকার হবে। একটি যুগোপযোগী গাড়ি নির্মাণ করে পরিকল্পক দেশকে উন্নতির অগ্রযাত্রায় দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। এই উপমার চালক বা আধুনিক পরিকল্পনাকার কে? সে হলো সমবেতভাবে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিষয়ক সুস্পষ্ট জাতীয় নীতিমালা; গবেষনার জন্য অনুপ্রেরণা এবং তহবিল; বহির্বিশ্বের সাথে প্রযুক্তিগত ঘনিষ্ঠতা; প্রযুক্তি-ভিত্তিক এন্তের্প্রেনার্শিপের (entrepreneurship) জন্য পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ এবং উদার অনুদান। আমাদের দেশে এই ধরনের একজন চালকের আবির্ভাব এখনো হয়নি। সেকারণে অর্থনৈতিক উন্নতির গতি তিন চাকার মালবাহী গাড়ীর চেয়ে বেশি গতিতে এগুতে পারেনি। অথচ সারা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ এসময়ে এগিয়েছে দ্রুতগতিময় গাড়ীর বেগে।এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের গাড়িটিকে আমরা যতো বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন করতে চাইবো তত বেশি সুনিপুণ নির্মাতা এবং দক্ষ চালকের দরকার হবে।

গবেষকদের মাঝে একটা সর্বজনস্বীকৃত তথ্য হলো পৃথিবীর ইতিহাসে যতো বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে তাদের অধিকাংশই আমাদের মাঝে বর্তমান সময়ে জীবিত আছেন । কথাটি বর্তমান জগতে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির গভীর ভূমিকাকে এবং জাতিসমূহের মধ্যে গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যাপৃত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের বিশাল সংখ্যাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

এই বিপুল গবেষক গোষ্ঠিকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য উন্নত এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো জিডিপির শতকরা ১ থেকে ৩ ভাগ এবং ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশি ব্যয় করে থাকে। কেন এসব দেশ গবেষনার জন্য এত অর্থ বরাদ্ধ করছে? কারণ দুটো। প্রথমত: একবিংশ শতকের সমাজ এবং জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর জন্য গবেষণা নির্ভর সমাধানের বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত: গবেষণায় বিনিয়োগের সুফল শত শত, এমনকি হাজার গুনে বর্ধিত হয়ে সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং আগামী দিনের অনিশ্চয়তা থেকে জাতিকে রক্ষা করে।

গবেষনার ভূমিকাকে একটি গাছের বড় হওয়ার বিভিন্ন পর্যায় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। একটা জাম গাছের উদাহরণ দেয়া যাক এখানে। জাম ক্যান্সার সহ অনেক রোগের জন্য বিশেষভাবে উপকারী বলে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন। কোনো ধরনের যত্ন আর পরিচর্যা ছাড়া কাকতলীয়ভাবে গ্রামের বনে বাদাড়ে বেড়ে উঠা একটি জাম গাছ যত উত্পাদনক্ষম হবে, সামান্য পরিচর্যা, সময়মত পানি, সার, কীটনাশক আর আগাছা দূরীকরণের মাধমে সেটাকে কয়েকগুন ফলদায়ক করা সম্ভব। আবার গবেষনা আর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধমে সেই জাম গাছের বীজ অথবা গাছটিকে বিজ্ঞানীরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কয়েকগুন বেশি ফলনশীল, ফলগুলোকে আকারে অনেক বড়, রসালো, তুলনামুলকভাবে বেশি মুখরোচক, খরা এবং রোগপ্রতিরোধী করে অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভজনক গাছে পরিনত করতে পারেন। অধিকন্তু, ফল সংগ্রহ করার দ্রুত পদ্ধতি, জামের রস (জুস) সংরক্ষণ করা, এর প্যাকেজিং, এর খাদ্যতালিকাগত সম্পূরক উপাদান হিসেবে ব্যবহার, বহির্বিশ্বের বাজারে অনুপ্রবেশ, বিজ্ঞাপন এবং বাজার সৃষ্টি, এই ফলের ক্লিনিকাল ট্রায়াল ইত্যাদির উপর সুসম্বদ্ধ গবেষণা হতে পারে। এসবই অত্যন্ত ব্যয়বহুল পদক্ষেপ এবং এগুলোর জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। ব্যক্তিগত বা বেসরকারী উদ্যোগে এধরনের গবেষণার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু গবেষনার এই বিনিয়োগর কয়েকগুন, এমনকি কয়েকশত গুন সুফল আমরা ফিরে পাব কর্মসংস্থান, রাজস্ব এবং অর্জিত বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধমে। জামের উপর কৃত গবেষণা যদি বিশাল মুনাফা নাও আনে, অর্জিত অভিজ্ঞতা অনুরূপ কোনো খাতের জন্য নিশ্চিতভাবে কাজে লাগবেই।

(২) গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ।

যারা বলেন আমাদের দেশের জন্য গবেষণা একটা বিলাসিতা তারা দেখুন কিভাবে আমাদের গবেষকরা বিশ্বমানের গবেষণার বিনিময়ে বাংলাদেশকে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। গত কয়েক দশকে জনসংখা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে আর জমির পরিমান কমেছে ভীতিকর হারে। অথচ আমরা পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি আমাদেরই বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত পদ্ধতি, বীজ আর সার ব্যবহার করে। সম্প্রতি বাংলাদেশী বিজ্ঞানীরা একই জমিতে বছরে চারবার ফসল ফলানোর মত নতুন কৌশলও আয়ত্ত করেছেন। আমদের বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে একবিংশ শতকের সমস্যা সমাধানে যে কোনো জাতির বিজ্ঞানীদের মতই দক্ষতা দেশে-বিদেশে দেখিয়ে যাচ্ছেন। একসময় লেখক হুমায়ূন আহমেদ এদেশে বিশ্বমানের গবেষণা সম্ভব নয় বললেও জীবনের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশে ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার স্থপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমাদের নীতিনির্ধারকদের জানা উচিত যে আজকের পৃথিবীতে কোনো জাতিই শুধুমাত্র প্রযুক্তির ভোক্তা হিসেবে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারবে না।

ইউনেসকোর উপাত্ত অনুসারে ২০১৬ সালের বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত গবেষণা খাতে কতগুলো দেশের মোট খরচের পরিমান এবং প্রতিটি দেশের গবেষণায় বরাদ্ধ জিডিপির শতকরা অংশ হলো (মার্কিন ডলারে): ইথিওপিয়া ৭৯ কোটি (০. ৬১%), ভিয়েতনাম ৮৭ কোটি (০.২১%), পাকিস্তান ২৪০ কোটি (০.২৯ %), মালোয়শিয়া ১০৬০ কোটি (১.৩%), সিঙ্গাপুর ১০০০ কোটি (২.২%), তুরস্ক ১৫৩০ কোটি (১%), ভারত ৬৬৫০ কোটি (০.৯%), দক্ষিন কোরিয়া ৯১৬০ কোটি (৪.৩ %), চীন ৪৫১৯০ কোটি (২.১%) আর যুক্তরাষ্ট্র ৫৪১১০ কোটি (২.৭%) মার্কিন ডলার। একই সময়ে (২০১৬ সালে) বাংলাদেশ জিডিপির ০.০২% চেয়েও কম অর্থাৎ ৩০ কোটি ডলারেরও কম খরচ করছে গবেষণায়। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য সর্বমোট মোট বরাদ্দ ছিল প্রায় ১২ কোটি মার্কিন ডলার (৯৭০ কোটি টাকা)। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ক্ষুদ্র একটা অংশই গবেষণায় অবদান রাখে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (BCSIR) ২০১৭-১৮ বাজেট ছিল ২২ কোটি মার্কিন ডলার. গবেষণা অর্থায়নের এতো স্বল্প বরাদ্ধ একটি হতাশাদায়ক প্রবণতা এবং এটা আমাদের নীতি নির্ধারকদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগত-বিচ্ছিন্নতাকে দৃষ্টিগোচর করে দিচ্ছে।

২০১৪ সালে আঙ্কারায় এক আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কর্মশালার আমার যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়। তুরস্কের বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালযের বেশ কিছু নেতৃবৃন্দ পুরো তিনদিন ধরে আমন্ত্রিত অতিথি এবং বিজ্ঞানীদের সাথে ছিলেন। উপমন্ত্রী দাউদ কাভরানোলু তার সংক্ষিপ্ত অভিভাষণ শুরু করেন এভাবে: “২০১২ সালে তুরস্ক প্রতি কিলোগ্রাম পণ্য রপ্তানী করে গড়ে ১০ ডলার উপার্জন করেছে। একই সময়ে জার্মানি সমওজনের রপ্তানীকৃত পণ্যের জন্য উপার্জন করেছে ১০০ ডলারের উপরে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই যে ষাটের দশকে তুরস্ক এক কিলোগ্রাম পণ্য রপ্তানী করে উপার্জন করতো দশ সেন্টের সামান্য উপরে, অর্থাৎ বর্তমানের উপার্জনের চেয়ে প্রায় ১০০ গুন কম। এই যে মূল্যের এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান, এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনারা?” প্রশ্ন করলেন তুরস্কের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক উপমন্ত্রী আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলে গেলেন আরো কিছু পরিসংখ্যান। “তুরস্কের বার্ষিক রপ্তানীর পরিমান ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ওজনে সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানী করে জার্মানী অর্জন করে দেড় ট্রিলিয়ন (১৫০০ বিলিয়ন) ডলার। এর অর্থ হচ্ছে জার্মানির কারিগরের পণ্যের জন্য বিশ্বের ক্রেতারা তুরস্কের তুলনায় দশগুণ বেশি দাম দিতে রাজী। দুই দেশের জনসংখা প্রায় কাছাকাছি, যদিও তুরস্কের আয়তন জার্মানীর প্রায় দ্বিগুন। তাহলে পার্থক্যটা হচ্ছে কি কারনে? কেন আপেল (Apple) কম্পিউটার কোম্পানির প্রতি কিলোগ্রাম পণ্যের গড়পড়তা বিক্রয় মূল্য ২০০০ ডলারের উপরে? ১৯৯৫ সালে তুরষ্কের জিডিপি ছিল ১১৬ বিলিয়ন ডলার। ১৬ বছর পর ২০১২ সালে তুরষ্কের জিডিপি ৬ গুন বেড়ে হলো ৮০০ বিলিয়ন ডলার। আরো ১২ বছর পর ২০২৫ সালে জিডিপিকে বাড়িয়ে বর্তমান জার্মানীর সমপর্যায়ে নিযে যেতে চাই আমরা। অর্থাৎ আমরা ২০২৫ সালে তুরস্কের জিডিপি আজকের জিডিপির চেয়ে প্রায় সাড়ে চার গুন বাড়িয়ে ৩৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করবো এবং অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দশটি দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবো।”

অন্য যে কারো মতই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল কথাগুলো এবং আমি হয়ত তার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতাম যদি না জানতাম যে উপমন্ত্রী দাউদ কাভরানোলু ক্যালটেক (Caltech) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করেছেন, একজন অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালযের সবগুলো ভবিষৎ পরিকল্পনার স্থপতি তিনি। পিন পতনের নীরবতায় আমি তার স্বপ্নিল কথাগুলো গিলছিলাম। “আজ তুরস্কে আমরা জিডিপির ০.৭% গবেষণা খাতে ব্যয় করছি এবং দেশে মোট ৩০ হাজারের মত গবেষক বর্তমানে কাজ করছেন বিভিন্ন গবেষণা ক্ষেত্রে।১৯৯৫ সালে তুরস্কে মোট গবেষকের সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের নীচে। ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা গবেষণা খাতে বরাদ্ধ ক্রমাগত বাড়িয়ে আমাদের জিডিপির ৩% পর্যন্ত উন্নীত করবো। তাতে প্রতিবছর গবেষণায় প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে বিনিয়োগ করা হবে। আমরা আশা করছি প্রায় ৩ লক্ষেরও বেশী গবেষক তখন আমাদের অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখবেন।” অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে তুরস্ক গবেষকের সংখ্যা প্রায় ত্রিশগুণ বাড়িয়ে তাদের পণ্যের মান এবং কদর জার্মানীর পণ্যের সমকক্ষ করবে। আর তারা ২০২৫ সালে শুধুমাত্র গবেষণা খাতেই খরচ করবে বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় বাজেটের তিন গুনের উপরে। উপমন্ত্রী দাউদ কাভরানোলুর বক্তব্যকে হেসে উড়িয়ে দিতাম যদি না জানতাম যে তুরস্ক তার আগের কয়েক বছর ধরে প্রায় ১০% এর কাছাকাছি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

২০২৫ সালে তুরস্কের জিডিপি জার্মানীর জিডিপির সমান হয়নি! এটা অতি উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন ছিলো। রাজনৈতিক অস্থিরতা, নেতৃত্বের একনায়কসুলব আচরণ, প্রতিবেশী সিরিয়া আর ইরাকের উদ্বাস্তু সমস্যা সত্বেও তুরস্কের জিডিপি ১,৪৩৭ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তুরস্ক গবেষণা খাতে বরাদ্ধ ০,৭% থেকে বাড়িয়ে জিডিপির ৩% পর্যন্ত উন্নীত করতে পারেনি – করেছে ১,৪% পর্যন্ত।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১২ সালে সেটা ৩ গুন বেড়ে হলো ১১৬ বিলিয়ন। একই সময়ে তুরস্কের জিডিপি বেড়েছে ৬ গুন এবং এরচেয়েও দ্রুত গতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে দেশটি গবেষনায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে প্রতিবছর।

নব্বইয়ের দশকে আমি আঙ্কারায় ছাত্র হিসেবে যাওয়ার পূর্বে তুরস্কের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ছিল অনেকটা আজকের বাংলাদেশের মতই। সেখানে যদিও বংশানুক্রমিক গণতন্ত্র ছিলনা, তবুও হতাশ মানুষ ঘুরেফিরে একই নেতাদের যুগের পর যুগ ক্ষমতায় দেখেছে। যুবসমাজ রাজনীতিবিদদের একদল শ্রদ্ধাহীন, স্বার্থান্বেষী দস্যুর মতই মনে করতো। রাজনীতিবিদদের একচ্ছত্র প্রভুত্বে যখনি তারা আগাপাশতলা জিম্মি হয়ে যেত, অস্থিতিশীলতা সমাজকে আবৃত করা ফেলত, তখনি সামরিক বাহিনী এসে নির্মম ও আত্মধ্বংসী পদক্ষেপ নিয়ে দেশকে পিছিয়ে দিতো বারবার। আজকের বাংলাদেশের মতই জার্মানি আর মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী তুর্কী শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ তুর্কী অর্থনীতির বড় খাতগুলোর একটি ছিল। গবেষণা ভিত্তিক অর্থনীতি তখনও সমাজের গভীরে শেকড় গজাতে পারেনি। সেই দেশটি দুই দশকের কম সময়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বলে বলিয়ান হয়ে পৃথিবীর শীর্ষ ধনী দেশের তালিকায় ১৬ নম্বরে আছে।

কফি বিরতিতে আমি উপমন্ত্রী দাউদ কাভরানোলুকে জিজ্ঞাসা করি কিভাবে তারা তুরস্কে বছরে ১০% মত প্রবৃদ্ধি সম্ভব করেছেন। তিনি সংক্ষেপে বললেন – বিশাল বৃক্ষের চারা প্রথম কয়েক বছর দ্রুত বাড়তে থাকে যদি ভালো জাতের বীজ বাছাই করে লাগানো হয়, যদি গাছটি ঠিকমত পানি, আলো, বাতাস, সার ইত্যাদি পায় আর যদি গবাদী পশু বা পোকামাকড় তার ডালপালা খেয়ে না ফেলে। পরিনত বয়সে মহীরুহের বৃদ্ধির হার কমে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বিশাল অর্থনীতির শতকরা এক অথবা দুই ভাগ প্রবৃদ্ধি তুরস্কের মত ছোট অর্থনীতির প্রায় জন্য পাঁচ থেকে দশ ভাগ প্রবৃদ্ধির সমান। দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা, প্রযুক্তির অপ্রাতুলতা, সামাজিক অস্থীরতা, স্বজনপ্রীতি আর রাজনীতিবিদদের স্বার্থান্বেষী মনোভাব যদি বাধা হয়ে না দাড়ায়, তাহলে যে কোনো উন্নয়নশীল দেশ সহজেই ২০% হারেও প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। আজারবাইজান, চীন, এঙ্গোলা এবং আরো বেশ কিছু দেশ কোনো কোনো বছর ১০% থেকে ৩০% পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তুরস্কের উপমন্ত্রী এবং বেশ কজন উপদেষ্ঠার জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, ধীশক্তি এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা আমাকে অবিভূত করেছে। নব্বইয়ের দশকের শেষে আর নতুন শতাব্দীর শুরুতে তুরস্ক প্রতিষ্ঠা করেছে অনেকগুলো গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। বিপুল সংখ্যক প্রবাসী তুর্কী বিজ্ঞানী, প্রকোশলী এবং শিল্পপতি দেশে ফিরে এসেছে দেশের দেয়া অনুকুল পরিবেশের সুযোগ নিয়ে। সমষ্টিগত মেধা, স্বজ্ঞা, পরিকল্পনা আর বিশাল গবেষক বাহিনী তুরস্ককের অর্থনীতিকে সফলভাবে রক্ষা করেছে যখন তাদের প্রতিবেশী গ্রীস হয়ে গেছে আর্থিকভাবে দেউলিয়া এবং সিরিয়া আর ইরাক জড়িয়ে পড়েছে ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধে।

২০২৫ সালের এক অত্যন্ত পীড়াদায়ক এবং দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো স্বৈরাচারী নেতৃত্বের দম্ভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অসহিষ্ণুতা আজকের তুরস্ককে আবার আশির দশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিভাবান অনেক তুর্কী বিজ্ঞানী, প্রকোশলী এবং গবেষকরা ব্যাপকভাবে চলে যাচ্ছেন তাদের দেশ ছেড়ে। উপমন্ত্রী দাউদ কাভরানোলুও পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েক বছর হলো।

(৩) কৃতবিদ্য প্রবাসীদের ভূমিকা।

যদি আমরা আগামী এক দশকে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সমতুল্য পরিমানে গবেষণায় ব্যয় করতে চাই (জিডিপির ০.৬২%), আমদের বার্ষিক গবেষনার বাজেট হতে হবে ৩৫,৭৫০ কোটি টাকা (২৮৬ কোটি মার্কিন ডলার)। ২০২৪ সালের জিডিপির ভিত্তিতে এটা নিরূপণ করা হলো যা ছিল প্রায় ৪৫,০০০ কোটি মার্কিন ডলার। অত্যন্ত দুঃখজনক সত্য হলো আমরা বর্তমানে জিডিপির ০.৩% ভাগেরও কম খরচ করছি গবেষণায়। লক্ষ করুন ইথীয়পিয়াও আমাদের চেয়েও তিনগুণ বেশী গবেষণায় ব্যয় করছে। পশ্চিমের সাথে যদি তুলনা করতে যাই – শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয ক্যাম্পাস, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া ডেভিসের (আমার কর্মক্ষেত্র ) গবেষনার বাজেটও BCSIR বাজেটের চার গুনের বেশি ছিল ২০১৭-১৮ সালে।

২০২৩ সাল নাগাদ অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা যদি জিডিপির ১% খরচ করার পরিকল্পনা করি, সে টাকা দিয়ে কি করবে আমদের গবেষকরা? এত উচ্চমানের গবেষক আর গবেষণাগার কোথায় পাব আমরা? কোন ক্ষেত্রগুলোতে আমরা সম্পদ বরাদ্দ করব? কিভাবে আমরা এই ধরনের একটি বড় উদ্যোগ পরিচালনা করব? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতে চেনা ছকের বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞানী, গবেষক এবং ব্যবস্থাপকদের মাঝে আলোচনা প্রয়োজন; প্রচার মাধমে, সংসদে আর পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি প্রয়োজন; সারা পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দেশ কোন বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিচ্ছে, তার সাথে আমাদের দেশের কোন সমস্যাগুলো সবচয়ে জরুরি, সেগুলো সনাক্ত করা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের কৃতবিদ্য প্রবাসীদের সহায়তা এক্ষেত্রে সুচারুভাবে কাজে লাগাচ্ছে। জাতিসঙ্গের প্রবাসী নাগরিকদের মাধ্যমে জ্ঞান হস্তান্তরের একটি প্রোগ্রামও (TOKTEN) আছে।

গবেষণা বিষয়ক দির্ঘমিয়াদী পরিকল্পনা, রুপায়ণের পন্থা আর ক্ষেত্রগুলো সনাক্ত করতে অনেক দেশের প্রশাসন যোগ্য প্রবাসীদের প্রবাসীদের নিজ দেশে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন দুহাত বাড়িয়ে। চীনা নেতারা আধুনিকীকরণ প্রকল্পের জাতীয় নীতিতে সম্প্রতি এক মাইলফলক ঘটনা যুক্ত করেছেন (Thousand Talents Program)। এটা হলো এক হাজার প্রতিভাবান গবেষককে দেশে নিয়ে আসার প্রকল্প। এই কার্যক্রম চীন অথবা যেকোনো পটভূমির গবেষকদের জন্য উম্মুক্ত। প্রতিটি গবেষককে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনাগার খোলার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই – চীনের গবেষনার মান দ্রুতগতিতে পশ্চিমের পর্যায়ে নিয়ে আশা। ভারত গত তিন দশক ধরে প্রবাসী কর্মদক্ষ জনশক্তি আর বিশেষজ্ঞদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং বাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। ভারতের এক বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠী দেশে ফেরত গিয়েছেন বিত্ত, শিক্ষা, গভীর বিজ্ঞান, প্রযুক্তির আর ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা নিয়ে। মাহাথিরের শাসনামলে তিনি নিজে টেলিফোন করে অনেক যোগ্য প্রবাসীদের মালয়েশিয়ায় ফেরৎ নিয়ে এসেছেন।

প্রতিটি প্রবাসী সব সময়ই নিজের দেশে মাটিতে ফিরে আসার, দেশের ঋণ শোধ করার জন্যে সুযোগ খুঁজে, সে যে দেশেরই হোক না কেন। বেশিরভাগ বাংলাদেশীই পৃথিবীর অন্য জাতির তুলনায় দেশকে নিয়ে বেশি ভাবেন, সবসময়ই কিছু করতে চান। তাদের শক্তি আর মেধাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন যুক্তিসঙ্গত পথনির্দেশনা, সুযোগ্য নেতৃত্ব আর পরিকল্পনা। আমাদের দেশের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বাইরে পিএইচ-ডি করতে যায়। এদের অনেকে এত উৎসাহী, এত সৃজনশীল, এত প্রতিভাবান যে তাদের একটা ছোট অংশও যদি দেশে ফিরে আসত তাহলে দেশে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে যেত। যারা আজ পিএইচডি করতে কোরিয়া, মালেশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত এবং অন্যান্য দেশে যাচ্ছেন, তারা এদেশে বসেই, এদেশের সমস্যার উপরে পিএইচডি করেতে পারতেন, যদি আমরা গবেষনাযন্ত্রটিকে সচল রাখতে পারতাম। এক সময় এশিয়ার অনেক দেশ থেকে আমদের দেশে ছাত্ররা আসত পড়াশোনা করতে। আজ আমরা অন্যদের তুলনায় একটি বিপরীত প্রবণতা অনুসরণ করছি।

রাজনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ আর বিজ্ঞানীরা গবেষণানির্ভর অর্থনীতি ভিত্তিপত্তনে উদ্যোক্তা আর অগ্রদূতের ভুমিকা পালন করেন সফল সমাজে। এর বাইরে আর কাদের অংশ গ্রহনের দায়িত্ব এবং ভূমিকা আছে? গার্মেন্টসের নারীরা, প্রবাসী শ্রমজীবী এবং কৃষকরা দেশকে দিয়েছেন উজাড় করে। নিম্নবিত্তের এই তিন পেশার মানুষদের এর চেয়ে বেশী দেশকে দেবার মত কিছু নেই। মূলত জীবন যুদ্ধে তারা এত বেশী প্রলিপ্ত যে তাদের সময় নেই ভালো খারাপ বিবেচনার – সেটা রাজনীতি হোক, প্রযুক্তিনীতি হোক, অর্থনীতি অথবা সমাজনীতি হোক।

যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আমদের দেশে এক শক্তিশালী অর্থনীতি এবং সুস্থ্য রাজনীতির জন্ম দিতে পারতো, সেটার একটা বড় অংশ সবসময় সুযোগ খুজছে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায়, কানাডায় আর আমেরিকায় চলে যাবার জন্য। তাদের হাতে আমরা প্রয়োজনীয় উন্নয়নের হাতিয়ার, আধুনিক প্রশিক্ষণ অথবা অনুদান দিতে পারছি না। শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব মেধাবী শিক্ষকরা, প্রভাষকরা আর প্রবল কর্মশক্তিপূর্ণ তরুণ তরুনীরা দেশের গবেষনাগারে আগামী দিনের বাংলাদেশের প্রতিচিত্র তৈরী করতে পারত, রাষ্ট্রীয় ক্ষুদ্র ব্যবসা-অনুদান নিয়ে জগৎবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি গড়তে পারত, তারা হয়ত শুধু জীবিকা সংগ্রহের জন্য অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অসহনীয় ট্রাফিকে দিনাতিপাত করে অথবা কনসালট্যান্ট হিসেবে নিজেদের মেধার অনাকাংখিত অপচয়ে লিপ্ত হচ্ছেন। গবেষণাই এদের জীবিকার প্রধান উৎস হতে পারত। তাতে তাদের সৃজনশীলতা আর প্রতিভা দেশকে শতগুনে আলোকিত করতে পারত, অর্থনীতিতে লক্ষ-কোটিগুনে প্রভাব ফেলতে পারত।

দেশ নিয়ে হতাশা আর পথনির্দেশনার অভাবে একসময় বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, ইরান আর ইন্দোনেশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠি বৈধ-অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ব্যাপক হারে। আজ এসব দেশের বেশিরভাগ তরুনরাই নিজের দেশে ফিরে আসার সুযোগ আর অনুকূল পরিবেশ দেখতে পাচ্ছে -আমরা ছাড়া। আমি ছাত্রাবস্থায় দেখেছি – অবৈধভাবে যাওয়ার পথে আমাদের দেশী যুবকেরা গ্রীক-তুর্কী সীমান্তে বরফ-ঢাকা নদীতে জীবন হারাচ্ছেন, পুলিশের আতঙ্কে অপরিচিত বিদেশী বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে পশুদের আক্রমনের শিকার হচ্ছেন। এস্বত্বেও যারা কোনোভাবে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছেন, বছরের পর বছর অবৈধভাবে পরদেশে মানবেতরভাবে নিজেদের শ্রম সস্তায় বিক্রি করছেন। এদের অনেকেই উচ্চ-শিক্ষিত এবং পরিশ্রমী সুনাগরিক হতে পারতেন। গবেষনা ভিত্তিক অর্থনীতিতে এরাই হতেন কারিগর, নির্মাতা, কারখানার শ্রমিক, বহুজাতিক কোম্পানির কর্মচারী।

মধ্য বয়সে দেশ ছেড়ে অনেকে শিক্ষিত বাংলাদেশী নিজেকে বিদেশের মাটিতে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হযেছেন। এ ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা মাথায় থাকা সত্বেও অনেকে দেশ ছাড়েন তাদের এবং সন্তানদের ভবিষৎ চিন্তা করে। অথচ একবিংশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে ঠিক তার উল্টো প্রবণতা প্রতীয়মান। আমরা যদি আমাদের জনশক্তির উন্নয়ন আর সদ্ব্যবহার নিয়ে উদাসীন থাকি, আজকের ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ আমাদের সবচেয়ে যোগ্য মানুষগুলোকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক দেশই আগ্রহ দেখাবে। যেভাবে অস্ট্রেলিয়া আর কানাডা এই সুযোগ নিচ্ছে এখন।আমরা তার বিপরীত প্রবণতাও সৃষ্টি করতে পারি। মাহাথিরের শাসনামলে নিজে টেলিফোন করে যোগ্য প্রবাসীদের মালয়েশিয়ায় ফেরৎ নিয়ে আসার যে প্রবণতা তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, আজকের অর্থনৈতিক উন্নতি তারই ধারাবাহিকতার ফল।

আমাদের দেশের সবচেয়ে যোগ্যতাবান আর ভাগ্যবানরা নিজের ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যারা থেকে যাচ্ছেন তারাও অসুস্থ্য রাজনীতির যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে বেচে থাকার সংগ্রামে জীবনপাত করে চলেছেন। খুব অল্প সংখ্যক প্রবাসীই আজ দেশে ফিরে আসেন। অনেকেই এসে বছর না পুরুতেই আবার ফিরে যাচ্ছেন প্রবাসে । এই একমুখী জনশক্তির প্রবাহের কারণে আমাদের দেশ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, এক দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সমাজে গবেষণার প্রসার এ বিনাশী প্রবণতাকে থামিয়ে দিতে পারে।

চার চাকার একটা গাড়ি যদি আমরা তৈরী করতেও পারি, সেই গাড়ির চালক অসহায় বোধ করবে যদি গাড়িটিতে তেল, পানি, লুব্রিক্যান্ট, ইত্যাদি পরিমিত পরিমানে সরবরাহ না করা হয়। গাড়িটিতে যদি একটি রাজনৈতিক দলের নাম লেখা থাকে তবে অন্য দলগুলো সুযোগ পেলেই সেটাকে বিকল করে দেবে, জানালা দরজা ভেঙ্গে দেবে, সেটার গায়ে আগুন ছুড়ে মারবে – যা আমাদের দেশে গত তিন দশক ধরে আমরা দেখেছি। রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট একজন চালকের কার্যক্রম ক্ষমতাসীন দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য হয়ত সুবিধাজনক বা সমর্থনসূচক হবে, দেশের জন্য হিতকর নাও হতে পারে । একবার তাদের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তাদের সমস্ত ভালো কাজের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেকারণে দরকার একটি দল-নিরপেক্ষ জাতীয় নীতি, যাতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে, যা রাজনীতিবিদরা হীন স্বার্থের জন্য অপব্যবহার করবে না। এটি একটি জটিল সমস্যা কিন্তু এর সমাধান অনেক দেশই সফলভাবে করেছে।

আজকের প্রজন্ম আর আমাদের শিক্ষিত সমাজ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত নয়। তারা জানে তাদের উচ্চতর ডিগ্রী, মজবুত পড়াশোনার ভিত্তি আর অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবার মত কাজ এদেশে খুব নগণ্য সংখ্যকই আছে। বর্তমান অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিগুলো অর্থাৎ গার্মেন্টস, বিদেশে শ্রমের বাজার এবং কৃষিকাজ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে না। বেশিরভাগ দেশে উন্নয়নের সাথে সাথে সামগ্রিকভাবে এই খাতগুলোর ভুমিকা ক্রমাগত কমে এসেছে। তার জায়গায় প্রযুক্তি নির্ভর, মেধা সম্পত্তি এবং প্রশিক্ষণ ভিত্তিক বেশি আয়ের কাজের পরিমান বেড়েছে।

অবশিষ্ট অংশের জন্য ক্লিক করুন:

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষণায় হাতে খড়ি

Sci-Hub – এর বিকল্প প্ল্যাটফর্ম

Sci-Hub ব্যবহার না করেই বিনামূল্যে গবেষণাপত্র খুঁজছেন? বিনামূল্যে একাডেমিক বিষয়বস্তু অ্যাক্সেস করার...

গবেষণায় হাতে খড়ি

গবেষণায় Citation কাকে বলে?

গবেষণায় উদ্ধৃতি বলতে কী বোঝায়, কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ, কীভাবে এর অপব্যবহার হতে...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

বাংলাদেশী ব্যাচেলর, মাস্টার্স বা পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য তাইওয়ানে স্কলারশিপসহ ইন্টার্নশিপের সুযোগ!

বাংলাদেশি সহ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য তাইওয়ানে আকর্ষণীয় সম্পূর্ণ অর্থায়িত ইন্টার্নশিপের সুযোগ। মাসিক...

গবেষণায় হাতে খড়িবই আলোচনা

বিজ্ঞানী হতে চাইলে যে বইটি পড়তে হবে? (প্রথম পর্ব)

কার্ল সাগানের "দ্য ডেমন-হন্টেড ওয়ার্ল্ড" কেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিজ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই পড়া উচিত...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

অভাবের মধ্যেও সম্ভব বিদেশে উচ্চশিক্ষা জেনে নিন কীভাবে

বিদেশে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখছেন কিন্তু অর্থের জন্য চিন্তিত? বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.