গবেষণায় হাতে খড়িপদার্থবিদ্যা

বই অধ্যায়ের মতো একটি অনুসন্ধানমূলক বাংলা প্রবন্ধপরমাণুর স্মৃতি: এক নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের রোমাঞ্চকর যাত্রা

Share
Share

২০২৫ সালের এক সন্ধ্যায়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ল্যাবরেটরিতে একদল গবেষক একটি অদ্ভুত ফলাফল দেখে থমকে যান। পরীক্ষার টেবিলে বসে থাকা অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম আর ড. আন্দ্রেই পোলেতায়েভ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, যেন তাঁদের চোখের সামনে ঘটছে বিজ্ঞানের ইতিহাসের নতুন একটি অধ্যায়। তাঁরা এমন একটি ঘটনা দেখতে পাচ্ছিলেন যা এতদিন কল্পনাতেও ছিল না—আয়নিত পরমাণুগুলো যেন স্মৃতি ধারণ করতে পারছে।

আমরা জানি, জল ঢাললে তা নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে, বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তারের ভেতর দিয়ে, আর ব্যাটারি চার্জ হলে আয়ন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যায়। এসব ঘটনা আমাদের কাছে প্রাত্যহিক এবং সহজবোধ্য। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানতেন না—এই গতির পেছনে, আণবিক পরিসরে, কোনো ‘স্মৃতিচিহ্ন’ থাকে কিনা।

সেই সন্ধ্যায় তাঁরা যা আবিষ্কার করলেন, তা শুধু একটি তাত্ত্বিক প্রশ্নের উত্তর নয়, বরং পদার্থবিজ্ঞানের গোড়ার ধ্যানধারণাকেই চ্যালেঞ্জ জানাল। আয়নদের চলাচল নিছক একটি এলোমেলো ঘটনা নয়, বরং এতে একটি ‘স্মৃতি’ কাজ করে—একটি অদৃশ্য ইতিহাস, যেটি প্রভাব ফেলে তাদের ভবিষ্যৎ গতির ওপর।

‘স্মৃতি’ মানে কী?
এই প্রশ্নে যদি আপনি মানব মস্তিষ্কের কথা ভাবেন, তাহলে আপনাকে একটু দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বিজ্ঞানীরা এখানে যে ‘স্মৃতি’ শব্দটি ব্যবহার করছেন, তা মানসিক স্মৃতি নয়। বরং এটি হলো পদার্থের গঠনে থাকা এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা বলে দেয়—একটি আয়ন ঠিক আগে কোথায় ছিল বা কী করেছে, এবং সেই অতীত অভিজ্ঞতা পরবর্তী আচরণে প্রভাব ফেলছে।

এটি বোঝাতে আমরা একটি রূপক ব্যবহার করতে পারি: ধরুন, আপনি এক কাঁচের পাত্রে মধু রাখলেন এবং হঠাৎ সেটিকে ঝাঁকুনি দিলেন। মধু একদিকে ছিটকে গিয়ে আবার আস্তে আস্তে বিপরীত দিকে ফিরে আসে। এই ফিরে আসার সময় তার পূর্বের গতির একটি ছাপ রয়ে যায়। আয়নের গতিতেও এমন এক ধরণের ফিরে আসার প্রবণতা আছে, যা বলে দেয়—সে কোথা থেকে এসেছে।

এই গবেষণার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
ইলেকট্রনিক পরিবাহিতা (electron conduction) বা তাপ পরিবাহিতা (thermal conduction) নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে গবেষণা হলেও, আয়নিক পরিবাহিতা (ionic conduction) বা আয়নের গতি নিয়ে এত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ছিল বিরল। ব্যাটারি প্রযুক্তি, জ্বালানি কোষ, এমনকি ভবিষ্যতের নিউরোমরফিক কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে আয়নের গতি জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের Department of Materials এবং SLAC National Accelerator Laboratory-এর গবেষকেরা এই প্রেক্ষাপটেই একটি মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন—“আয়নের গতিতে কি অতীতের কোনো প্রভাব পড়ে?” উত্তর পেতে তাঁরা ব্যবহার করেন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত সময়ের পরিমাপক প্রযুক্তি—pump-probe spectroscopy।

কীভাবে কাজ করে এই প্রযুক্তি?
এই গবেষণায় গবেষকেরা একটি ব্যাটারির ক্যাথোড উপাদান ব্যবহার করেন, যেখানে আয়নরা একদিক থেকে অন্যদিকে গমন করে চার্জ পরিবহণ ঘটায়। তাঁরা একটি আলোক-স্পন্দন (light pulse) ব্যবহার করে আয়নদের আচরণে একটি ব্যাঘাত ঘটান—যেন এক পুকুরে পাথর ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। তারপর পরবর্তী আলোর সাহায্যে পরিমাপ করা হয়, আয়নরা সেই ব্যাঘাতের প্রতিক্রিয়ায় কীভাবে আচরণ করছে।

ফলাফল অভাবনীয়—যখন আয়নদের একদিকে ঠেলা দেওয়া হয়, তখন তারা কিছু সময় পরে উল্টো দিকে ফিরে যেতে থাকে। এটা সরলভাবে বোঝায়—তারা আগের অবস্থার একটি স্মৃতি ধরে রেখেছে।

বিশ্বব্যাপী গবেষণার গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া
এই গবেষণাটি ২০২৫ সালের জুলাইয়ে Nature জার্নালে প্রকাশিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক মহলে সাড়া ফেলে। গবেষণার প্রধান অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম (University of Oxford) এবং প্রধান লেখক ড. পোলেতায়েভ জানান, এই স্মৃতির প্রভাব কয়েক ট্রিলিয়ন ভাগের এক সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী হলেও, এটি পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছে বলেই আগামী দিনে আরও সূক্ষ্ম গবেষণার সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছে।

SLAC ল্যাবের ম্যাথিয়াস হফম্যানের নেতৃত্বে তৈরি করা হয়েছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল লেজার সেটআপ, যার সাহায্যে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে পারমাণবিক গতি ধরা সম্ভব হয়।

এর প্রভাব কোথায় কোথায় পড়বে?
এই আবিষ্কারের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—আমরা এতদিন ধরে যা ভেবেছি, তা পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরা সাধারণভাবে মনে করি, যে কোনো তরল বা গ্যাসের প্রবাহ একটি এলোমেলো ঘটনা, কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছাড়াই চলে। কিন্তু এই গবেষণা বলছে, আণবিক পর্যায়ে ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ—গত মুহূর্তের অভিজ্ঞতা পরবর্তী গতি নির্ধারণে সাহায্য করে।

এর ফলে নতুন প্রজন্মের ব্যাটারির উপাদান তৈরি সহজ হবে। কেবল তাই নয়, পানি বিশুদ্ধকরণ (desalination), জৈবপ্রযুক্তি, এমনকি মস্তিষ্ক-অনুকরণ করে তৈরি কম্পিউটার (neuromorphic computing)-এর ক্ষেত্রেও এই স্মৃতিপ্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিতর্ক ও প্রশ্ন
তবে এই গবেষণা কিছু প্রশ্নও তুলে দিয়েছে। যেমন—যদি পারমাণবিক গতি স্মৃতি নির্ভর হয়, তবে আমাদের দৈনন্দিন পরিবাহিত প্রযুক্তিগুলোর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন কি না?
এছাড়া, পরমাণুর এই স্মৃতির ব্যবহার নৈতিক দিক থেকেও প্রশ্ন তুলতে পারে, বিশেষ করে ভবিষ্যতের কৃত্রিম নিউরোনিক যন্ত্রে যদি আয়নের এই স্মৃতিপ্রবণতা ব্যবহৃত হয়।

ভবিষ্যতের দিগন্ত
পরবর্তী ধাপে গবেষকরা আরও সংবেদনশীল যন্ত্রের মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ের জন্য এই স্মৃতি প্রভাব পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করবেন। এর মাধ্যমে পরমাণুর আচরণ বুঝে ভবিষ্যতের উপাদান ডিজাইন করা সহজ হবে।
তবে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এক নতুন ধরণের গণনা-পদ্ধতি বা কম্পিউটিং-এ, যেখানে স্মৃতি নির্ভর পারমাণবিক চলাচল ব্যবহার করে ভবিষ্যতের ‘মেমরি-ভিত্তিক’ সুপারকম্পিউটার তৈরি করা যেতে পারে।

আমরা যখন আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিকে সবকিছুর উৎস ভাবি, তখন আয়নদের এই ক্ষণিক স্মৃতিও আমাদের শেখায়—জগতের প্রতিটি কণারও আছে ইতিহাস, আছে প্রতিক্রিয়া, আর আছে ভবিষ্যৎ গঠনের সম্ভাবনা।

তথ্যসূত্র

  • Islam, S., Poletayev, A. et al. (2025). The persistence of memory in ionic conduction probed by nonlinear optics. Nature.
  • University of Oxford, Department of Materials.
  • SLAC National Accelerator Laboratory, USA.

এই প্রবন্ধটি বাংলাদেশের তরুণ গবেষক, বিজ্ঞান-অনুরাগী এবং ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণার জন্য উৎসর্গ করা হলো।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষণায় হাতে খড়ি

কী নিয়ে পড়বো? বুঝতে পারছি না

একজন শিক্ষার্থীর চাপ, বিভ্রান্তি এবং প্রত্যাশার সাথে লড়াই এবং অবশেষে কীভাবে সে...

পদার্থবিদ্যাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বলের রহস্য উদঘাটনের নতুন যুগ

বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী পারমাণবিক বলের দীর্ঘস্থায়ী রহস্য উন্মোচন করেছেন, কীভাবে কোয়ার্ক এবং গ্লুয়ন...

গবেষণায় হাতে খড়ি

AI দিয়ে লেখা কি বৈজ্ঞানিক চুরি?

একাডেমিক লেখালেখিতে AI ব্যবহার কি চুরি? নীতিশাস্ত্র, বাস্তবতা এবং একাডেমিক অসদাচরণের শিকার...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশের জন্য উপযুক্ত জার্নাল কীভাবে নির্বাচন করবেন?

আপনার গবেষণা প্রবন্ধের জন্য সঠিক জার্নাল কীভাবে নির্বাচন করবেন তা শিখুন। এই...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

কীভাবে হাই কোয়ালিটি জার্নালে গবেষণাপত্র পাবলিশ করবেন?

বিশ্বখ্যাত জার্নাল সম্পাদকদের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞ টিপস এবং বিনামূল্যে অনলাইন কোর্সগুলি আবিষ্কার...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org