চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আলঝেইমার: মস্তিষ্ক নয়, প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিকৃতি

Share
Share

বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ আজ আলঝেইমার রোগের সঙ্গে লড়ছে। এই রোগ স্মৃতিভ্রংশ, চিন্তা-শক্তির অবনতি, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন এবং ধীরে ধীরে আত্মপরিচয়ের বিলোপ ঘটায়। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, আলঝেইমারের প্রধান কারণ মস্তিষ্কে একধরনের “বেটা-অ্যামাইলয়েড” প্রোটিনের অস্বাভাবিক জমাট বাঁধা। কিন্তু কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ডোনাল্ড উইভার ও তাঁর সহকর্মীদের সাম্প্রতিক এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা এই ধারণাকে পুরোপুরি নতুন করে দেখার আহ্বান জানিয়েছে।

গবেষকদের মতে, আলঝেইমার কোনো “শুধু মস্তিষ্কের রোগ” নয়—এটি মূলত এক অটোইমিউন ব্যাধি। অর্থাৎ, আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমই যখন নিজের কোষ ও টিস্যুকে ভুলবশত আক্রমণ করে বসে, তখনই এই রোগের সূত্রপাত হয়।

বেটা-অ্যামাইলয়েড: শত্রু নয়, রক্ষাকবচ

গত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, আলঝেইমারের মূল দোষী এই বেটা-অ্যামাইলয়েড প্রোটিন, যা মস্তিষ্কে অস্বাভাবিকভাবে জমা হয়ে নিউরনের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। তাই ওষুধ ও চিকিৎসার মূল লক্ষ্য ছিল—এই প্রোটিন দূর করা বা এর গঠন ঠেকানো।

কিন্তু ড. উইভার-এর গবেষণা বলছে, বেটা-অ্যামাইলয়েড মোটেই কোনো “অস্বাভাবিক” পদার্থ নয়। বরং এটি মস্তিষ্কের ইমিউন প্রতিরক্ষারই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যখন মস্তিষ্ক কোনো সংক্রমণ বা আঘাতের মুখোমুখি হয়, তখন বেটা-অ্যামাইলয়েড তৎপর হয়ে ওঠে—ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে।

সমস্যা ঘটে তখনই, যখন এই প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কিছু ব্যাকটেরিয়ার গঠনগত বৈশিষ্ট্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সঙ্গে অনেকটা মিল থাকার কারণে, বেটা-অ্যামাইলয়েড ভুল করে মস্তিষ্কের নিজস্ব কোষকেই “শত্রু” হিসেবে চিনে ফেলে। এর ফল—ধীরে ধীরে নিজের মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে এক বিধ্বংসী অটোইমিউন আক্রমণ শুরু হয়।

তিন দশকের গবেষণায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

ড. উইভার ও তাঁর দল গত প্রায় ৩০ বছর ধরে আলঝেইমারের প্রকৃতি, প্রোটিন গঠন এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থার আচরণ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়—বেটা-অ্যামাইলয়েডের রসায়নিক গঠন ও কার্যপ্রণালী এমন যে, এটি স্বাভাবিক অবস্থায় সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে সক্রিয় হলে মস্তিষ্কের নিজস্ব টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলঝেইমারকে দেখা মানে রোগটিকে সম্পূর্ণ নতুন আলোয় বিশ্লেষণ করা। যেখানে এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা “অস্বাভাবিক প্রোটিন জমাট” ভাঙার চেষ্টা করছিলেন, সেখানে এখন তাঁরা ভাবছেন কীভাবে ইমিউন সিস্টেমকে ভারসাম্যে রাখা যায়—যাতে এটি ভুল করে নিজেকে আক্রমণ না করে।

আলঝেইমার: নতুন শ্রেণিবিন্যাসের পথে

এই নতুন ধারণা অনুযায়ী, আলঝেইমার এখন অন্যান্য অটোইমিউন রোগের সঙ্গেও এক সারিতে আসে—যেমন লুপাস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (MS) বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। এইসব রোগেও শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজ কোষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

এই তুলনাটি শুধু তাত্ত্বিক নয়; চিকিৎসাবিজ্ঞানের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যদি আলঝেইমার আসলেই এক অটোইমিউন ব্যাধি হয়, তাহলে এর চিকিৎসা পদ্ধতিও হতে হবে ইমিউন নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রিক—যেমনটি অন্যান্য অটোইমিউন রোগে করা হয়।

নতুন চিকিৎসা ভাবনার সূচনা

দীর্ঘদিন ধরে আলঝেইমার নিরাময়ের লক্ষ্যে অসংখ্য ওষুধ পরীক্ষা করা হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই বেটা-অ্যামাইলয়েড অপসারণ বা এর উৎপাদন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তৈরি। কিন্তু বাস্তবে এই ওষুধগুলো খুব একটা কার্যকর প্রমাণিত হয়নি।

এখন গবেষকরা বলছেন, সমস্যাটি বেটা-অ্যামাইলয়েডের উপস্থিতিতে নয়, বরং ইমিউন সিস্টেমের ভুল প্রতিক্রিয়ায়। তাই ভবিষ্যতের ওষুধগুলো হয়তো এমনভাবে তৈরি হবে, যা মস্তিষ্কের ইমিউন কার্যক্রমকে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখবে—যাতে প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকে, কিন্তু নিজের নিউরনকে ক্ষতি না করে।

এই ধরনের চিকিৎসা কৌশল যদি সফল হয়, তবে আলঝেইমারের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে ইমিউন ভারসাম্য ফিরিয়ে আনলে হয়তো স্মৃতি হ্রাসের গতি অনেকটাই ধীর করা যাবে।

কেন এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ

আলঝেইমার বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে, ফলে ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

এই নতুন গবেষণা আমাদের সামনে অন্তত তিনটি বড় সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে—

  1. রোগ বোঝার নতুন কাঠামো: এখন আলঝেইমারকে শুধু স্মৃতি বা নিউরনের রোগ নয়, বরং এক প্রতিরোধ ব্যবস্থা-নিয়ন্ত্রিত জৈবিক ব্যাধি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
  2. চিকিৎসার নতুন দিক: বেটা-অ্যামাইলয়েড অপসারণ নয়, বরং ইমিউন ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে চিকিৎসার লক্ষ্য।
  3. প্রতিরোধের সম্ভাবনা: যদি জানা যায় কোন উপাদান বা সংক্রমণ এই অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ার সূচনা করে, তবে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতে পারে।

বিজ্ঞান সমাজে প্রতিক্রিয়া

যদিও এই ধারণা বিপ্লবাত্মক, সব বিজ্ঞানী এখনও একমত নন। অনেকেই বলছেন, বেটা-অ্যামাইলয়েড তত্ত্ব পুরোপুরি ভুল নয়—এটি এখনও রোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে ড. উইভার-এর কাজ নিঃসন্দেহে আলোচনায় নতুন প্রাণ জুগিয়েছে।

বিখ্যাত নিউরোলজিস্টদের মতে, “এটি এমন এক তত্ত্ব যা বহুদিনের অচলাবস্থা ভাঙতে পারে।” গত কয়েক দশকে যত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্যর্থ হয়েছে, তার পেছনে হয়তো ভুল লক্ষ্য নির্ধারণই ছিল মূল কারণ। যদি সত্যিই আলঝেইমার এক অটোইমিউন বিকৃতি হয়, তাহলে চিকিৎসার পথও সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি করতে হবে।

সাধারণ পাঠকের জন্য: অটোইমিউন রোগ কী?

আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা মূলত বাইরের শত্রুদের—যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী—আক্রমণ করে শরীরকে রক্ষা করে। কিন্তু কোনো কারণে যদি এই সিস্টেম নিজ কোষকেই “শত্রু” মনে করে, তখন সেটিকে বলে অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া।

এর ফলে শরীর নিজের টিস্যু ধ্বংস করতে শুরু করে—যেমন টাইপ-১ ডায়াবেটিসে প্যানক্রিয়াসের কোষ, লুপাসে ত্বক ও জয়েন্ট, আর মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসে মস্তিষ্ক ও স্নায়ু। এখন মনে করা হচ্ছে, আলঝেইমারেও একই রকম প্রতিরোধ বিভ্রাট ঘটে

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য

বাংলাদেশে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৫৬ লাখ (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)। এর সঙ্গে সঙ্গে ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারের ঝুঁকিও বাড়ছে।

তবে এখন পর্যন্ত দেশে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব সীমিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলঝেইমার ধরা পড়ে অনেক দেরিতে, যখন রোগী ইতিমধ্যেই দৈনন্দিন কাজকর্মে অক্ষম।

যদি এই নতুন গবেষণার ভিত্তিতে ইমিউন নিয়ন্ত্রণমূলক চিকিৎসা বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়, তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও এটি এক বিশাল আশীর্বাদ হতে পারে।

ভবিষ্যৎ গবেষণার দিক

গবেষকরা এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন—কীভাবে বেটা-অ্যামাইলয়েড মস্তিষ্কে স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা চালায়, কোন মুহূর্তে সেটি বিভ্রান্ত হয়ে নিজের নিউরন আক্রমণ শুরু করে, এবং কোন জিন বা পরিবেশগত উপাদান এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।

এছাড়াও, মাইক্রোবায়োম—অর্থাৎ আমাদের অন্ত্রের জীবাণুসমূহের ভারসাম্য—এই প্রক্রিয়ায় কোনো ভূমিকা রাখে কি না, তা নিয়েও চলছে গবেষণা। কারণ, শরীরের ইমিউন সিস্টেমের ওপর অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।

এক নতুন আশা

ড. উইভার-এর কথায়, “আমরা এতদিন ধরে আলঝেইমারকে ভুলভাবে দেখেছি। এখন আমরা জানছি, এটি মস্তিষ্কের ভেতরে ইমিউন সিস্টেমের বিভ্রাটের ফল। সেই বোঝাপড়া থেকেই নতুন চিকিৎসা ও প্রতিরোধের দিগন্ত খুলে যাচ্ছে।”

আলঝেইমার দীর্ঘদিন ধরে ছিল এক অনুধাবন-অযোগ্য রহস্য। প্রতিটি ব্যর্থ ওষুধ, প্রতিটি ব্যর্থ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এই রোগকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। কিন্তু যদি এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতের প্রজন্ম একদিন বলতে পারবে—আলঝেইমার আর অজেয় নয়।

উপসংহার

আলঝেইমারকে শুধু স্মৃতিভ্রংশের রোগ হিসেবে না দেখে, এক অটোইমিউন বিকৃতি হিসেবে দেখা মানেই বিজ্ঞানকে এক নতুন পথে যাত্রা করানো। এই তত্ত্ব এখনো প্রমাণের অপেক্ষায়, কিন্তু এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারণাগত কাঠামো পাল্টে দিতে পারে।

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য এটি এক আলোর ঝলকানি—যেখানে মস্তিষ্কের কোষকে ধ্বংস করা নয়, বরং রক্ষা করাই চিকিৎসার মূল দর্শন হতে পারে।

সূত্র:
ডোনাল্ড উইভার, অধ্যাপক (রসায়ন), পরিচালক – ক্রেমবিল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্ক, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত: The Conversation

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org