গণিতবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

আল-খোয়ারিজমি: বিজ্ঞান জগতের কালজয়ী পথিকৃৎ

Share
Share

ভোরের আলো ছড়াতে শুরু করেছে, আর সঙ্গে সঙ্গেই পুরোনো ইতিহাসের পাতার শব্দ গুঞ্জরিত হয়ে উঠছে আরেকবার। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে, বাগদাদের এক পাঠশালায় সদ্য গড়ে ওঠা আলাপচারিতায় ভেসে আসছিল গণিতের নানান জটিল সূত্রের কথা। একজন তরুণ শিক্ষার্থী তখন বিস্মিত চোখে আর শিহরণে শুনছে কেমন করে সংখ্যার রাজ্যে বিরাট পরিবর্তন এনেছিলেন এক কিংবদন্তি বিজ্ঞানী—আল-মুয়াম্মদ ইবন মুসা আল-খোয়ারিজমি। তাঁর নাম উচ্চারিত হলেই অনেকের মনে আলোড়ন তুলে প্রশ্ন জাগে: কে ছিলেন তিনি, আর কী তাঁর অবদান?

গল্পের শুরু হয় নবম শতকে, যখন মুসলিম স্বর্ণযুগের চূড়ান্ত বিকাশ চলছে।

বাগদাদ ছিল সেই সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থস্থান। মহান আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ‘বায়তুল হিকমা’ (জ্ঞানালয়) ছিল তৎকালীন বিশ্বের সেরা গবেষণা কেন্দ্র। ঠিক সেখানেই আল-খোয়ারিজমি তাঁর বৈপ্লবিক গবেষণার মূল সূত্রপাত করেন। এই জ্ঞানপিপাসু মনীষী শুধু গণিতের গাণিতিক হিসাব কিংবা বিজ্ঞান গবেষণাতেই থেমে থাকেননি; জ্যোতির্বিজ্ঞান, মানচিত্র নির্মাণ থেকে শুরু করে কালানুশাসন—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টান্তমূলক অবদান রয়ে গেছে।

“আল-খোয়ারিজমির অবদানকে ছোট করে দেখা কখনও উচিত নয়,”
বলছিলেন গণিতের বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. কাজী রাশেদুল হক। ঢাকার এক সেমিনারে তিনি মন্তব্য করেন, “আল-খোয়ারিজমি আমাদেরকে শিখিয়েছেন কীভাবে শূন্যের সঠিক ব্যবহার করতে হয়। তিনি যখন তাঁর ‘কিতাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা’ রচনা করেন, তখন বুঝতে পারি গণিতের জগতে এটা কতখানি বড় সাম্রাজ্য বিস্তার করবে।”

গণিতের ওপর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ
“কিতাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা” (Al-Jabr wa’l Muqabala) অসংখ্য গণিতবিদের কাছে মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকেই ‘Algebra’ শব্দটির উৎপত্তি, যা সারা বিশ্বের অগণিত শিক্ষার্থী ও গবেষক আজও কাজে লাগাচ্ছেন। শূন্যের ভূমিকা, গাণিতিক সমীকরণের বীজগণিতীয় ব্যাখ্যা—এসব উন্নত ধারণার মূল বীজ আল-খোয়ারিজমির হাত ধরেই বিশ্বব্যাপী রোপিত হয়েছিল।

কেবল গণিতের আধুনিক ভিত্তি নির্মাণ নয়,
আল-খোয়ারিজমি জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল ও মানচিত্রকরণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি গ্রিক, ভারতীয় ও পারস্য বৈজ্ঞানিক গ্রন্থগুলো একত্র করে সেগুলোকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং নিজস্ব বিশ্লেষণ যুক্ত করেন। তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর লেখা গ্রন্থ ‘জিজ আল-সিন্ধ হিন্দ’ (zij al-Sindhind) জ্যোতিষ্কের মানচিত্র, সূর্য ও চন্দ্রের গতিবিধির নিখুঁত হিসাব এবং নামমাত্র যন্ত্রাংশ দিয়ে ক্যালেন্ডার গণনা পদ্ধতি দেখিয়ে দেয়। এগুলোর অনেক কিছুই পরে ইউরোপের মহাবিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছিল।

ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষক রিমি সুলতানা বলেন,
“আমি যখনই শূন্যের ব্যবহার আর আলজেবরা নিয়ে পড়ি, তখনই আল-খোয়ারিজমির অবদান আমাকে অভিভূত করে। তিনি গণনার পদ্ধতিগুলোকে এমনভাবে সংহত করেছেন, যা আজকের কম্পিউটার অ্যালগরিদম উন্নয়নেও ব্যবহৃত হচ্ছে।”
এখান থেকেই ‘Algorithm’ বা অ্যালগরিদম শব্দের উদ্ভব ঘটে, যা আল-খোয়ারিজমির নামের লাতিন রূপ ‘Algorithmus’ থেকে এসেছে। আধুনিক কম্পিউটার সায়েন্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনেও তাই পরোক্ষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এই অসামান্য মনীষী।

“যে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর তৈরি হয়েছিল বাগদাদে,
সেখানে আল-খোয়ারিজমি তাঁর গবেষণাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যান,” বলেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানীয় অধ্যাপক ড. রিচার্ড ফ্রান্সিস (অনুবাদক সূত্রে বক্তব্য গ্রথিত)। “একজন বিজ্ঞানী যখন তার আগের জ্ঞানের ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন জ্ঞান সৃজন করেন, তখনই সভ্যতা এগিয়ে যায়। আল-খোয়ারিজমির কাজ ছিল এমনই একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।”

সেই স্বর্ণযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে দেখেছিলেন জ্ঞানের আলো দিয়ে।
তাঁদের অবদান কেবল মুসলিম সমাজকে সমৃদ্ধ করেনি, বরং ভবিষ্যৎ ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশে সহায়তা করেছে। আল-খোয়ারিজমি ছিলেন তাদের অন্যতম প্রধান স্থপতি। তাঁর রচিত সূত্র ও ধারণা—যেমন সরলীকরণ, সমীকরণ সমাধান, অনুপাত, এবং সত্যিকার গণিতীয় যুক্তি—একবিংশ শতকেও আমাদের ব্যবহারিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

আল-খোয়ারিজমির অবদান পর্যালোচনা করতে গিয়ে অনেক ইতিহাসবিদ বলেন,
পুরো মধ্যযুগের ইউরোপে গণিত চর্চা ছিল বেশ সীমিত। মোক্ষম সময়ে আল-খোয়ারিজমির গ্রন্থগুলো যখন আরবি থেকে ল্যাটিনে অনূদিত হল, তখন ইউরোপের নবজাগরণের যুগে গণিতচর্চা নতুন গতিপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তী সময়ে আইজ্যাক নিউটন, গটফ্রিড লাইবনিজ, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা যে চূড়ায় উঠেছেন, সেই ভিত্তিমূলের পেছনে ছিল আল-খোয়ারিজমির অসামান্য প্রভাব।

ঢাকার একটি স্থানীয় পাঠাগারে দাঁড়িয়ে শিক্ষানুরাগী তারেক মাহমুদ জানালেন,
“আমরা এখন গণিতের নানা জটিল বিষয় সহজেই শিখতে পারি। কিন্তু আমাদের পূর্বসূরিরা কী অসামান্য কাজ করে গেছেন, সেটা জানতে গেলে আল-খোয়ারিজমির গল্প পড়াই যথেষ্ট। তাঁর জীবন সংগ্রাম, গবেষণা, আর সৃষ্টিশীল উদ্যোগ আজও আমাদের প্রেরণা জোগায়।”

প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকেই বলেন,
আধুনিক সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, রোবোটিকস, কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে যেসব মডেল, অ্যালগরিদম কিংবা গাণিতিক সূত্র ব্যবহৃত হয়, তার শেকড় অনেকাংশে আল-খোয়ারিজমির চিন্তা-ভাবনাতেই নিহিত। তাঁর রেখে যাওয়া ওই মশালধারীর পথ ধরেই যুগে যুগে নানা আবিষ্কার ও উদ্ভাবন এগিয়ে চলেছে।

এই সকল আলোচনার শেষ না হলেও,
স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আল-খোয়ারিজমি কেবল একজন মুসলিম বিজ্ঞানী ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানবসভ্যতার এক অনন্য স্থপতি। আজ, আমাদের প্রতিদিনের গণনা থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কিংবা জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিল হিসাব—সবখানেই তাঁর পদ্ধতির ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। “তিনি গণিত জগতের সত্যিকারের রেনেসাঁন মানুষ,” মন্তব্য করেন ইতিহাস গবেষক ড. আনিসুল কবীর। “অতীতের সেতুবন্ধ তৈরিতে তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব আমাদের উচিত সবসময় স্বীকার করা।”

জ্ঞানচর্চার এই মহাপরিক্রমায় আল-খোয়ারিজমির নাম তাই চিরজাগরূক।
তিনি গণিতের আধুনিক ভাষা ও নীতিমালা তৈরির অগ্রপথিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের নির্মাতা, এবং গাণিতিক বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের এক স্থায়ী অনুপ্রেরণা। তাঁর অনন্য দৃষ্টান্ত আর সৃষ্টিশীল পথচলা প্রমাণ করে—সঠিক দীক্ষা, নিরন্তর গবেষণা ও উন্মুক্ত আদর্শের মাধ্যমে শুধুমাত্র কোনো সম্প্রদায়ের নয়, বরং গোটা মানবজাতির উন্নয়নে কী অবদান রাখা যায়। এই কালজয়ী বিজ্ঞানীর কর্ম আর চিন্তার বিস্তার তাই আবারো প্রমাণ করে, জ্ঞানের শিখা কখনো নিভে যায় না; বরং একটি প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মকে উদ্দীপিত করে, সামনে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগায়।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
পদার্থবিদ্যাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বলের রহস্য উদঘাটনের নতুন যুগ

বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী পারমাণবিক বলের দীর্ঘস্থায়ী রহস্য উন্মোচন করেছেন, কীভাবে কোয়ার্ক এবং গ্লুয়ন...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

ভিনগ্রহের সূর্যজগতের জন্ম প্রত্যক্ষ করলেন জ্যোতির্বিদরা: আমাদের সৌরজগতের অতীত বোঝার এক নতুন জানালা খুলে গেল

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তরুণ নক্ষত্র HOPS-315 এর চারপাশে একটি নতুন...

পরিবেশ ও পৃথিবীবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

সুন্দরবনের ভৌগোলিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট।

সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বেঁচে থাকার...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

চাঁদের বুকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র: বিজ্ঞানের নামে শক্তির খেলা?

২০২৯ সালের মধ্যে চাঁদে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে নাসা।...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

ধূমকেতুর দেশে অতিথি: ৩আই/অ্যাটলাস ও আমাদের সৌরজগতের সীমা

রহস্যময় আন্তঃনাক্ষত্রিক পরিদর্শক 3I/ATLAS আবিষ্কার করুন - একটি প্রাচীন ধূমকেতু যা আমাদের...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org