যুক্তরাজ্যের অ্যান্ডি ইভানস একসময় রাতভর সুপারমার্কেটে কাজ করতেন। গত বছর যখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ‘অন্ধ’ হিসেবে নিবন্ধন করা হলো, তখন তাকে সেই কাজ ছেড়ে দিতে হলো। হঠাৎ করেই জীবনের স্বাভাবিক কাজগুলো তার কাছে অসাধ্য হয়ে উঠল। রেস্তোরাঁয় বসে মেনু পড়া, নতুন কোনো এলাকায় গিয়ে দিক চিনে নেওয়া, কিংবা শুধু হাঁটার পথে কোন বাধা সামনে আছে তা বোঝা—এসব সাধারণ কাজই হয়ে উঠল ভয়ানক জটিল। কাজের জায়গা তো দূরের কথা, ইভানস তখন মনে করেছিলেন হয়তো আর কখনোই স্বাধীনভাবে চলাফেরা বা উপার্জন করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
ঠিক সেই সময়েই প্রযুক্তি তার জীবনে এনে দিল এক অপ্রত্যাশিত আলোর ঝলক। বিবিসি জানায়, ইভানস পরে নিলেন রে-ব্যানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–সমৃদ্ধ বিশেষ চশমা। চশমার ভেতরে আছে সূক্ষ্ম এক ক্যামেরা আর ছোট্ট স্পিকার, যা সংযুক্ত হয় এক শক্তিশালী এআই মডেলের সঙ্গে। আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে রিয়েল-টাইম বর্ণনা শোনাতে পারে এই চশমা। তিনি যদি জানতে চান সামনে কী আছে, কোথায় বাধা আছে, কিংবা কোনো লেখা পড়তে চান—চশমা সঙ্গে সঙ্গে তা বলে দেয়।
ইভানস বলছেন, এই অভিজ্ঞতা তার জন্য “লাইফ-চেঞ্জিং।” আগে যেখানে তিনি রেস্তোরাঁয় বসে নিজে খাবার অর্ডার করার সাহস পেতেন না, এখন সেটি সহজ হয়ে গেছে। রাস্তায় হাঁটার সময় তিনি জানতে পারেন সামনে কী আছে। এই আত্মবিশ্বাস তাকে আবার কর্মজীবনে ফিরতে সাহায্য করেছে। আজ তিনি কাজ করছেন Sight Support West of England নামের এক দাতব্য সংস্থায়, যেখানে অন্য অন্ধ মানুষদেরও শেখাচ্ছেন কিভাবে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে জীবনে স্বনির্ভর হওয়া যায়।
এই প্রযুক্তি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে ইতিমধ্যেই এটি যে জীবন বদলে দেওয়ার মতো শক্তি রাখে, তা পরিষ্কার। রয়্যাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ব্লাইন্ড পিপলের ইনক্লুসিভ ডিজাইন প্রধান রবিন স্পিংকস নিজেও দৃষ্টিহীন। তিনি প্রতিদিন এই চশমা ব্যবহার করেন এবং এর অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করেন “রূপান্তরমূলক” হিসেবে। কোনো জায়গা, বস্তু বা দৃশ্যের তাত্ক্ষণিক বর্ণনা শোনা তার কাছে নতুন করে পৃথিবীকে ছুঁয়ে দেখার সমান।
এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে—একটি যন্ত্রের ভেতরে এমন কী আছে যা এত বড় পরিবর্তন এনে দিল? মূলত এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজ হলো চাক্ষুষ জগতকে শব্দে রূপান্তর করা। যে মানুষ একসময়ে তার চারপাশ দেখতে পারতেন না, তিনি এখন সেই পরিবেশ সম্পর্কে শোনার মাধ্যমে ধারণা নিতে পারেন। প্রযুক্তি চোখের ঘাটতি পূরণ করছে না, বরং মস্তিষ্কে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার একটি বিকল্প পথ তৈরি করছে।
তবে এই গল্প কেবল একটি প্রযুক্তির সাফল্যের গল্প নয়। এটি মানবজাতির সেই পুরনো আকাঙ্ক্ষার গল্প, যেখানে আমরা সবসময়ই চাই প্রযুক্তি হোক অন্তর্ভুক্তিমূলক, সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর। চিকিৎসা বা সহায়ক যন্ত্রের বাজার অনেক সময়ই সীমিত আকারে থাকে, ফলে দাম বেশি এবং সহজলভ্যতা কম। অথচ রে-ব্যানের মতো একটি বাণিজ্যিক ব্র্যান্ডের এই উদ্যোগ দেখাচ্ছে, মূলধারার পণ্যও কিভাবে প্রতিবন্ধীদের জীবন বদলে দিতে পারে।
অবশ্যই এখানে কিছু বাস্তবতা আছে। প্রযুক্তি সবার নাগালে নেই, দাম সস্তা নয়, এবং ব্যবহার করতে গেলে শিখতে হয় নতুন কিছু অভ্যাস। তবু অ্যান্ডি ইভানসের মতো মানুষের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রযুক্তি যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে এটি কেবল বিনোদন বা ব্যবসার ক্ষেত্রেই নয়, মানুষের জীবনযাত্রার মূল কাঠামোকেও বদলে দিতে পারে।
বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে হাজারো দৃষ্টিহীন মানুষ এখনো সমাজের মূলধারার বাইরে রয়ে গেছে, সেখানে এই ধরনের উদ্ভাবন এক নতুন ভাবনার দিক খুলে দিতে পারে। প্রযুক্তি যদি সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, স্থানীয়ভাবে তৈরি সহায়ক যন্ত্রে যদি এআই যুক্ত করা যায়, তবে অগণিত মানুষ নতুন করে স্বাধীনতা ফিরে পেতে পারে।
অ্যান্ডি ইভানসের জীবনের এই পরিবর্তন আমাদের শেখায় যে প্রযুক্তির আসল সাফল্য পরিমাপ করা উচিত কেবল মুনাফা দিয়ে নয়, বরং কতটা এটি মানুষকে তার মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারছে, কতটা এটি তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে, আর কতটা এটি তাকে আবার সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। প্রযুক্তি তখনই সত্যিকারের মানবিক হয়ে ওঠে, যখন সেটি জীবনের ভেতরে আলো জ্বালাতে পারে।

Leave a comment