নিকোলা টেসলা
নিকোলা টেসলা

কিংবদন্তী প্রকৌশলী ও আবিষ্কারক নিকোলা টেসলা

তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তী প্রকৌশলী ও আবিষ্কারক। আধুনিক পরিবর্তী তড়িৎ প্রবাহ ও পরিবাহীবিহীন তড়িৎ পরিবহন ব্যবস্থা আবিষ্কারের জন্য যিনি সর্বাধিক পরিচিত, সেই বিখ্যাত আবিষ্কারকের নাম নিকোলা টেসলা। তাঁর উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে রয়েছে, টেসলা কয়েল, অল্টারনেটিং-কারেন্ট(এসি), বিদ্যুৎ এবং ঘোরানো চৌম্বকীয় ক্ষেত্র অন্যতম। তাঁকে বলা হয়, সময়ের চেয়ে অগ্রগামি যিনি আজকের পৃথিবীকে বদলে দেওয়া এক মহানায়ক! 

 

বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল

এবার এই বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল জেনে নিইঃ 

নাম- নিকোলা টেসলা।

জন্ম- ১০ জুলাই ১৮৫৬ সালে এবং মৃত্যু- ০৭ জানুয়ারী ১৯৪৩ সালে।

বাসস্থান- স্মিলজান, অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য (বর্তমানে ক্রোয়েশিয়া)।

জাতীয়তা- সাব্রিয়ান-আমেরিকান।

শিক্ষা জীবন- টেসলা ১৮৬১ সালে স্মিলজানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এই বিদ্যালয়ে তিনি জার্মান, গণিত আর ধর্ম শিখেন। ১৮৭০ সালে তিনি উত্তরের কারলোভাকে যান উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্যে।

পরবর্তীতে টেসলা একজন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক দ্বারা তড়িৎ প্রদর্শনীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।  তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, এই প্রদর্শনীসমূহে এই ‘রহস্যময় ঘটনা’ তাঁকে ‘এই বিস্ময়কর শক্তির আরও জানতে’ উৎসাহিত করেছিল। টেসলা তাঁর মাথায় অবিচ্ছেদ্য ক্যালকুলাস সম্পাদন করতে সক্ষম ছিলেন যা তাঁর শিক্ষকগণ বিশ্বাস করতে চাননি। অর্থাৎ তিনি কোনোরকম খাতা-কলম ছাড়াই কেবলমাত্র ব্রেইনে চিন্তা করে বড় বড় ক্যালকুলেশন অনায়াসে সম্পাদন করতে পারতেন। ১৮৭৩ সালে তিনি চার বছরের স্নাতক তিন বছরে শেষ করেছিলেন।

১৮৭৩ সালে আবার তিনি স্মিলজানে ফিরে আসেন। আর অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কলেরা রোগে আক্রান্ত হন এবং নয় মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর বাবা এই হতাশার মুহূর্তে ছেলের অসুস্থতা থেকে সেরে উঠলে তাঁকে সেরা প্রকৌশল বিদ্যালয়ে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন। যদিও তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে একজন ধর্ম যাজক হবে।

কিন্তু তিনি সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে ১৮৭৪ সালে লিকার দক্ষিণ-পূর্ব থেকে গ্রেযাকের নিকটস্থ টমিংজ-তে পালিয়ে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সেখানে তিনি হান্টারের পোশাক পরে পর্বতমালা ঘুরে দেখেন। পরবর্তীতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, প্রকৃতির সাথে এই যোগাযোগ তাঁকে শারীরিক ও মানসিক উভয়দিক থেকে শক্তিশালী করেছিল। তিনি টমিংজ-তে থাকাকালীন বেশকিছু বই পড়েছিলেন, বিশেষ করে মার্ক টোয়েনের লেখাসমূহ তাঁর আগের অসুস্থতা থেকে অলৌকিকভাবে পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করেছিল।

১৮৭৫ সালে তিনি একটি মিলিটারি ফ্রন্টিয়ার স্কলারশিপে অস্ট্রিয়ার গ্রেজে অস্ট্রিয়ান পলিটেকনিকে ভর্তি হন। এসময় টেসলা কখনোই কোনও বক্তৃতা শুনতে ভুলে যাননি, সর্বাধিক গ্রেড অর্জন করেছিলেন এবং নয়টি পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সেখানে তাঁর বাবা কারিগরী অনুষদের ডিনের কাছ থেকে ‘আপনার ছেলে প্রথম পদমর্যাদার একজন তারকা’ প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন।

১৮৮১ সালে তিনি হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে চলে আসেন বুদাপেস্ট টেলিফোন এক্সেচেঞ্জের একটি টেলিগ্রাফ সংস্থায় টিভাডার পুস্কেসের অধীনে কাজ করার জন্য। এখানে আসার পরে তিনি বুঝতে পারলেন সংস্থাটি কার্যকর নয়। এর পরিবর্তে তিনি কেন্দ্রিয় টেলিগ্রাফ অফিসে একজন ড্রাফটসম্যান হিসেবে কাজ করেছিলেন। এখানে কয়েকমাসের মধ্যে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কার্যকরী হয়ে ওঠে এবং টেসলাকে প্রধান ইলেকট্রিসিয়ান পদে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

১৮৮২ সালে টেসলা প্যারিসে কন্টিনেন্টাল এডিসন কোম্পানীতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এখানে তিনি একেবারে নতুন শিল্পের কাজ শুরু করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকটি সাব ডিভিশন ছিল। টেসলা আলোক সিস্টেম স্থাপনের দায়িত্বে প্যারিসের আইভরি-সুর-সাইন শহরতলীর বিভাগীয় সোসাইটি ইলেকট্রিক এডিসনে কাজ করেছিলেন। এখানে তিনি বৈদ্যুতিক প্রকৌশল বিষয়ে প্রচুর ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাঁর দক্ষতার কারনে তাঁকে শীঘ্রই ডায়নামস এবং মোটর তৈরির উন্নত সংস্করণ ডিজাইন ও বিল্ডিং করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাঁকে ফ্রান্স ও জার্মানী জুড়ে নির্মিত অন্যান্য সাব ডিভিশনে প্রকৌশল সমস্যা সমাধানের জন্য পাঠানো হয়েছিল। ১৮৮৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। একই প্রতিষ্ঠানে তাঁর দায়িত্ব ও কর্মব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৮৬ সালের শেষের দিকে টেসলা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সুপারিন্টেন্ডেন্ট আলফ্রেড এস ব্রাউন এবং নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি চার্লস এফ পেকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আর এই দুই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লাভের জন্য সংস্থা স্থাপন, উদ্ভাবন এবং পেটেন্ট সংরক্ষণে অভিজ্ঞ ছিলেন। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির জন্য থার্মো- চৌম্বকীয় মোটর আইডিয়া সহ টেসলার নতুন আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে তারা উদ্ভাবককে আর্থিকভাবে ফেরত প্রদানে এবং তাঁর পেটেন্টগুলি পরিচালনা করতে সম্মত হন।

১৮৮৭ সালের এপ্রিলে তারা যৌথভাবে একটি বৈদ্যুতিক সংস্থা গঠন করেছিলেন, একটি চুক্তি অনুসারে পেটেন্টগুলি থেকে লভ্যাংশের এক তৃতীয়াংশ পাবে টেসলা, এক তৃতীয়াংশ পাবে পেক ও ব্রাউন এবং উন্নয়ন তহবিলে এক তৃতীয়াংশ থাকবে। তারা ম্যানহাটনের লিবার্টি স্ট্রিটে টেসলার জন্য একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করেছিলেন যেখানে তিনি নতুন ধরণের বৈদ্যুতিক মোটর, জেনারেটর এবং অন্যান্য ডিভাইসগুলোর উন্নতি ও বিকাশে কাজ করেছিলেন।

একই বছর টেসলা একটি ইনডাকশন মোটর উন্নয়ন করেছিলেন যা পর্যায়ক্রমে কারেন্ট (এসি) নামে চালু হয়। এটি একটি বিদ্যুৎ সিস্টেমের ফরমেট যা ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত দূরত্বে, উচ্চ ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন সুবিধার কারণে দ্রুত প্রসারিত হয়েছিল। মোটরটি পলিফেজ কারেন্ট ব্যবহার করেছিল, এটি মোটরটিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি ঘূর্ণন চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।

১৯৮৮ সালের জুলাইয়ে ব্রাউন এবং পেক জর্জ ওয়াশিংটন হাউজের সাথে টেসলার পলিফেজ ইন্ডাকশন মোটর এবং ট্রান্সফর্মার ডিজাইনের জন্য নগদ ও স্টক হিসেবে ৬০,০০০ ডলার এবং প্রতিটি মোটর দ্বারা উৎপাদিত এসি হর্স পাওয়ারের জন্য ২.৫০ ডলারের রয়্যালিটির জন্য লাইসেন্স চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন।

টেসলা ওজোন উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি ডিভাইস বাজারজাত করার চেষ্টা করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে তাঁর ১৯০০ টেসলা ওজোন কোম্পানী ১৮৯৬ সালে পেটেন্টযুক্ত ডিভাইস বিক্রি করেছিল তাঁর টেসলা কয়েলের উপর ভিত্তি করে। 

অন্যতম বৈশিষ্ট্যসমূহঃ

১. ১৮৯৪ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফ্রাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট থেকে এলিয়ট ক্রেসন মেডেল লাভ করেন;

২. তিনি ১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স থেকে এআইআইই এডিসন মেডেল লাভ করেন;

৩. তিনি ১৯৩৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট অ্যান্ড ফিলাডেলফিয়া সিটি কাউন্সিল থেকে জন স্কট মেডেল লাভ করেন।

নিকোলা টেসলা ছিলেন একজন প্রকৌশলী ও আবিষ্কারক যিনি বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা অল্টারনেটিং-কারেন্ট (এসি) বৈদ্যুতিক সিস্টেম ডিজাইনের জন্য পরিচিত। তাঁর ছিল ৩০০টির বেশি আবিষ্কারের পেটেন্ট, আজকের পৃথিবীর অনেককিছু তা পাল্টে দিয়েছে।  বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণকারী এই আবিষ্কারক অবশেষে ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন।

সাদ আব্দুল ওয়ালী কর্তৃক প্রকাশিতব্য ‘বিজ্ঞান মনীষা’ (দ্বিতীয় সংস্করণ) থেকে নেওয়া। 

তথ্যসূত্রঃ

১। উইকিপিডিয়া (www.wikipedia.org)

২। www.britannica.com

৩। www.history.com

সাদ আব্দুল ওয়ালী
Latest posts by সাদ আব্দুল ওয়ালী (see all)

About সাদ আব্দুল ওয়ালী

প্রধান সম্পাদক, www.e-learningbd.com। সহকারী ব্যবস্থাপক, আইটি, উইন্টার ড্রেস লিমিটেড। বি.এস.এস., রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। হায়ার ডিপ্লোমা ইন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, এপটেক কম্পিউটার এডুকেশন। বই প্রকাশঃ ১. ডেটাবেজ প্রোগ্রাম: এসকিউএল সার্ভার, ২. ওরাকল ও ডেভেলপার (সাদ আব্দুল ওয়ালী ও মাহবুবুর রহমান), ৩. বিজ্ঞান মনীষা, ৪. আবিষ্কারের ইতিকথা। বিভাগীয় সম্পাদক, ছোটদের জন্য বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী.org । ই-মেইল: walisearch@yahoo.com

Check Also

ঝরে গেল আমাদের বড়বৃক্ষ- দ্বিজেন শর্মা

বেণুবর্ণা অধিকারী পাতার উদ্গম ও ঝরে যাওয়া, আবারও পত্রপুষ্পে বৃক্ষের পল্লবিত হওয়া—এ তো প্রকৃতির স্বভাবধর্ম,মানুষও …

ফেসবুক কমেন্ট


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।