স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

এম্প্যাথেটিক্ মিরর নিউরন

Share
Share

অপরকে হাই তুলতে দেখে আপনারও কি হাই ওঠার উপক্রম হয়? যদি আপনার এই স্বভাব নাও থাকে, চেনা পরিচিতদের মধ্যে কথা বলে দেখতে পারেন, অনেকেই নিজের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করে থাকবেন। গাড়িতে বসে ঘুমানোর বদ্-অভ্যাস থাকায় আমি সবসময় গাড়ির চালকের পাশে বসাকে এড়িয়ে চলি। আমরা কখনও বৈজ্ঞানিকভাবে ভেবে দেখেছি যে কেন রোম্যান্টিক চলচ্চিত্র বা পার্টি ভিডিও সং এত বাণিজ্যিকভাবে সফল যদিও চলচ্চিত্রে বা ভিডিও সং-এ দর্শক রোম্যান্স বা পার্টি করার সুযোগ পান না? কেন অনেক ক্ষেত্রেই অপরকে কাঁদতে দেখে বা অপরের দুঃখে আমাদেরও খারাপ লাগে? ধর্মগ্রন্থসমূহে মানুষকে অন্যান্য জীব ও মানুষের সাথে সহমর্মিতা শেখানো হয় – অপরের আনন্দকে অনুভব করা, অপরের দুঃখকে ভাগ করে নেওয়া – এক কথায় অপরের অবস্থাকে নিজের মস্তিষ্কে অনুভব করা । অপরের অবস্থাকে নিজের মধ্যে অনুভব করার ক্ষমতা হলো “এম্প্যাথি” যা সাধারণত সকল মানুষের মধ্যে কম-বেশী থাকলেও তাকে আরও বাড়িয়ে নেওয়া যায়। কোন জীবের মধ্যে এই ক্ষমতার উৎসটি হলো – মস্তিষ্ক যে অজস্র স্নায়ুকোষ বা নিউরোন নিয়ে গঠিত, তাদের মধ্যে কিছু বিশেষ প্রকার স্নায়ুকোষ যার নাম “এম্প্যাথেটিক্ মিরর নিউরোন” বা সংক্ষেপে “মিরর নিউরোন” যারা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে আছে।

নামকরণের যথার্থতা

ম্যাকাক্ বানরদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে, কোন বানর কোন কাজ করলে কিংবা অন্য কোন বানরকে বা মানুষকে সেই একই কাজ করতে দেখলে, উভয় ক্ষেত্রেই বানরের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু স্নায়ুকোষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। বলাই বাহুল্য যে বানরের ঐ স্নায়ুকোষগুলি “মিরর নিউরোন”-র উদাহরণ যারা করা ও দেখার মধ্যে পার্থক্যটুকু যেন ঘুচিয়ে দেয়। এই স্নায়ুকোষগুলির সাহায্যে একজনের অনুভূতি আরেকজনের মধ্যে প্রতিফলিত হয় কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে, একজনের মস্তিষ্কের কোন নির্দিষ্ট অংশের সক্রিয়তা আরেকজনের মস্তিষ্কের একই অংশে “ভার্চুয়াল রিয়ালিটি”-র ন্যায় সিমুলেটড্ হয় বলে এই স্নায়ুকোষের নামে “মিরর” অর্থাৎ দর্পণ বা আয়না শব্দটির ব্যবহার হয়।

মানুষে-মানুষে পারস্পরিক ধারণা অর্জনে মিরর নিউরন এর ভূমিকা

আমাদের চলাফেরা বা অঙ্গভঙ্গি বা বিভিন্ন আবেগ সংক্রান্ত মুখভঙ্গি – এই সকলই  মস্তিষ্কের প্রিমোটর কর্টেক্স ও ইন্ফিরিয়র্ প্যারাইটাল কর্টেক্স অংশের স্নায়ুকোষগুলি পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্বাচন করে এবং কাজগুলি ঠিক কিভাবে সংঘটিত হবে তার পরিকল্পনা করে। যখন আমরা কোন বস্তুর দিকে এগিয়ে যাই ও তাকে ধরি কিংবা এগিয়ে গিয়ে বস্তুটিকে ঠেলি কিংবা টানি বা মুখভঙ্গি করি – প্রত্যেক ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের উপরোক্ত দুটি অংশের ভিন্ন ভিন্ন স্নায়ুকোষের দলকে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায়। ঐ প্রতিটি স্নায়ুকোষের দল আসলে কিছু মোটর স্নায়ুকোষকে উত্তেজিত করে এবং মোটর স্নায়ুকোষগুলি বিভিন্ন পেশীকে পরপর কতগুলি ঝাঁকুনি বা সংকোচনের মাধ্যমে আমাদের মুখভঙ্গি বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চলন ঘটায়।

যখন আমরা নিজে কোন কাজ না করেও কাউকে ঐ একই কাজ করতে দেখি, তখন প্রিমোটর কর্টেক্স ও ইন্ফিরিয়র্ প্যারাইটাল কর্টেক্স-র পূর্বোক্ত স্নায়ুকোষের দলে সকল স্নায়ুকোষের বদলে কেবল মিরর স্নায়ুকোষগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রিমোটর কর্টেক্স ও ইন্ফিরিয়র্ প্যারাইটাল কর্টেক্স-র মিরর নিউরোন-গুলি আমাদের মস্তিষ্ককে নিজেদের আর বাকি মানুষদের কথা বলা, কাজ-কর্ম ও আবেগর বহিঃপ্রকাশের ভঙ্গিমা বুঝতে, তাদের স্মৃতিতে ধরে রাখতে ও তুলনা করতে সাহায্য করে।

 

ভাষা ও মিরর নিউরোন

আমাদের মস্তিষ্কের “ব্রকাস্ এরিয়া” অংশটি ভাষা শেখা ও ভাষা ব্যবহারে বিশেষভাবে সাহায্য করে। মজার বিষয় হলো এই যে, এই অংশেও কিছু মিরর স্নায়ুকোষ পাওয়া যায়। ব্রকাস্ এরিয়া-র মিরর স্নায়ুকোষ যেমন ভাষা শেখায় সাহায্য করে, তেমনি একাধিক ভাষার ব্যবহার বা ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কথোপকথন প্রসঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে এক ভাষা থেকে অপর ভাষায় শব্দের অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ভাষার বিবর্তনেও  মিরর স্নায়ুকোষের ভূমিকা থাকতে পারে।

আনন্দ ভাগ করে নিতে বা সমবেদনায় মিরর স্নায়ুকোষ কিভাবে সাহায্য করে?

কথায় বলে যে দুঃখ ভাগ করে নিলে কমে আর আনন্দের ভাগে তা আরও বাড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে আনন্দ বা দুঃখ একজনের থেকে অনেকের মধ্যে ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়ায় কেন?

আম্স্টারডামে নেদারল্যান্ড্স ইন্সটিটিউট ফর নিউরোসায়েন্স এর বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম ইঁদুরদের উপর পরীক্ষা করে জানতে পারেন যে শুধু অপরের চলাফেরা বা অঙ্গভঙ্গি নয়, এম্প্যাথেটিক্ মিরর নিউরোন অপরের শারীরিক কষ্ট অনুভব করাও সম্ভব করে তোলে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো যে শারীরিক কষ্ট ভোগ করার সময় বা অপরের শারীরিক কষ্ট পর্যবেক্ষণ করার সময় ইঁদুর ও মানুষের মস্তিষ্কের একই অংশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এই অংশটির নাম “অ্যান্টেরিয়া সিঙ্গুলেট কর্টেক্স” যার মিরর স্নায়ুকোষগুলি শারীরিক কষ্টের সরাসরি অনুভব বা অপরের শারীরিক যন্ত্রণা পর্যবেক্ষণ – উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় হয়, তবে শারীরিক কষ্টের সরাসরি অভিজ্ঞতায় অ্যান্টেরিয়া সিঙ্গুলেট কর্টেক্স-র সক্রিয় স্নায়ুকোষের তালিকায় কিছু নন্-মিরর স্নায়ুকোষও থাকে।

শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি আমরা অপরের দুঃখে বা আনন্দে সহমর্মী হতে পারি মস্তিষ্কের ইন্সুলার কর্টেক্স-এ উপস্থিত মিরর স্নায়ুকোষগুলির বদান্যতায়।

অটিজম্ ও সাইকোপ্যাথি

মানুষের মধ্যে অটিজম্ রোগের লক্ষণ হিসাবে যে মোটর ডিসঅর্ডার (এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রয়োজনের অতিরিক্ত চলন দেখা গেলেও তাদের অধিকাংশই ব্যক্তিটির ইচ্ছাধীন হয় না), ভাষা বা মানুষের সাথে কথোপকথনে সমস্যা, আর পাঁচজনের মনের ভাব বোঝায় অক্ষমতা দেখা যায়; সেক্ষেত্রে মিরর স্নায়ুকোষের অভাব বা মিরর স্নায়ুকোষের গঠনগত সমস্যা বা নিষ্ক্রিয়তাকে একটি কারণ হিসাবে সন্দেহ করা হয়।

একজন সাইকোপ্যাথ-র অ্যান্টেরিয়া সিঙ্গুলেট কর্টেক্স-এ মিরর স্নায়ুকোষ সংক্রান্ত সমস্যা থাকার জন্যই অপরের ব্যথা দেখলেও এদের মস্তিষ্কের অ্যান্টেরিয়া সিঙ্গুলেট কর্টেক্স খুব একটা সক্রিয় হয়ে ওঠে না।

উপরের সম্পূর্ণ আলোচনা সামগ্রিকভাবে যে সত্যকে তুলে ধরে তা হলো যে মানুষের সমাজবদ্ধ হওয়ার পেছনে এম্প্যাথেটিক্ মিরর স্নায়ুকোষের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

দিগন্ত পাল
পেশা: তথ্য ও প্রযুক্তি পেশাদার

ঠিকানা: হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো নতুন নতুন সংবাদ জানতে সাবস্ক্রাইব করুন।

[mc4wp_form id=”3448″]

Share
Written by
নিউজডেস্ক -

আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাতকার প্রকাশ করি। আপনারা কোন লেখা প্রকাশিত করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: [email protected], [email protected]

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচিকিৎসা বিদ্যাসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আমাদের গর্ব ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন

কৃতি বিজ্ঞানীদের সিরিজে আমি কথা বলেছি ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন এর সাথে। তিনি...

GenZপরিবেশ ও পৃথিবীসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ই-বর্জ্য এর গবেষক হৃদয় রায়

ই-বর্জ এর গবেষক হৃদয় রায়। বাংলাদেশের মধ্যে ই-বর্জ নিয়ে কাজ করছে এমন...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

অন্ধকারে ভয়

কোন ব্যক্তি বাস্তবে যতই সাহসী হোন না কেন, গভীর রাতে অন্ধকার জনশূন্য...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

পাখার শব্দে নাম যে পাখির

ঈগল, বাজ ইত্যাদি পাখি মানুষকে এরোপ্লেন আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা জোগালেও ফড়িং, মৌমাছি ইত্যাদি...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

মাছরাঙার মাছ ধরা

একটি মাছরাঙা প্রতিদিন নিজের ওজনের প্রায় সম পরিমাণ ছোটো মাছ শিকার করে...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.