মানব সভ্যতার উৎকর্ষের পিছনে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি তা নিশ্চয়, বিদ্যুত শক্তি। এই যাত্রাটি শুরু হয়েছিল কয়লা, এরপর পেট্রোল ও ডিজেল। কিন্তু পৃথিবীর ভান্ডার অসীম নয়, তাই মানুষ খোঁজ করছে নতুন শক্তির উৎসের জন্য – এই মানব সভ্যতাকে অগ্রসর রাখার জন্যই। পৃথিবীতে যত শক্তির উৎস আছে, তার সবশেষে গিয়ে আমরা ফিরে আসি সূর্যের কাছেই। সূর্যের আলোই পৃথিবীর সব জীবের প্রধান শক্তির উৎস। আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় স্বপ্নগুলোর একটি হলো—এই সূর্যের আলোকে সরাসরি বিদ্যুতে রূপান্তর করা, এবং সেটি সবার জন্য সহজলভ্য করে তোলা। এই স্বপ্নেরই নাম সৌরশক্তি (Solar Energy), আর এই শক্তি ধরার যন্ত্রের নাম সৌরকোষ (Solar Cell)।
সিলিকন সৌরকোষের সীমাবদ্ধতা
আমরা অনেক সময় ছাদের উপরে যে সোলার প্যানেল দেখি, সেগুলোর বেশিরভাগই তৈরি হয় সিলিকন (Silicon) দিয়ে। এই সিলিকন সৌরকোষ অনেক দিন ধরে আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি হিসেবে কাজ করছে, কিন্তু এরও কিছু বড় সমস্যা আছে।
প্রথমত, সিলিকন সৌরকোষ তৈরি করতে লাগে অনেক উচ্চ তাপমাত্রা ও ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি। দ্বিতীয়ত, এগুলো তুলনামূলকভাবে ভারী এবং ভাঙার ঝুঁকিও বেশি। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এগুলোর দাম এখনো অনেক দেশের সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
ফলে বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করেন—কোনো নতুন উপাদান কি আছে যা সস্তা, সহজে তৈরি করা যায়, আর সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎও ভালোভাবে উৎপাদন করতে পারে?

সোলার প্যানেল থেকে শক্তি উৎপাদন পদ্ধতি। সূর্যের আলো প্যানেলের ওপর পড়লে ভেতরের বিশেষ পদার্থে বিদ্যুৎ তৈরি হয়।
এই সময় খুব ছোট কণিকা (ইলেকট্রন) চলতে শুরু করে, আর সেখান থেকেই বিদ্যুৎ আসে।
তারের মাধ্যমে এই বিদ্যুৎ লাইট, ফ্যান বা মোবাইল চার্জ করতে ব্যবহার করা যায়।
এভাবে সূর্য প্যানেল পরিষ্কার ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ দেয়। (AI দিয়ে অংকিত)
লেখকের কথা: এতদূর পর্যন্ত যা পড়লেন তা প্রযুক্তিজগতের খবরাখবর এবং সম্ভবত ইন্টারনেটের কল্যানে এটি সমন্ধে মোটামুটি জানেন। তবে এই প্রবন্ধের পিছনে আরেকটি গল্প রয়েছে। কিছুদিন আগে বিজ্ঞানী অর্গ এ আমরা প্রোফসর জামাল উদ্দিনের একটি সাক্ষাৎকার নিই। সাক্ষাৎকার প্রজেক্টের গতানুগতিক ধারায় আমরা বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর সাথে পরিচিত করে দেবার অনুরোধ করি। তিনি পরিচিত করে দেন ড. শাহিদুজ্জামান সোহেলের সাথে। আমি ড. শাহিদুজ্জামান সোহেলের সাথে যোগাযোগ করে তার তিনটি গবেষণাপ্রবন্ধ সংগ্রহ করি। সেই প্রবন্ধগুলি পড়ে বুঝতে পরি সোলার প্যানেলের এই সমস্যাটি সমাধান করার জন্য ড. শাহিদুজ্জামান সোহেল নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন এবং চমৎকার কিছু ফলাফল পাচ্ছেন। তার তিনটি পেপার পড়ে তা সহজ ভাষায় বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তুলে ধরার জন্যই এই প্রবন্ধটির প্রয়াস।
নতুন আশার নাম: পেরোভস্কাইট (Perovskite)
এমন সময় আবিষ্কৃত হলো এক চমৎকার উপাদান—পেরোভস্কাইট (Perovskite)। এটি এমন এক ধরনের স্ফটিক (Crystal), যা সূর্যের আলো খুব ভালোভাবে শোষণ করতে পারে। এর রসায়নও তুলনামূলক সহজ, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এটি তরল থেকে পাতলা স্তর (thin film) আকারে তৈরি করা যায়, অর্থাৎ বড় কারখানার প্রয়োজন হয় না।
পেরোভস্কাইট সৌরকোষ তৈরি হয় এক ধরনের জৈব (Organic) ও অজৈব (Inorganic) উপাদানের মিশ্রণে, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন Hybrid Perovskite Solar Cell। এই প্রযুক্তি আবিষ্কারের পর থেকে সৌরবিদ্যুৎ গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়, কারণ অল্প সময়ের মধ্যেই এর দক্ষতা বা Efficiency ৩% থেকে বেড়ে ২৫%-এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
কিন্তু সমস্যা এখানেই: টেকসই নয়! যেখানে সিলিকন সৌরকোষ ২০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে, সেখানে পেরোভস্কাইট সৌরকোষ কিছু সপ্তাহ বা মাসের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ হলো বাতাস ও পানির আর্দ্রতা, তাপমাত্রার পরিবর্তন, এবং আলোতে রাসায়নিক ভাঙন।
এই উপাদানগুলো এত সংবেদনশীল যে, বাতাসের ভেতরের সামান্য জলীয় বাষ্পও এদের রাসায়নিক গঠন নষ্ট করে দিতে পারে। তাই পেরোভস্কাইট সৌরকোষ তৈরি করতে হয় একদম শুকনো পরিবেশে, যাকে বলা হয় Glove Box—একটি বদ্ধ জায়গা যেখানে অক্সিজেন ও আর্দ্রতা থাকে না।
এই কারণে এই প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ এত জটিল ব্যবস্থা বানানো ব্যয়বহুল।
আরও একটি সমস্যা: কণার আকার ও গঠন। পেরোভস্কাইট সৌরকোষের কার্যক্ষমতা অনেকটা নির্ভর করে এর গঠনের উপর—এর কণাগুলো কত বড়, কত সমানভাবে ছড়িয়ে আছে, আর তাদের মাঝে ফাঁক বা ছিদ্র আছে কিনা। যদি কণাগুলো ছোট ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবে বিদ্যুৎ প্রবাহে বাধা পড়ে, ইলেকট্রন আটকে যায়, আর সৌরকোষের দক্ষতা কমে যায়। অন্যদিকে যদি কণাগুলো বড় ও সমান হয়, তবে সৌরকোষ বেশি বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। এই কণাগুলোর আকার ও গঠন নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। কারণ পেরোভস্কাইট তৈরি হয় তরল দ্রবণ থেকে, যা খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়। ফলে ক্রিস্টালগুলো ঠিকভাবে গঠিত হয় না, বরং এলোমেলোভাবে জমে যায়।
কেন এই সমস্যাগুলো সমাধান করা জরুরি?
বিজ্ঞানীরা জানেন, যদি এই তিনটি বড় সমস্যা—আর্দ্রতা, কণার গঠন, এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব—সমাধান করা যায়, তাহলে perovskite solar cell পুরো পৃথিবীর শক্তি ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাতে পারবে। কারণ এটি:
- সস্তা উপাদান দিয়ে তৈরি করা যায়,
- হালকা ও নমনীয়,
- ছোট মোবাইল যন্ত্র থেকে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়,
- এমনকি কাপড় বা প্লাস্টিকের ওপরও বসানো যায়!
এই কারণেই পেরোভস্কাইট সৌরকোষের গবেষণা এখন বিশ্বের হাজারো ল্যাবরেটরিতে চলছে।
বিজ্ঞানীদের নতুন পথ: ন্যানোপ্রযুক্তি ও আইওনিক লিকুইড
এই সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজতে বিজ্ঞানীরা নতুন দুটি প্রযুক্তির দিকে নজর দিয়েছেন—ন্যানোপ্রযুক্তি (Nanotechnology) এবং আইওনিক লিকুইড (Ionic Liquid)।
ন্যানোপ্রযুক্তি অর্থ হলো উপাদানকে অতি ক্ষুদ্র কণার স্তরে নিয়ন্ত্রণ করা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ছোট আকারের কণাগুলোকে Nanoparticles বলে কেননা এইগুলি ন্যানো স্কেলের। ন্যানোস্কেল বলতে এমন একটি অতিক্ষুদ্র মাত্রাকে বোঝায়, যেখানে জিনিসের আকার এক মিটারের এক বিলিয়ন ভাগেরও ছোট (ন্যানোমিটার মাত্রা)।
এই স্কেলে পদার্থের আচরণ সাধারণ আকারের চেয়ে ভিন্ন হয়, ফলে নতুন বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক ও যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আলো শোষণ, ইলেকট্রন প্রবাহ, এমনকি উপাদানের রংও পরিবর্তিত হয়। তাই পেরোভস্কাইট উপাদানকে ছোট ছোট কণায় ভাগ করে বিজ্ঞানীরা এর গঠন আরও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে Ionic Liquid হলো এমন এক ধরনের তরল, যেটিতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়ন থাকে, কিন্তু এটি সাধারণ তরলের মতো সহজে শুকায় না বা উড়ে যায় না। এই তরল দিয়ে পেরোভস্কাইট বানালে উপাদান ধীরে ধীরে জমে, ফলে ক্রিস্টালগুলো সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। এটি পেরোভস্কাইট–এর জন্য একধরনের “সহজ পরিবেশ” তৈরি করে, যাতে সেটি বাতাসে নষ্ট না হয়ে ভালোভাবে গঠিত হয়।
এইবার চলুন এই গবেষণাক্ষেত্রের যন্ত্রপাতিগুলি সমন্ধে একটি জানা যাক: AFM ও Coating Technology। এই ধরনের সূক্ষ্ম গবেষণায় বিজ্ঞানীরা কিছু বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করেন। যেমন:
AFM (Atomic Force Microscope): এটি একটি বিশেষ ধরনের মাইক্রোস্কোপ, যা সাধারণ আলো বা লেন্স দিয়ে নয়, বরং একটি সূক্ষ্ম সূচ (needle) দিয়ে উপাদানের পৃষ্ঠের প্রতিটি দানা বা উঁচু-নিচু অংশ স্পর্শ করে দেখে। এর মাধ্যমে তারা বুঝতে পারেন পেরোভস্কাইট ফিল্ম কতটা সমান, কোথায় ছিদ্র আছে, এবং কণাগুলোর আকার কেমন।
Coating Technology: পেরোভস্কাইট ফিল্ম বানানোর জন্য যে পদ্ধতিতে তরলটি সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সেটিকে বলা হয় coating। এর অনেক ধরন আছে – Spin Coating: দ্রবণকে ঘুরিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, Bar Coating: ধাতব দণ্ড দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, Slip Coating: একটি নির্দিষ্ট ঢালে তরলকে গড়িয়ে দেওয়া হয়। এই coating–এর মাধ্যমেই তৈরি হয় পেরোভস্কাইট–এর পাতলা স্তর বা film, যা পরবর্তীতে সৌরকোষ হিসেবে কাজ করে।
এক বিজ্ঞানীর তিন ধাপের আবিষ্কার:
বিজ্ঞান কখনো এক লাফে বড় আবিষ্কার করে না। বিজ্ঞান এগোয় ধাপে ধাপে—আজ যা অসম্ভব মনে হয়, কাল সেটাই হয় নতুন পথের শুরু। এখানে একজন বিজ্ঞানী ও তাঁর গবেষণা দল ধীরে ধীরে পেরোভস্কাইট সৌরকোষের বড় সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করেছেন।
(১) প্রথম ধাপ: ছোট কণার রহস্য (২০১৪ সালের গবেষণা) এই যাত্রার শুরু হয় একটি খুব সাধারণ কিন্তু গভীর প্রশ্ন দিয়ে—পেরোভস্কাইট কি সবসময় বড় একটানা পাত আকারে থাকতে হবে? নাকি এটিকে ছোট ছোট কণায় ভাগ করলেও কাজ চলবে? এই প্রশ্ন থেকেই ২০১৫ সালের গবেষণাটি করা হয়। এখানে বিজ্ঞানীরা পেরোভস্কাইট–কে ভেঙে ছোট ছোট কণার আকারে তৈরি করেন, যাদের বলা হয় nanoparticle। Nano মানে খুব ছোট—চোখে দেখা যায় না, এমনকি সাধারণ মাইক্রোস্কোপেও দেখা কঠিন। কিন্তু সমস্যা ছিল, পেরোভস্কাইট খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়। ফলে কণাগুলো এলোমেলো আকার নেয়, কখনো লম্বা, কখনো ফিতা মতো, আবার কখনো ফাঁকফোকর তৈরি করে। তখন বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন একটি বিশেষ তরল—ionic liquid। এই ionic liquid perovskite–কে ধীরে ধীরে গঠিত হতে সাহায্য করে। ফলে ছোট ছোট কিন্তু প্রায় গোলাকার কণা তৈরি হয়, যেগুলো সমানভাবে পুরো পৃষ্ঠে ছড়িয়ে থাকে। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রথমবার দেখান যে খুব সাধারণ spin coating পদ্ধতি ব্যবহার করেও পেরোভস্কাইট nanoparticle তৈরি করা সম্ভব। এটি ছিল একটি মৌলিক আবিষ্কার। এখানে লক্ষ্য ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের দক্ষতা নয়, বরং বোঝা—পেরোভস্কাইট–এর গঠন আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি কি না। এই প্রশ্নের উত্তর ছিল “হ্যাঁ”।
(২) দ্বিতীয় ধাপ: বাতাসে টিকে থাকার লড়াই (২০২১ থেকে ২০২৪ এর গবেষণা)) প্রথম ধাপ সফল হওয়ার পর বিজ্ঞানীদের সামনে এল আরও বড় প্রশ্ন—এই সুন্দর গঠন কি বাস্তব পৃথিবীতে টিকে থাকবে? আগের সমস্যা ছিল, পেরোভস্কাইট বাতাসে খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তাই গবেষণাগারে এটি বানাতে হতো বন্ধ ঘরে, যেখানে বাতাস ঢোকে না। কিন্তু বাস্তব জীবনে তো সৌরকোষ থাকবে খোলা বাতাসেই। এই ধাপে বিজ্ঞানীরা আবার ionic liquid–এর দিকে ফিরে তাকান, কিন্তু এবার ভিন্নভাবে। তারা দেখান যে ionic liquid শুধু কণা বানাতে সাহায্য করে না, এটি perovskite–এর গায়ে এক ধরনের অদৃশ্য ঢাল তৈরি করে। এই ঢাল বাতাসের আর্দ্রতা ও পানিকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়। এখানে বিজ্ঞানীরা bar coating–এর মতো নতুন coating পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এটি অনেকটা দেয়ালে রং করার মতো—একটি ধাতব দণ্ড দিয়ে তরলটিকে সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে বড় আকারে পেরোভস্কাইট পাত তৈরি করা সম্ভব হয়, যা শিল্পকারখানার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণ বাতাসে বানানো পেরোভস্কাইট ফিল্ম অনেক দিন টিকে থাকে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাও প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। এটি পেরোভস্কাইট গবেষণায় একটি বড় সাফল্য ছিল, কারণ এখানে বিজ্ঞানীরা প্রথমবার দেখান—glove box ছাড়া পেরোভস্কাইট বানানো সম্ভব।
(৩) তৃতীয় ধাপ: সবকিছুকে একত্রিত করা (ল্যাব থেকে ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তর): ২০২৫ শেষ গবেষণাটি হলো এই যাত্রার সবচেয়ে পরিণত ধাপ। এখানে বিজ্ঞানীরা আগের দুই ধাপের শিক্ষা একসাথে ব্যবহার করেন। এবার তারা perovskite nanoparticle–কে শুধু একটি পরীক্ষামূলক কণা হিসেবে ব্যবহার করেননি। বরং তারা এই nanoparticle–কে “seed” বা বীজ হিসেবে ব্যবহার করেন, যেখান থেকে পুরো পেরোভস্কাইট ফিল্ম ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।

জাপানের একটি কনসোর্টিয়াম বর্তমানে ইয়োকোহামা শহরের ওসানবাশি পিয়ারে হালকা ওজনের,
নমনীয় পেরোভস্কাইট সোলার মডিউলগুলোর স্থায়িত্ব ও কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করছে।
প্রবল বাতাস ও লবণাক্ত বাতাসের পরিবেশে এই পরীক্ষামূলক স্থাপনাটি করা হয়েছে,
যাতে কঠিন আবহাওয়ায় প্রযুক্তিটির কার্যকারিতা যাচাই করা যায়।
এই আউটডোর ট্রায়ালটি পেরোভস্কাইট সোলার প্রযুক্তি নিয়ে চলমান তিন বছরের বৃহত্তর গবেষণা সহযোগিতার একটি অংশ।
ল্যাবের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেইকো কোম্পানি তৈরি করেছে এই নমনীয় পেরোভস্কাইট সোলার মডিউল,
যা আমরা ধাপে ধাপে বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
এটি জাপানের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একটি চলমান প্রকল্প,
যেখানে মূলত আমাদের পেরোভস্কাইটের বীজ-প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে।
পুরো প্রকল্পটি পরিচালনা করছেন ইয়োকোহামার টোইন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক প্রফেসর মিয়াসাকা।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
এই আবিষ্কারগুলো ভবিষ্যতে এমন সৌরকোষ তৈরি করতে সাহায্য করবে, যা— স্কুলের ছাদে, গ্রামের ঘরে, এমনকি ব্যাগ বা কাপড়ের ওপরও বসানো যেতে পারে।এগুলো হবে হালকা, সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব। সবচেয়ে বড় কথা, এই গবেষণাগুলো বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের একটি বার্তা দেয়—বিজ্ঞান মানে শুধু বই মুখস্থ করা নয়, বিজ্ঞান মানে পৃথিবীর সমস্যার সমাধান খোঁজা।
দূর গ্রামের এক ছেলের গল্প: ড. শাহিদুজ্জামান সোহেল ও বৈজ্ঞানিক স্বপ্নের যাত্রা
উপরের এতসব বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডের পিছনে যে বিজ্ঞানী কাজ করছেন, তিনি কিন্তু আমাদের বাংলাদেশেরই ছেলে। বিজ্ঞান সব সময় বড় শহর, আধুনিক ল্যাব কিংবা দামি যন্ত্রপাতি থেকে শুরু হয় না। অনেক সময় বিজ্ঞান শুরু হয় একটি দূর গ্রামের ছোট ঘর থেকে, যেখানে বিদ্যুৎ ঠিকমতো আসে না, ইন্টারনেট নেই, কিন্তু আছে অদম্য কৌতূহল আর জানার তীব্র আগ্রহ। ড. শাহিদুজ্জামান সোহেলের গল্প ঠিক এমনই একটি গল্প। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা ড. সোহেলের শৈশব খুব সহজ ছিল না। চারপাশে ছিল সীমাবদ্ধতা—সুবিধার অভাব, শিক্ষার সুযোগ কম, আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার উপায় প্রায় নেই। কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেই ছিল একটি শক্তি—প্রশ্ন করার সাহস। তিনি ছোটবেলা থেকেই জানতে চাইতেন, “কেন এমন হয়?”, “এটা কীভাবে কাজ করে?”, “এর ভেতরে আসলে কী আছে?” এই প্রশ্ন করার মানসিকতাই একজন মানুষকে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীর পথে নিয়ে যায়।

বামে ড. শাহিদুজ্জামান সোহেল
এবং ডানে Prof Miyasaka
(পেরোভস্কাইট সোলার গবেষনার পাইয়োনিয়ার), ওসাকা, জাপান।
কৌতূহল থেকে গবেষণা—একটি দীর্ঘ পথ ড. শাহিদুজ্জামান সোহেলের জীবনে বিজ্ঞান কখনো হঠাৎ এসে ধরা দেয়নি। এটি ছিল দীর্ঘ সময়ের কঠোর পরিশ্রম, ব্যর্থতা, আবার নতুন করে শুরু করার গল্প। নতুন বিষয় বুঝতে গিয়ে বহুবার তাঁকে এমন গবেষণার মুখোমুখি হতে হয়েছে, যেখানে চারপাশের সবাই বলেছে—“এটা খুব কঠিন”, “এটা হয়তো সম্ভব না”। কিন্তু একজন প্রকৃত বিজ্ঞানী কখনো প্রশ্ন থেকে পালিয়ে যায় না। ড. শাহিদুজ্জামান সোহেলও যাননি। Perovskite solar cell, ionic liquid, nanoparticle—এই শব্দগুলো আজ সহজ শোনালেও, একসময় এগুলো ছিল একেবারে নতুন ও অনিশ্চিত গবেষণাক্ষেত্র। অনেক প্রশ্নের উত্তর তখনো পৃথিবীর কেউ জানত না। তিনি চেষ্টা করেছেন বুঝতে—কেন পেরোভস্কাইট বাতাসে নষ্ট হয়ে যায়, কীভাবে কণার গঠন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আর কীভাবে এই প্রযুক্তিকে বাস্তব জীবনের জন্য উপযোগী করা যায়। এই বোঝার চেষ্টাই তাঁকে নিয়ে গেছে এক গবেষণা থেকে আরেক গবেষণায়।

কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট তাকাশি ওয়াদা
(দ্বিতীয় সারিতে দাড়ান সর্ববামে) এর সাথে ড. শাহিদুজ্জামান সোহেল এবং তার সহকর্মীরা।
তিনটি গবেষণা, একটি দর্শন
ড. শাহিদুজ্জামান সোহেল ও তাঁর দলের গবেষণাগুলো শুধু প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়, এগুলো একটি দর্শনের প্রতিফলন। সেই দর্শনটি হলো—সমস্যাকে ভয় না পাওয়া, বরং ধৈর্য নিয়ে ভেঙে ভেঙে বোঝা। প্রথম গবেষণায় তিনি শিখেছেন কীভাবে পেরোভস্কাইট–এর গঠন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দ্বিতীয় গবেষণায় তিনি বুঝেছেন বাস্তব পৃথিবীতে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ। আর তৃতীয় গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে এই সব জ্ঞান একসাথে ব্যবহার করে ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী সমাধান তৈরি করা যায়। এটি আমাদের শেখায়, বড় আবিষ্কার কখনো একদিনে হয় না। এটি হয় ধারাবাহিক চিন্তা, ভুল থেকে শেখা, আর না থামার মানসিকতা দিয়ে।

ড. শাহিদুজ্জামান সোহেলের এই সাফল্য শুধু একজন বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত অর্জন নয়। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের বিষয়। কারণ তিনি প্রমাণ করেছেন—বিশ্বমানের বিজ্ঞানী হতে জন্মাতে হয় না উন্নত দেশে,বিশ্বমানের বিজ্ঞানী হতে লাগে বিশ্বমানের মনন। একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও চাইলে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করতে পারে, যদি সে নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখে, ধৈর্য ধরে শিখতে শেখে, আর কঠোর পরিশ্রমকে ভয় না পায়।
ড. শাহিদুজ্জামান সোহেলের জীবন থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—বিজ্ঞান মানে শুধু পরীক্ষার নম্বর বা বই মুখস্থ করা নয়। বিজ্ঞান মানে হলো কৌতূহল, পর্যবেক্ষণ, আর নিজের অজানা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। যদি তুমি আজ একটি প্রশ্ন করো, আর তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে দশবার ভুল করো—তবুও তুমি বিজ্ঞানীর পথেই আছো। যদি তুমি আজ বুঝতে না পারো, কিন্তু আগামীকাল আবার চেষ্টা করো—তবুও তুমি এগিয়ে যাচ্ছো। ড. সোহাইলের জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—পরিস্থিতি তোমাকে সীমাবদ্ধ করতে পারে, কিন্তু তোমার কৌতূহল যদি মুক্ত থাকে, তাহলে ভবিষ্যৎও মুক্ত হবে।
আজ যে perovskite solar cell নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, আগামী দিনে হয়তো তার চেয়েও বড় কোনো সমস্যা সমাধান করবে তোমাদের কেউ। হয়তো সেই বিজ্ঞানীও আসবে বাংলাদেশের কোনো দূর গ্রামের স্কুল থেকে। তাই প্রশ্ন করো, জানতে চাও, ভুল করতে ভয় পেও না। বিজ্ঞান ঠিক তখনই শুরু হয়, যখন তুমি বলো—“আমি এটা বুঝতে চাই।” ড. শাহিদুজ্জামান সোহেলের গল্প আমাদের দেখায়—পরিশ্রম, কৌতূহল আর বৈজ্ঞানিক মন থাকলে, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই বিশ্বমানের আবিষ্কার সম্ভব।
তথ্যসূত্র
১. Ionic liquid-assisted growth of methylammonium lead iodide spherical nanoparticles by a simple spin-coating method and photovoltaic properties of perovskite solar cells† Check for updates, M. Shahiduzzaman, Kohei Yamamoto, Yoshikazu Furumoto, Takayuki Kuwabara, Kohshin Takahashiab and Tetsuya Taima
২. ACS Applied Materials & Interfaces, Vol 13/Issue 18 “Ionic Liquid-Assisted MAPbI3 Nanoparticle-Seeded Growth for Efficient and Stable Perovskite Solar Cells” Md. Shahiduzzaman, LiangLe WangShoko, FukayaErsan, Y. MuslihAtsushi, KogoMasahiro Nakano, Makoto KarakawaKohshin, Takahashi, Koji Tomita, Jean-Michel Nunzi, Tsutomu Miyasaka, Tetsuya Taima




Leave a comment