চুল পড়ছে—এই বাক্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষের মাথার ভেতরে শুরু হয় এক অদ্ভুত ঝড়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একেক দিন একেক রকম চোখে নিজেকে দেখা, ইন্টারনেটে হঠাৎ করে “বাল্ডিং স্টেজ” সার্চ করা, কিংবা সেলুনে গিয়ে নীরব উৎকণ্ঠায় চুল কাটানো—এই অভিজ্ঞতা অনেকেরই পরিচিত। অথচ বাস্তবতা হলো, চুল পড়া নিয়ে বাজারজুড়ে এত ভিন্ন ভিন্ন মত, পণ্য আর ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন যে সত্য-মিথ্যা আলাদা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই বিভ্রান্তির মাঝখানেই এক ফরাসি উদ্যোক্তার মাথায় জন্ম নেয় একটি ধারণা, যা আজ রূপ নিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক এক অ্যাপে—MyHair AI।
নিউইয়র্কের একটি সেলুনে সাধারণ এক চুল কাটাতে গিয়েছিলেন সিরিয়াক লেফর্ট। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩২। হেয়ারড্রেসার হঠাৎ তাঁকে বলে বসেন, চুল নাকি পাতলা হয়ে যাচ্ছে। মজার বিষয়, পাশের বন্ধুকে সে একই কথা বলেনি। ওই মুহূর্তে লেফর্ট নিজের ভেতর দ্বন্দ্বে পড়েন। তিনি নিজে তো কখনো ভাবেননি চুল পড়ছে, তবু যখন কেউ নিশ্চিত কণ্ঠে বলে বসে, তখন সন্দেহ ঢুকে পড়ে মনে। সেই সন্দেহ থেকেই তিনি কিনে ফেলেন দামি এক শ্যাম্পু। পরে তিনি উপলব্ধি করেন, কেবল “চুল পড়ছে” এই আশঙ্কাটুকুই অনেক সময় মানুষকে যেকোনো পণ্য কিনতে বাধ্য করে। পরে এক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, আসলে তাঁর চুল পড়ছেই না। কিন্তু ততদিনে তিনি বুঝে ফেলেছেন—এই পুরো শিল্পটি আবেগের উপর দাঁড়িয়ে আছে, আর আবেগের সুযোগ নিয়ে এখানে বিভ্রান্তির কোনো অভাব নেই।
এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় আরও গভীরে। তিনি খুঁজতে শুরু করেন কেন চুল পড়া নিয়ে এত ভিন্ন মত, কেন প্রতিটি ক্লিনিক নিজেকে সেরা দাবি করে, আর কেন অনলাইনে অসংখ্য ভুয়া রিভিউ ঘুরে বেড়ায়। তখনই তাঁর মাথায় আসে, যদি নিরপেক্ষভাবে একটি প্রযুক্তি বলে দিতে পারে আসল সত্যটা, তাহলে কেমন হয়? এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় MyHair AI—একটি অ্যাপ, যা আপনার মাথার ছবি বিশ্লেষণ করে বলবে সত্যিই চুল পড়ছে কি না।
লেফর্ট ও তাঁর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ২৮ বছর বয়সি টিলেন বাবনিক দু’জনই প্রযুক্তি স্টার্টআপ জগতের মানুষ। তাঁরা মাত্র কয়েক সপ্তাহে所谓 “ভাইব কোডিং” করে অ্যাপের প্রথম সংস্করণ তৈরি করেন। ব্যবহারকারীর কাজ খুব সহজ—মাথার কয়েকটি ছবি তুলে অ্যাপে আপলোড করতে হবে। এরপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে চুলের ঘনত্ব মাপে, পাতলা হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ খুঁজে দেখে এবং সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন ট্র্যাক করে। ফলে আপনি বুঝতে পারেন—তিন মাসে, ছয় মাসে বা এক বছরে আপনার চুলের অবস্থা কোথায় দাঁড়াচ্ছে।
এই প্রযুক্তির মেরুদণ্ড একটি বিশেষ এআই মডেল, যা প্রশিক্ষণ পেয়েছে তিন লাখেরও বেশি স্ক্যাল্প ও চুলের ছবির উপর। সাধারণ একটি ভাষাভিত্তিক এআই নয়, বরং বিশেষভাবে চুল বিশ্লেষণের জন্য তৈরি এই মডেল চুলের গঠন, ঘনত্ব আর হেয়ারলাইন দেখে একটি মেডিক্যালি-ইনফর্মড মত দেয়। আতঙ্কে গুগল সার্চ করার চেয়ে কিংবা সেলুনের অনুমানের উপর ভরসা রাখার বদলে, এখানে আপনি পান একটি ডেটা-ভিত্তিক বিশ্লেষণ।
আজ MyHair AI-এর ব্যবহারকারী দুই লাখের বেশি, আর প্রিমিয়াম সাবস্ক্রাইবার এক হাজারের উপরে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, কিছু ক্লিনিকও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে রোগী দেখার প্রাথমিক মূল্যায়ন দ্রুত করার জন্য। অ্যাপটি ইতিমধ্যে তিন লাখেরও বেশি স্ক্যাল্প ছবি বিশ্লেষণ করেছে। সম্প্রতি খ্যাতনামা ডার্মাটোলজিস্ট ড. টেস কোম্পানিটির বোর্ডে যোগ দিয়েছেন, যা এই উদ্যোগের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
অ্যাপটি শুধু সমস্যার জানান দেওয়াতেই থেমে থাকে না। এটি ব্যবহারকারীর চুলের ধরণ অনুযায়ী ব্যক্তিগত যত্নের রুটিন সাজেস্ট করে, সম্ভাব্য পণ্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয় এবং এমনকি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথাও জানায়। অর্থাৎ, কোন শ্যাম্পু বা সিরাম কেন উপযোগী বা অনুপযোগী—তার পেছনের যুক্তিটাও বোঝায় এআই। লেফর্টের ভাষায়, “আমরা এই ৫০ বিলিয়ন ডলারের বাজারে স্বচ্ছতা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের নির্ভুলতা আনতে চাই।”
চুল পড়ার বিষয়টি শুধু সৌন্দর্যগত নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত। অনেকেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, সামাজিক আড়ষ্টতা বাড়ে। এআই যখন এখানে নিরপেক্ষ এক ‘ডাক্তারি মত’ দিতে পারে, তখন অনেকের ভয়, দ্বিধা আর দুশ্চিন্তা কমে আসার সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার মতো দেশে, যেখানে চুল পড়া নিয়ে সামাজিক চাপ কম নয়, সেখানে এমন প্রযুক্তি মানসিক স্বস্তির এক নতুন দরজা খুলে দিতে পারে।
অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যায়—চিকিৎসকের বিকল্প কি এআই হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কখনো একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার বদলি নয়; বরং এটি একটি প্রাথমিক স্ক্রিনিং টুল। সন্দেহ হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডার্মাটোলজিস্টের শরণ নেওয়ার পরামর্শ থেকেই যায়। তবু প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক তথ্য পাওয়া মানে ভুল পথে টাকা ও সময় নষ্ট না করা।
লেফর্টের মতে, পুরুষদের স্বাস্থ্যের দুটো বড় উদ্বেগ—যৌন সমস্যা আর চুল পড়া। MyHair AI এখন অন্তত একটির ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগ্রস্ত সমাধান দিতে চায়। ভবিষ্যতে তারা অ্যাপে ক্লিনিক বুকিং, সরাসরি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগসহ আরও ফিচার যোগ করতে চায়, যাতে এআই সত্যিই “বাস্তব পৃথিবীতে” কাজ করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি আপনার কাছেই—আপনি কি আপনার চুলের ভাগ্য জানতে একটি এআই-এর শরণ নেবেন? জনসমক্ষে কথা না বলে, লজ্জা ছাড়াই, কেবল একটি স্মার্টফোনের ক্যামেরায় যদি পাওয়া যায় নিরপেক্ষ সত্য, তবে অনেকের কাছেই এটি হতে পারে নতুন ভরসার জায়গা। আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন শুধু ছবি আঁকে না, কবিতা লেখে না—সে আমাদের আত্মবিশ্বাসের একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশও ফিরে এনে দিতে চাইছে।
তথ্যসূত্র: https://techcrunch.com/2025/11/26/are-you-balding-theres-an-ai-for-that/

Leave a comment