ড. মশিউর রহমান
এক সন্ধ্যায় ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখে পড়ল এক অচেনা মানুষের পোস্ট। সেখানে লেখা, একটি লেবু আর এক চিমটি লবণ নাকি ক্যানসার সারিয়ে দিতে পারে। পোস্টের নিচে হাজার হাজার লাইক, শত শত শেয়ার, চোখে জল আনা মন্তব্য। কয়েক স্ক্রল নিচে আরেকটি পোস্টে লেখা—টিকা নিলে নাকি মানুষ বন্ধ্যা হয়ে যায়। সেখানেও একই উন্মাদনা। তখন মনে হলো, এই বিশাল ডিজিটাল ভিড়ের মধ্যে সত্য আর মিথ্যার লড়াইটা কত নীরব, অথচ কত ভয়ংকর।
বিশ্বজুড়ে আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের উপস্থিতি অভূতপূর্ব। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২4 সালে পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ছিল প্রায় ৫ বিলিয়ন, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬২ শতাংশ। গড়পড়তা একজন ব্যবহারকারী প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় দিচ্ছেন ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিটের মতো। বাংলাদেশেও চিত্রটি আলাদা নয়। দেশে সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন প্রায় ৬ কোটিরও বেশি। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রায় প্রতি তিনজনের একজন এখন নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তথ্য গ্রহণ করছে। এই বিশাল জনস্রোতের মধ্যে বিজ্ঞানকে পৌঁছানো মানে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছানো।
কিন্তু বিপদটা লুকিয়ে আছে গতি আর অগভীরতার মিলনে। গবেষণা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য সত্যের তুলনায় প্রায় ছয় গুণ দ্রুত ছড়ায়। একটি বহুল উদ্ধৃত এমআইটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভুল সংবাদ সাধারণ সত্যের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি রিটুইট হয়। কারণ মিথ্যা সাধারণত বেশি নাটকীয়, বেশি ভয়ের, বেশি চমকপ্রদ। আর মানুষের আবেগ যত বেশি নাড়া পায়, ক্লিক ও শেয়ারের গতি তত বেড়ে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের শিরোনাম যত বেশি চমকপ্রদ হয়, ঠিক ততটাই বেশি ভুল ব্যাখ্যার আশঙ্কা থাকে।
স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এই বিভ্রান্তির সবচেয়ে বড় শিকার। কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিস্থিতিকে বলেছিল “ইনফোডেমিক”—অর্থাৎ ভাইরাসের পাশাপাশি ছড়াচ্ছে ভয়ংকর তথ্যসংক্রমণ। এক বৈশ্বিক সমীক্ষায় দেখা যায়, মহামারির সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ভুয়া তথ্যের প্রভাবে প্রায় ৬ জনের ১ জন মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—যার মধ্যে অনেকেই প্রয়োজনীয় টিকা নিতে দেরি করেছেন বা একেবারেই নেননি। যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে টিকা–বিরোধী পোস্ট যাঁরা নিয়মিত দেখতেন, তাঁদের মধ্যে টিকা নেওয়ার অনীহা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ছিল।
বিজ্ঞানের আরেকটি সংকট হলো, সোশ্যাল মিডিয়া তথ্য যাচাইয়ে মানুষকে অলস করে তুলছে। একটি আন্তর্জাতিক জরিপ বলছে, প্রায় ৫৮ শতাংশ ব্যবহারকারী কোনো খবর পড়ার পর সেটি অন্য কোথাও যাচাই করেন না। শেয়ার হয় আগে, ভাবনা আসে পরে। এই প্রবণতা বিজ্ঞানের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক, কারণ বিজ্ঞান চর্চা মানেই সন্দেহ করা, পরীক্ষা করা, উৎস খোঁজা। সোশ্যাল মিডিয়া সেই অভ্যাসের ঠিক উল্টোটা শেখায়—দেখলাম, ভালো লাগল, শেয়ার করলাম।
তবু এই অরণ্যের মধ্যে আলোও আছে। গবেষণা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যদি বিজ্ঞানসম্মত ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট নিয়মিত দেওয়া যায়, তাহলে মানুষের আচরণ বদলানো সম্ভব। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ব্যবহারকারী নিয়মিত বিজ্ঞানভিত্তিক পেজ বা চ্যানেল অনুসরণ করেন, তাঁদের মধ্যে ভুয়া তথ্য বিশ্বাস করার প্রবণতা প্রায় ৩০ শতাংশ কম। বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে, যেসব ক্যাম্পেইন বিজ্ঞানীদের সরাসরি অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়েছে, সেখানে স্বাস্থ্যগত সচেতনতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রচারণার পর কয়েকটি অঞ্চলে টিকা গ্রহণের হার ১০–১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে—যা প্রমাণ করে, সোশ্যাল মিডিয়া শুধু বিভ্রান্তির জায়গা নয়, এটি পরিবর্তনের হাতিয়ারও হতে পারে।
কিন্তু এখানেই বিজ্ঞানীর জন্য আরেকটি বিপদ অপেক্ষা করছে—বিজ্ঞানের ওপর ভর করে ব্র্যান্ড বানানোর নেশা। ক্লিকবেইট শিরোনাম, অর্ধেক সত্য, অতিরঞ্জন—এসবের মাধ্যমে অনেকেই নিজেকে “বিজ্ঞানী ইনফ্লুয়েন্সার” বানাচ্ছেন। অথচ এই জনপ্রিয়তার মূল্য দিতে হচ্ছে সত্যকে। গবেষণা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের শিরোনাম যত বেশি চমকপ্রদ হয়, ঠিক ততটাই বেশি ভুল ব্যাখ্যার আশঙ্কা থাকে। এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভুলভাবে উপস্থাপিত বৈজ্ঞানিক তথ্যযুক্ত ভিডিওগুলোর ভিউ সংখ্যা সঠিক তথ্যভিত্তিক ভিডিওর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতার হার এখনো সীমিত, সেখানে এই ঝুঁকি আরও বড়। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, অনেক উন্নয়নশীল দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক মৌলিক জ্ঞানের ঘাটতি আছে জনসংখ্যার বড় অংশের মধ্যেই। এই প্রেক্ষাপটে যদি বিজ্ঞানীরা সোশ্যাল মিডিয়া ছেড়ে দেন, তবে মাঠ খালি পড়ে থাকে অপেশাদার, গুজববাণিজ্যকারী আর ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিক্রেতাদের জন্য।

ভুলভাবে উপস্থাপিত বৈজ্ঞানিক তথ্যযুক্ত ভিডিওগুলোর ভিউ সংখ্যা সঠিক তথ্যভিত্তিক ভিডিওর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
তাই আজকের বিজ্ঞানীর দায়িত্ব দ্বিমুখী। একদিকে তাঁকে গবেষণাগারের কঠিন ভাষা থেকে বেরিয়ে মানুষের ভাষায় কথা বলতে হবে, অন্যদিকে তাঁকে তথ্যের শালীনতা রক্ষা করতে হবে। তাঁকে জনপ্রিয় হতে হবে, কিন্তু বিক্রি হতে হবে না। এই ভারসাম্যই সবচেয়ে কঠিন শিল্প।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা সহজ হলেও ভারী—আপনি কি এই ভিড়ে সত্যের পক্ষে দাঁড়াবেন, না নীরব থেকে মিথ্যার পথ প্রশস্ত করবেন? আপনার একটি পোস্ট হয়তো কারও জীবন বাঁচাতে পারে, আবার আপনার নীরবতা কারও ক্ষতির কারণও হতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়া কোনো ল্যাবরেটরি নয়, কিন্তু আজ এটি মানুষের সবচেয়ে বড় শ্রেণিকক্ষ। সেখানে যদি বিজ্ঞানের ভাষা না থাকে, তাহলে সেখানে ভয় আর গুজবই পড়ানো হবে। আর যদি বিজ্ঞানীরা সেখানে সাহস নিয়ে কথা বলেন, তবে এই ডিজিটাল গোলযোগের ভেতরেও সত্য একটি পথ খুঁজে নেবে।
আজকের দুনিয়ায় সম্ভবত সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক কাজ নতুন আবিষ্কার নয়, বরং সত্যকে পৌঁছে দেওয়া।

Leave a comment