ইন্টারনেটে তথ্য খোঁজার ধরন আমরা যতটা ভাবি তার চেয়ে দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একসময় তথ্য খোঁজার মানেই ছিল গুগল খোলা, কীওয়ার্ড টাইপ করা, তারপর চোখের সামনে ভেসে ওঠা লিংকগুলোর মধ্যে থেকে সেরা পছন্দটি বেছে নেওয়া। কয়েক বছর আগেও এটি ছিল একধরনের অভ্যাস—যেন সংবাদপত্রের পাতায় খবর খোঁজার মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রযুক্তির জগতে আর কিছুই স্থির থাকে না। এখন গুগলের সেই নিরঙ্কুশ আধিপত্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে এক নতুন মাধ্যম—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কথোপকথন সহায়ক বা এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট।
আমরা অনেকেই এখন গুগলে না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করি ChatGPT-কে, অথবা বাড়ির এক কোণে রাখা স্মার্ট স্পিকারের দিকে তাকিয়ে বলি, “Alexa, আমাকে বলো কোন ব্র্যান্ডের স্মার্টওয়াচ ভালো হবে।” এই পরিবর্তন কেবল একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং এটি একটি অভ্যাসের পরিবর্তন—যেখানে ব্যবহারকারী আর শত শত লিংক ঘেঁটে তথ্য খোঁজার ধৈর্য হারাচ্ছে। সে চায় সরাসরি, সংক্ষিপ্ত ও প্রাসঙ্গিক উত্তর।
২০২৫ সালের জুন মাসে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান এই পরিবর্তনের মাত্রা বোঝাতে যথেষ্ট। ওই মাসেই শীর্ষ এক হাজার ওয়েবসাইটে এআই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে পৌঁছেছে প্রায় এক দশমিক তেরো বিলিয়ন ভিজিট। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যা বেড়েছে ৩৫৭ শতাংশ। এর মধ্যে আবার চ্যাটজিপিটির অবদানই ৮০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ, অনলাইন ট্রাফিকের নতুন বড় অংশ আসছে এমন একটি উৎস থেকে, যা গুগল নয়, বরং কথোপকথনভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে সংবাদ ও মিডিয়া সাইটগুলোতে। এক বছরে তাদের এআই-উৎস ট্রাফিক বেড়েছে ৭৭০ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, এখন একজন পাঠক কোনো খবর খুঁজতে গিয়ে গুগল সার্চ বারের বদলে হয়তো সরাসরি চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করছে, “আজকের শীর্ষ বিজ্ঞান সংবাদ কী?” এবং যদি চ্যাটজিপিটি সেই প্রশ্নের উত্তরে আপনার সাইটের নাম না জানে, তাহলে আপনি কার্যত অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেই পাঠকের কাছে।
এখানেই মূল পরিবর্তন—এআই অ্যাসিস্ট্যান্টরা ওয়েবসাইটের তালিকা সাজায় না এলোমেলোভাবে। তাদের পেছনে থাকে জটিল অ্যালগরিদম ও শেখার প্রক্রিয়া। তারা অনলাইন কনটেন্ট স্ক্যান করে, প্রাসঙ্গিকতা যাচাই করে, এবং সিদ্ধান্ত নেয় কোন উৎসটি সবচেয়ে সহায়ক হতে পারে। গুগলে যেখানে আপনার সাইট হয়তো শততম ফলাফলেও আসতে পারে, সেখানে এআই উত্তর দেয় হাতে গোনা কয়েকটি বিকল্পের মধ্যে। এবং সেই তালিকায় না থাকলে আপনি আসলে প্রতিযোগিতার বাইরে।
এই পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়েছে নতুন এক মার্কেটিং মেট্রিক—Share of Model। সহজভাবে বললে, এটি মাপার উপায় যে আপনার ব্র্যান্ড বা কনটেন্ট কতটা উপস্থিত এবং কতটা ইতিবাচকভাবে স্থান পেয়েছে চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা লামার মতো বড় ভাষা মডেলের (LLM) মধ্যে। একে আপনি গুগলের SEO র্যাঙ্কিং-এর এক ধরনের সমসাময়িক বিকল্প ভাবতে পারেন। যেমন, কেউ যদি চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করে, “বাংলাদেশের সেরা অনলাইন বিজ্ঞান প্ল্যাটফর্ম কোনটি?”—আপনার প্ল্যাটফর্মের নাম যদি উত্তর আসে, তবে বুঝবেন আপনি সেই মডেলের ‘চেতনার মধ্যে’ আছেন। আর যদি না আসে, তবে যতই ফেসবুক বুস্ট করুন বা SEO অপ্টিমাইজ করুন, এআই-ভিত্তিক এই নতুন যুগে আপনার উপস্থিতি থাকবে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তনকে এখনো আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি না। এখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া হাউসের বেশিরভাগই এখনও SEO, ফেসবুক বিজ্ঞাপন আর ইউটিউব প্রচারণায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু গুগল-নির্ভর যুগ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে এমন এক পর্যায়ে, যেখানে এআই অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে ‘সম্পর্ক গড়া’ হবে মূল কাজ। এই সম্পর্ক মানে কেবলমাত্র চ্যাটজিপিটিতে আপনার ওয়েবসাইটের ঠিকানা থাকা নয়, বরং এমনভাবে উপস্থিত থাকা যে মডেলটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সময় আপনার নাম প্রস্তাব করে।
এখানে একটি বড় ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন। অনেকে ভাবেন, এআই মডেলগুলি ইন্টারনেট থেকে সব জেনে নেয়, তাই আলাদা করে কিছু করার নেই। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এত সরল নয়। এই মডেলগুলোর শেখা সীমাবদ্ধ তাদের প্রশিক্ষণ ডেটা এবং আপডেট ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে। অনেক সময় তারা নতুন তথ্য পায় না যদি না সেটি বিশ্বস্ত উৎস থেকে সরবরাহ করা হয় বা এমনভাবে অনলাইনে উপস্থিত থাকে যে মডেলটি তা গ্রহণ করতে পারে। ফলে আপনি যতই ভালো কনটেন্ট বানান না কেন, যদি সেটি এআই-এর নাগালে না যায়, তবে তার অস্তিত্ব যেন অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে—তাহলে কীভাবে এআই-এর কাছে পরিচিত হওয়া যায়? উত্তরটি প্রযুক্তি ও কৌশলের সমন্বয়ে গড়া। কনটেন্ট হতে হবে স্পষ্ট, তথ্যনির্ভর এবং প্রাসঙ্গিক। আপনার ওয়েবসাইটে থাকতে হবে এমন প্রযুক্তিগত কাঠামো, যা এআই সহজে পড়তে ও বুঝতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন Structured Data ও Schema Markup ব্যবহার করছে, যাতে কনটেন্টের ধরন এআই বা সার্চ ইঞ্জিন স্পষ্টভাবে চিনতে পারে। একই সঙ্গে উৎস উল্লেখ, গবেষণাভিত্তিক তথ্য এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ কনটেন্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়।
এই প্রেক্ষাপটে মিডিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জ আরও জটিল। তারা এখনো লড়াই করছে গুগল র্যাঙ্কিং, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদম এবং বিজ্ঞাপন আয়ের ওঠানামার সঙ্গে। এর মধ্যে এলো এআই-চালিত কন্টেন্ট রেফারেল সিস্টেম। যদি তারা দ্রুত এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারে, তাহলে পাঠক প্রবাহ হারিয়ে যাবে এমন এক জগতে, যেখানে এআই অ্যাসিস্ট্যান্টই প্রধান দ্বাররক্ষক।
প্রশ্ন উঠতে পারে—এটি কি গুগলের অবসান ঘোষণা করছে? না, অন্তত এখনই নয়। গুগল এখনও বিশাল ব্যবহারকারীভিত্তি ধরে রেখেছে এবং সার্চ ইঞ্জিনের বাজারে তার প্রভাব অপরিসীম। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের তথ্য খোঁজার অভ্যাস বদলাচ্ছে, এবং এই পরিবর্তনের গতি অনেক দ্রুত। ঠিক যেমন একসময় ইয়াহু বা অলটাভিস্টার মতো সার্চ ইঞ্জিন হারিয়ে গিয়েছিল গুগলের আধিপত্যে, তেমনি ভবিষ্যতে হয়তো তথ্য অনুসন্ধানের প্রাথমিক দ্বারপাল হয়ে উঠবে এআই অ্যাসিস্ট্যান্টরা।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দিকও আছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যবসা, অনলাইন শিক্ষা, ই-কমার্স, এমনকি সংবাদমাধ্যম—সবই এখন এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার অংশ। আপনার পাঠক বা গ্রাহক হয়তো ঢাকার উত্তরায়, কিন্তু একই সময়ে সে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক বা সিডনির কনটেন্টও সমান সহজে পাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন কেবল কনটেন্টের গুণমান নয়, বরং সেই কনটেন্টকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সঠিক প্রযুক্তিগত কৌশল। এআই মডেলের ভেতরে উপস্থিত থাকা এখন সেই কৌশলের কেন্দ্রীয় অংশ হয়ে উঠছে।
যদি আমরা এই নতুন বাস্তবতাকে অবহেলা করি, তাহলে পরিণতি হবে নির্মম। হয়তো আপনি প্রতিদিন শত শত নতুন আর্টিকেল লিখছেন, হাজার হাজার টাকা খরচ করছেন বিজ্ঞাপনে, কিন্তু একজন সম্ভাব্য পাঠক যখন চ্যাটজিপিটিকে কিছু জিজ্ঞেস করছে, তখন আপনার কনটেন্টের নাম একবারও আসছে না। তখন আপনি যেন এক জনাকীর্ণ বাজারে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু আপনার দোকানের সামনে কোনো ক্রেতা থামছে না—কারণ তারা জানেই না আপনার অস্তিত্ব আছে।
এমন পরিস্থিতি এড়াতে হলে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এটি কেবল প্রযুক্তিগত টিমের দায়িত্ব নয়, বরং সম্পাদক, বিপণন বিশেষজ্ঞ, কনটেন্ট নির্মাতা—সবাইকে বুঝতে হবে যে এআই-চালিত ট্রাফিক এখন ডিজিটাল দৃশ্যপটের অপরিহার্য অংশ। ভবিষ্যতের গ্রাহক বা পাঠক খোঁজ করবে না লিঙ্কের ভিড়ে, বরং চাইবে তাৎক্ষণিক, সংক্ষিপ্ত ও নির্ভুল উত্তর। আর সেই উত্তরে আপনার নাম না থাকলে, আপনি প্রতিযোগিতা থেকেই বাদ পড়বেন।
অতএব, আমাদের প্রশ্ন এখন আর “গুগলে আমরা কত নম্বরে?” নয়। বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত, “চ্যাটজিপিটি কি আমাদের চিনে?” অথবা, “জেমিনি কি আমাদের নাম বলবে?” এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে আগামী দশকে কে এগিয়ে থাকবে আর কে হারিয়ে যাবে। ডিজিটাল দুনিয়ায় টিকে থাকার এই নতুন লড়াইতে, Share of Model কেবল একটি মেট্রিক নয়—এটি হবে ব্র্যান্ডের অস্তিত্বের প্রমাণপত্র।
আজকের দিনে যে প্রতিষ্ঠান বা প্ল্যাটফর্ম এই পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নেবে, তারা শুধু বেঁচে থাকবে না, বরং এগিয়ে যাবে। আর যারা ভাববে, “এখনও সময় আছে,” তাদের জন্য হয়তো সেই সময় আর কখনোই ফিরে আসবে না।

Leave a comment