সম্পাদকীয়

শিক্ষার্থী জীবনে যে দশটি কাজ করতেই হবে

Share
Share

ড. মশিউর রহমান

আজকের এই লেখাটি লিখছি আমার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শেখা যা অনেক ধাক্কায় শিখেছি। জীবনে চলার পথে ধাক্কা খেয়ে শেখা এই মৌলিক জিনিসগুলো আজকে শেয়ার করছি আমার শিক্ষার্থীদের জন্য।

১. ইনকাম এবং পার্সোনাল মানি ম্যানেজমেন্ট:

তুমি কোটিপতির সন্তান হলেও — স্টুডেন্ট লাইফে তোমাকে কিছু না-কিছু ইনকাম করতেই হবে। নিজের স্কিল, নিজের মেধা, নিজের শ্রম দিয়ে অল্প হলেও ইনকাম করার চেষ্টা করতে হবে। এতে রেস্পন্সিবিলিটি কিভাবে নিতে হয়, অন্যকে কিভাবে সার্ভ করতে হয়, কাজ দিয়ে হ্যাপি রাখতে হয়—এসব শিখবে। এই ইনকাম টিউশনি দিয়ে, কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে, পার্টটাইম চাকরি, ভিডিও এডিটিং, ডিজাইন, ওয়েবসাইট তৈরি, কনটেন্ট রাইটিং, এফিলিয়েট মার্কেটিং, এফ-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং, বা অন্য কোনও কিছু দিয়ে হতে পারে। তারপর নিজের পকেট খরচ নিজে চালানোর চ্যালেঞ্জ নিবে। এতে পার্সোনাল ফাইন্যান্স এবং মানি ম্যানেজমেন্ট—এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেসন ঠেকে ঠেকে শিখবে যেটা কোনো ভার্সিটি তোমাকে শেখাবে না।

২. বেসিক কমিউনিকেশন স্কিল:

তুমি দেশের সেরা ভার্সিটি বা সবচেয়ে খারাপ কলেজে পড়ো না কেন—ইংরেজি নরমাল কথা-বাত্তা চালিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেই হবে। নিজের সম্পর্কে বা কোনো একটা টপিক সম্পর্কে এক দেড় পাতা ইংরেজিতে লেখার যোগ্যতা তৈরি করতে হবে। কেউ ইংরেজিতে একটা ইমেইল বা মেসেজ দিলে সেটার reply দিতে জানতে হবে। ইউটিউব বা অন্য কোথাও ইংরেজি টিউটোরিয়াল দেখে বুঝতে পারার সামর্থ্য লাগবেই লাগবে। প্রচুর ফ্রি কোর্স আছে ইংরেজিতে—সেগুলো দেখে বুঝতে এবং কাজে লাগানোর অ্য়াবিলিটি তৈরি করতে হবে।

৩. ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট / লিডারশীপ:

বন্ধুদের ঘুরতে যাওয়া হোক কিংবা ক্যাম্পসে কোনো ইভেন্ট—এটা ইফতার পার্টি, বৈশাখী মেলা, rag পার্টি, জব ফেয়ার, এলামনাই রিউনিয়ন—যেটাই হোক, তোমাকে ইভেন্টের একজন মেইন অর্গানাইজার হতেই হবে। তাহলে তুমি বুঝবে কিভাবে বিভিন্ন ধরনের মানুষ হ্যান্ডেল করতে হয়, কিভাবে বাজেট করতে হয়, প্ল্যানিং করতে হয়, মানুষের কাছ থেকে হেল্প আদায় করতে হয়। ১৫–২০টা জিনিস একসাথে কম্বাইন করার প্র্যাকটিক্যাল লিডারশীপ ট্রেনিং ফ্রি ফ্রি আর কোথাও পাবা না।
আর একটু বেশি কনফিডেন্ট হতে চাইলে মিনিমাম ৫০ জন মানুষের সামনে বক্তৃতা, ডিবেট, উপস্থাপনা, বা নাচ/গান/নাটক—কিছু পারফর্ম করার চেষ্টা করবে। এতে পাবলিকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় কেটে যাবে।

৪. গুগল সার্চ এবং chatGPT:

কিভাবে ইন্টারনেট থেকে দরকারি জিনিস খুঁজে বের করবে সেই অ্যাবিলিটি তোমাকে তৈরি করতে হবে। লেটেস্ট যে টেকনোলজি (chatGPT) সেটা ইউজ করা জানতে হবে। যাতে তোমার ফিল্ডের কোনো টপিকের রিসার্চ বা অন্য ফিল্ডের কোনো কিছু খুঁজে বের করতে দিলে সেটা খুঁজে বের করতে পারো, গুছিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে পারো। দরকার হলে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বা গুগল স্লাইড দিয়ে প্রেজেন্টেশন বানিয়ে ফেলতে পারলে তো কথাই নেই।
আর তুমি যেই লাইনে পড়ো কেন—কিছু না কিছু সফটওয়্যার তোমার লাগবেই। সেগুলো কিভাবে ইউজ করে, কিভাবে কাজে লাগায় সেটা জানতেই হবে। দরকার হলে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে টিউটোরিয়াল খুঁজে বের করে শিখে ফেলবে।

৫. এরিয়া অফ ইন্টারেস্ট:

তুমি যে সাবজেক্টেই পড়ো না কেন—যে ফিল্ডেই পড়ো না কেন—তোমাকে সেই ফিল্ডের কোনো এক এরিয়াতে তোমার টেক্সটবুক/ক্লাসের পড়ার বাইরে বেশি জানতে হবে। তার জন্য তুমি এক্সট্রা বই পড়তে পারো। নিজের ভিতরে কিউরিওসিটি গ্রো করতেই হবে। তারপর যা যা শিখছো সেগুলো এক একটা করে সামারি লিখতে হবে। সেই সামারি কোথাও না কোথাও পাবলিশ করার চেষ্টা করবে—ডিপার্টমেন্টের ম্যাগাজিনে, বা না পারলে বিশ্বের সেরা পাবলিশার ফেইসবুকে পাবলিশ করে দিবে। দুই-তিনজন বন্ধু টিটকারি মারলেও তুমি কী কী শিখছো সেটা ফেইসবুকে পোস্ট করে দিবে।

৬. বেস্ট ফ্রেন্ড:

তোমার একজন বেস্ট ফ্রেন্ড বানাতেই হবে। একটা ফ্রেন্ড সার্কেল থাকবে; তবে সার্কেলের মধ্যে বা বাইরে তোমার একজন বেস্ট ফ্রেন্ড থাকবেই। যার সঙ্গে মিলে তুমি অনেক কিছু করবে, অনেক জায়গায় যাবে। দুজনের ইন্টারেস্ট লেভেল কাছাকাছি থাকবে। একজন আর একজনকে হেল্প করবে। এই ক্লোজনেস তোমাকে ডাউনটাইমে হেল্প করবে, ফিউচার ঠিক করতে হেল্প করবে। কারণ সব বন্ধুর সাথে সব শেয়ার করা যায় না। বেস্ট বাডি না থাকলে—ইয়ং লাইফে নিজের ভিতরের ইমোশনাল অত্যাচারটা বাড়তি রকমের বেশি হবে।

৭. নেটওয়ার্কিং:

তুমি যে ফিল্ডে কাজ করতে চাও, সেই ফিল্ডের কমপক্ষে দশ জনের সাথে তোমার কানেকশন থাকতে হবে। তারা হতে পারে তোমার সিনিয়র, অন্য ভার্সিটির সিনিয়র বা অন্য কোথাও থেকে পাশ করা প্রফেশনাল। দেশের বাইরের কেউও হতে পারে। হয়তো কোনো ওয়ার্কশপ বা সেমিনারে গিয়ে তাদের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তাদের সাথে তোমার যোগাযোগ থাকবে—তারা জানবে তুমি কোন কোন জিনিসে ভালো, তোমার প্যাশন কি। ফিউচার প্ল্যান নিয়ে তাদের সাথে ডিসকাস করবে।

৮. বিল্ড ইউর রেজুমি:

চার বছর ভার্সিটি পড়ার পর যদি দেড় পাতা রেজুমি লেখার মেটেরিয়াল তোমার লাইফে না থাকে, তাহলে তুমি কি করলা, নাবিলা? তোমাকে এক্সট্রা-ক্যারিকুলার সাথে জড়িত থাকতে হবে—কোনো একটা অর্গানাইজেশনের সাথে। সেরকম কোনো অর্গানাইজেশন না থাকলে তুমি এবং তোমার বন্ধুরা মিলে একটা করে ফেলবে। সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে তাদের সিভি/রেজুমি জোগাড় করে ফেলবে। দরকার না থাকলেও সেকেন্ড ইয়ারে/থার্ড ইয়ারে তোমার একটা রেজুমি বানিয়ে ফেলবে। LinkedIn এ গিয়ে দুই-একটা জব সার্কুলার দেখে ঠিক করবে তারা কী কী চায়—তাহলে বুঝবে কোন কোন জায়গায় গ্যাপ আছে। তখন সেই গ্যাপগুলোর এরিয়াতে ইমপ্রুভ করে ফেলবে।

৯. এক্সটা নলেজ:

পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতে তোমাকে হানা দিতে হবে। সেটা হতে পারে কিছু বিখ্যাত বই পড়ে (বাংলায় বা ইংরেজিতে), উপন্যাস বা আত্মউন্নয়নমূলক বা অন্য কোন ক্যাটাগরির বই। হতে পারে কিছু অস্কার বিজয়ী সিনেমা, মোস্ট পপুলার TED talks দেখা। অন্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্ররা কী নিয়ে পড়তেছে সেটা নিয়ে মাঝে মধ্যে গল্প করো। তাইলে তুমি তোমার জগতের বাইরের কিছু বিষয়ে অবগত থাকবে। এর মধ্যেই হয়তো তুমি তোমার ইন্টারেস্ট খুঁজে পাবে—সেটাতে আরও ফোকাস করলে সেই ফিল্ডে সিরিয়াস একটা স্কিল তৈরি করে ফেলতেও পারবে।

১০. নিজেকে গাইড করার কৌশল:

ভার্সিটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হওয়ার জায়গা—এখানে ফ্যামিলি তোমাকে সবসময় গাইড করবে না। তাই নিজের টাইম ম্যানেজমেন্ট, ইমোশন ম্যানেজমেন্ট, রিলেশন ম্যানেজমেন্ট এগুলো নিজের ভিতরে ডেভেলপ করতে হবে। কোনো একটা রুটিন বানিয়ে তা ফলো করার অ্যাবিলিটি, কোনো টার্গেট সেট করে তার পিছনে লেগে থাকা—এসব তৈরি করতে হবে। অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে পারা, ধীরে ধীরে প্রফেশনাল লাইফের দিকে যাওয়া, লাইফ গুছানোর কথা চিন্তা করা—এসব করা জরুরি।
একটা ব্যাংক একাউন্ট থাকতে হবে। টিউশনি করে হোক বা যেভাবেই হোক—পাশ করার পর ছয় মাস চলার মতো টাকা তোমার ব্যাংকে থাকতে হবে। কারণ পাশ করার পর পরবর্তী দিনেই সবাই চাকরি পাবে না। তোমাকে দুই জোড়া ফর্মাল ড্রেস কিনে রাখতে হবে—ইন্টারভিউতে কাজে লাগবে।

মনে রাখবে—তোমার ভার্সিটি তোমাকে গড়ে দিবে না। ভার্সিটি একটা প্ল্যাটফর্ম। সেই প্ল্যাটফর্ম কাজে লাগিয়ে নিজেকে গড়ে নেয়ার দায়িত্ব তোমার।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org