রাত ১টা। চোখে ঘুম নেই, মাথার ভিতর আজকের বিকেলের একটি দৃশ্য বারবার ঘুরছে। রুমমেট একজন ছেলেকে পড়াতে বসেছিলেন, পড়া শেষে ছেলেটা হঠাৎ বলল, তার পড়াশোনায় মন নেই। জিজ্ঞেস করলে জানাল, তার বেস্ট ফ্রেন্ড তাকে আর আগের মতো গুরুত্ব দেয় না, দূরে সরে গেছে। এমনভাবে বলছিল যেন কোনো অদৃশ্য ভাঙনের শব্দ সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। আরও জানাল, এই আঘাত নিয়ে সে প্রতিদিন ডায়েরির পাতায় লেখে, কখনও কখনও মনে হয় নিজের জীবনটাই শেষ করে ফেলে। এত ছোট বয়সে এত তীব্র আবেগ! শুনে আমার বাধাহীন হাসি বেরিয়ে এল, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে একটা গভীর প্রশ্ন থাবা বসাল, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা এত তীব্রভাবে কেন ভেঙে পড়ে? সামান্য দূরত্বেই কেন তারা পৃথিবীর শেষ দেখেন? বন্ধুত্বের টান কি এতটাই ভয়ংকর, নাকি এর পেছনে আরও গভীর মনস্তাত্ত্বিক স্রোত বইছে?
আসলে কিশোর বয়স এমনই; এ সময় মস্তিষ্কে একটা ঝড় ওঠে, আবেগ চলে আসে অস্বাভাবিক তীব্রতায়। বন্ধুত্ব কিংবা সম্পর্ক তখন জীবনকে কেন্দ্র করে টানতে শুরু করে; যে কাউকে একটু বেশি গুরুত্ব দিলে ও তাকে মনে হয় পুরো পৃথিবী। কেউ দূরে গেলে মনে হয় নিজের ভেতর একটা অংশ কেটে পড়ে গেছে। ডায়েরিতে অঝোরে কাঁদা, নিজের মূল্যহীন ভাবা, অস্থিরতা, এসব আচরণ তখনকার বিকাশের স্বাভাবিক অঙ্গ। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন এই অনুভূতিগুলোকে ভুল নামে ডাকা হয় বা লজ্জা প্রদর্শন করা হয়। কেউ যদি বলে, এগুলো নাকি “অস্বাভাবিক” প্রবণতার লক্ষণ, কিংবা “গে টাইপ” আচরণ তাহলে সেই ভুল ব্যাখ্যাই শিশুর মধ্যেই ভীতি, শর্ম, বিভ্রান্তি ভরিয়ে দেয়। বন্ধুত্বের তীব্রতা বা আবেগের অতিরিক্ত প্রকাশ কোনো যৌন প্রবণতার বিকৃতি নয়; এটা তাদের মস্তিষ্ক ও পরিচয় গঠনের অংশ, নিরাপত্তা খোঁজার উপায় এবং নিজেকে বোঝার প্রক্রিয়া।
এই অবস্থায় প্যারেন্টিং-এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকরা যখন সন্তানকে বলে, “ছেলে হয়ে এতটা কাঁদিস কেন?” অথবা “এগুলো মেয়েলি আচরণ” তারা শিশুর অনুভূতিকে ছোট করে দেয়, তার আবেগকে গোপন করে রাখার শিক্ষাই দেয়। কিন্তু সন্তানের আবেগকে দমন করে রাখা, লজ্জা করানো বা ভয় দেখানো কখনোই তাকে শক্ত করে তুলবে না; বরং অপরাধবোধ, বিচ্ছিন্নতা আর সংকোচ বাড়িয়ে দেবে। সন্তানকে এমন একটি নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজন যেখানে সে খোলামেলা বলতে পারবে সে কেমন বোধ করছে, ভুল করলেও তাতে অপমানিত হবে না এবং আবেগ প্রকাশ করাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হবে না। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের অনুভূতিকে গ্রহণ করা, তাকে বোঝানো যে আবেগ থাকা মানে দুর্বলতা নয় এটা মানুষ হওয়ার প্রাকৃতিক অংশ। যখন তারা জানবে যে ঘরে ফিরে গেলে কেউ আছে যারা তাদের শোনে, তখন বন্ধুর চলে যাওয়া বা দূরে সরে যাওয়া তাদের জীবন ভেঙে দেবে না; বরং তা জীবন অভিজ্ঞতার এক ক্ষুদ্র অধ্যায় হিসেবে থাকবে।
শিশুকে শেখাতে হবে কীভাবে সুস্থ সীমা টেনে সম্পর্ক রাখা যায় এবং কীভাবে নিজেকে কেন্দ্র করে জীবনের লক্ষ্য গড়ে উঠায়। বন্ধুত্বকে জীবনের একমাত্র ভরসা না করে নিজের পরিচয় ও ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে আত্মসম্মান গড়ে তোলাই দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা দেয়। একে বলা যেতে পারে নিজেকে এমনভাবে গড়া যাতে অন্যের আচরণে আপনার মানসিক দিশা পুরোপুরি ভেসে না যায়। এতে করে অপ্রত্যাশিত বিচ্ছেদও একেবারেই ধ্বংসাত্মক না হয়ে জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে পড়ে। পাশাপাশি, একাকিত্ব, স্ক্রিন-টাইম বেশি থাকা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কিশোরদের আবেগকে অতিরিক্তভাবে তীব্র করে; তাই পরিবেশ যদি এমন হয় যেখানে তারা প্রকৃত বন্ধু, পরিবার বা কার্যকলাপে অংশ নিতে পারে, সেখানে আবেগের রোলারকোস্টার একটু শান্ত হবে।
এখানেই আধুনিক প্যারেন্টিং-এর সারমর্ম দাঁড়ায় শিশুকে ভুল নামে ডাকতে নয়, বোঝাপড়া আর সহানুভূতিতে তার অনুভূতিগুলোকে মেনে নেয়া। অভিভাবকরা যদি শিশুকে আনন্দ-দুঃখ উভয়ই প্রকাশের স্বাধীনতা দেন, তাকে নিজের মতো ভাবতে উৎসাহিত করেন এবং প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্যগত সহায়তা নিতে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে প্রিয়জনের চলে যাওয়া জীবন চিরতরে শেষ করে দেবে না। বরং সেই অভিজ্ঞতাই হতে পারে নিজের ভিতরটাকে গড়ে তোলার একটি পাঠ। কিশোর বয়সের আবেগ আগুনের মতো, নিয়ন্ত্রণহীন হলে পোড়ায়, কিন্তু সঠিকভাবে গৃহীত হলে আলো দেয়। তাই সমাজের ভুল ধারণা, লজ্জা বা ভয় দিয়ে এই আগুনকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না; পরিবারের বোঝাপড়া, সহনশীলতা আর সংলাপই সেই আগুনকে শক্তিশালী আলোতে পরিণত করবে।
মো. ইফতেখার হোসেন
এমবিবিএস ১ম বর্ষ , কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ | আগ্রহের ক্ষেত্র মূলত আচরণবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ও অভ্যাসবিজ্ঞান।

Leave a comment