গবেষকদের জন্যে বই

ল্যাব গার্ল: একটি নারীবিজ্ঞানীর জীবন, সংগ্রাম ও সবুজের প্রতি ভালোবাসা

Share
Share

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো এমন অনেক ছাত্রী আছেন, যারা জীববিজ্ঞান বা উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন কিন্তু নিশ্চিত নন—এই পথে হাঁটা কি সত্যিই তাঁদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে? তাঁদের অনেকে হয়তো নীরবে ল্যাবরেটরিতে কাজ করছেন, উদ্ভিদরসায়ন বা কোষ বিভাজনের মতো বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছেন, কিন্তু যখন ঘরে ফিরছেন, তখন শুনতে হচ্ছে—“এত পড়াশোনা করে কী হবে?”, “বিয়ের পরে এসব দিয়ে কী করবে?”, অথবা “মেয়ে হয়ে সারাদিন ল্যাবে পড়ে থাকা কি ঠিক?”। হোপ জাহরেনের আত্মজীবনী Lab Girl এইসব প্রশ্নের ভেতরেই এক গভীর আলো ফেলে দেয়, এবং তা শুধু উত্তর আমেরিকার বাস্তবতায় নয়—বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও যেন একেবারে প্রযোজ্য।

হোপ জাহরেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। তাঁর বই Lab Girl মূলত একটি স্মৃতিকথা, কিন্তু একইসাথে এটি বিজ্ঞানের প্রেমকাহিনি, নারীবাদের আত্মজিজ্ঞাসা, এবং গবেষণার পর্দার আড়ালের জীবনচিত্র। তিনি এই বইতে তাঁর শৈশবের বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে বাবা ছিলেন একজন বিজ্ঞান শিক্ষক এবং হোপ প্রায় প্রতিদিন বাবার ল্যাবে ঘুরে বেড়াতেন। এই প্রথম পরিচয় থেকেই শুরু হয় তাঁর বৈজ্ঞানিক কল্পনা এবং গবেষণার প্রতি মুগ্ধতা। কিন্তু এই ভালোবাসার পথটি যে কেবল আলোয় ভরা ছিল, তা নয়। বরং তিনি তুলে ধরেছেন গবেষণাজগতের অন্ধকার দিকগুলোও—আর্থিক সংকট, মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সংগ্রাম, সহকর্মীদের সন্দেহ, এমনকি নারীত্বের বিপরীতে ধ্রুপদী বৈজ্ঞানিক পুরুষত্বের বাধাও।

বাংলাদেশের অনেক মেধাবী ছাত্রী যাঁরা জীববিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন, তাঁদের কাছে এই বইটি এক আত্মদর্শনের আয়না হতে পারে। কারণ এখানে একজন নারী বিজ্ঞানী স্বীকার করে নিয়েছেন যে বিজ্ঞান কেবল আবিষ্কারের উত্তেজনায় ভরা নয়; এটি ক্লান্তিকর, সময়সাপেক্ষ, এবং অনেক সময় দিকভ্রান্তিকর। জাহরেন আমাদের দেখান কিভাবে রাত জেগে, না খেয়ে, নির্জন ল্যাবরেটরিতে কাজ করা একজন নারীর জন্য কেবল অধ্যবসায়ের নয়, বরং এক গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এই ভালোবাসা, তিনি জানান, কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়; এটি জীবনের সেই রহস্যময়তায় জন্য যা উদ্ভিদ, মাটি এবং কোষের অভ্যন্তরে লুকিয়ে আছে।

এই বইয়ের সবচেয়ে তীব্র দিকটি সম্ভবত তাঁর বন্ধুত্ব ও সহযোদ্ধা বিলের সঙ্গে সম্পর্কটি। বিল একজন সহকারী, যিনি প্রায় তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে ল্যাবরেটরি, গবেষণা এবং জীবনের সংকটগুলো পার করেন। এই সম্পর্ক কোনো রোমান্টিকতার গন্ধ ছড়ায় না, বরং বিজ্ঞানচর্চার এক বিরল নিদর্শন হয়ে ওঠে। বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা, এবং যৌথ সংগ্রামের যে মানবিক চিত্র এখানে আঁকা হয়েছে, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে একা গবেষণা নয়—মানুষের পাশে থাকা, তাকে বোঝা এবং সম্মান করাও বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দিক।

বাংলাদেশে যাঁরা গবেষণার জগতে প্রবেশ করতে চান, তাঁদের সামনে এখনো অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা রয়েছে। নারীদের জন্য এই বাধা দ্বিগুণ। হোপ জাহরেন নিজের জীবনের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে এই বাধা ভাঙা সম্ভব, তবে তার জন্য দরকার মনের জোর, নিজের প্রতি বিশ্বাস, এবং জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে জানার মানসিকতা। তিনি শুধু গবেষণার কথা বলেননি, বলেছেন নিজের বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কথাও। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর সাহসী আলোচনা আমাদের শেখায় যে বিজ্ঞানী হওয়া মানেই নিখুঁত হওয়া নয়; বরং নিজের দুর্বলতাগুলোকে চিনে নেওয়া এবং তার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাওয়া—সেই তো প্রকৃত বিজ্ঞানের জয়।

বইটির ভাষা সহজ, বর্ণনা আবেগময়, এবং প্রতিটি অধ্যায় যেন এক একটি ছোট গল্প। কখনো ল্যাবের মধ্যে একটি গাছের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার গল্প, কখনো একটি গবেষণাপত্র প্রকাশের পিছনের রুদ্ধশ্বাস সংগ্রাম, কখনো বা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন করা। এইসব গল্প বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিচিত নয়। বরং এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন যাঁরা কোনো ধরনের সামাজিক বা পারিবারিক সমর্থন ছাড়াই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন, গবেষণায় যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, এবং হয়তো ল্যাবের বাইরে নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নেও লড়াই করছেন।

জাহরেনের বর্ণনায় উদ্ভিদের প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সংযোগ এবং বৈজ্ঞানিক কৌতূহল একসঙ্গে মিশে যায়। তিনি কখনো শুধু একটি পাতার গঠন নিয়ে একটি অধ্যায় লিখেছেন, কখনো মাটির নীচে থাকা শিকড়ের জটিলতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এতে বোঝা যায়, বিজ্ঞান কেবল পিএইচডি বা গবেষণা প্রকাশের বিষয় নয়; এটি জগৎকে প্রশ্ন করার, তাকে ভালোবাসার এবং তার ভেতরে নিজের জায়গা খুঁজে পাওয়ার এক যাত্রা। এই দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞানকে আরো মানবিক, আরো হৃদয়ের কাছে নিয়ে আসতে পারে।

বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা এখনও বড় একটি শ্রেণির কাছে কেবল পরীক্ষার বিষয়, পাস করার বাধ্যবাধকতা। গবেষণার প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলার জায়গা তৈরি হয়নি যথেষ্ট। Lab Girl এই অভাব পূরণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বইটি আমাদের দেখায়, কীভাবে এক নারী নিজের আবেগ, কৌতূহল এবং সংকটকে আলিঙ্গন করে একজন বিজ্ঞানীতে রূপান্তরিত হন। তাঁর গল্প শুধুই অনুপ্রেরণার নয়; এটি আমাদের জন্য একটি রোডম্যাপ, কীভাবে গবেষণার পথে হাঁটলে আমাদের কী অপেক্ষা করে, এবং কীভাবে সেই পথে টিকে থাকতে হয়।

বাংলাদেশের ছাত্রীদের জন্য, বিশেষ করে যাঁরা বিজ্ঞানে আগ্রহী, তাঁদের জন্য Lab Girl এক আত্মীয়তার হাতছানি। এখানে কোনো অলীক সাফল্যের গল্প নেই; বরং রয়েছে সংগ্রামের, কাঁটার, এবং মাঝে মাঝে অন্ধকারের বর্ণনা। কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যেই ফুটে ওঠে সবুজের প্রতিচ্ছবি—একটি নতুন গাছের জন্ম, একটি নতুন প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান, কিংবা কেবলমাত্র একটি সন্ধ্যার বাতাসে পাতার শব্দ শুনে আবিষ্কারের আনন্দ।

একজন নারীবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে দেখা বিজ্ঞানজগতের এই সাহসী ও কাব্যিক বর্ণনা আমাদের চোখ খুলে দেয়। হোপ জাহরেন আমাদের শিখিয়ে দেন, বিজ্ঞান কেবল যুক্তি বা পরিসংখ্যানের বিষয় নয়; এটি ভালোবাসার, সাহসের, এবং কখনো কখনো নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের বিষয়। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম যদি এই উপলব্ধি নিয়ে বিজ্ঞানচর্চা শুরু করে, তাহলে হয়তো একদিন তাদের মাঝেও কেউ একজন নিজের লেখা Lab Girl–এর মতো একটি আত্মজীবনী দিয়ে অন্যদের পথ দেখাবে।

এই বইটি শুধু পড়া নয়, অনুভব করার মতো। এবং হয়তো, আমাদের দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে এই বইটির একটি কপি থাকা উচিত, যেখানে কোনো একটি তরুণী গবেষক ক্লান্ত হয়ে উঠে এসে বইটির পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে পারেন—এই পথটা একা নয়, অনেকেই হেঁটেছে। এবং সেই পথেই ফুটে উঠেছে আশার সবুজ অঙ্কুর।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org