বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনঃ কল্পনা নাকি বাস্তব?

Share
Share

“আমরা কি একদিন পৃথিবীর আকাশ ছেড়ে লাল গ্রহের মাটিতে দাঁড়াব? মঙ্গল কি সত্যিই হবে মানবজাতির দ্বিতীয় ঘর? নাকি এটি কেবল বিজ্ঞানকল্প কাহিনির স্বপ্ন?”—এই প্রশ্নগুলো আজ সারা বিশ্বের গবেষক, বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের কৌতূহল জাগাচ্ছে। পৃথিবীর সীমিত সম্পদ, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং পরিবেশের অবনতির প্রেক্ষাপটে মানুষ নতুন আবাস খুঁজতে শুরু করেছে। আর সেই অনুসন্ধানে মঙ্গল গ্রহ এক অনন্য সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠেছে।

কেন মঙ্গল গ্রহ?

চাঁদ হয়তো কাছাকাছি, কিন্তু সেখানে দীর্ঘস্থায়ী বসতি গড়ে তোলা কঠিন। মঙ্গল তুলনামূলকভাবে দূরের হলেও এর আকার, দিনের দৈর্ঘ্য এবং মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর সঙ্গে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেই কারণে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সঠিক প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা থাকলে মঙ্গলে মানুষের টিকে থাকার বাস্তব সম্ভাবনা আছে। এভাবেই ধীরে ধীরে মঙ্গলকে ঘিরে শুরু হয়েছে এক বিশাল বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রা।

ইতিহাসের দিকে তাকালে

মানুষের মঙ্গলের প্রতি আকর্ষণ নতুন নয়। প্রাচীন সভ্যতাগুলো এই লাল গ্রহকে যুদ্ধদেবতার প্রতীক হিসেবে দেখত। আধুনিক যুগে ১৯৬৫ সালে নাসার Mariner 4 মহাকাশযান প্রথম মঙ্গলের কাছ থেকে ছবি পাঠায়। ১৯৭৬ সালে ভাইকিং ল্যান্ডার মঙ্গলের মাটিতে নেমে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর ২০১২ সালে কিউরিওসিটি রোভার আবিষ্কার করে যে মঙ্গলের পরিবেশে একসময় জীবনের উপযোগী শর্ত থাকতে পারে। সর্বশেষ পারসিভিয়ারেন্স রোভার ২০২১ সালে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে মঙ্গলের বাতাস থেকে অক্সিজেন উৎপাদন সম্ভব। প্রতিটি অভিযানের সঙ্গে মঙ্গল যেন আরও কাছে চলে এসেছে।

চ্যালেঞ্জের কঠিন দেয়াল

তবু সহজ নয় এই পথ। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত পাতলা এবং অক্সিজেনহীন। গড় তাপমাত্রা মাইনাস ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। পৃথিবীর মতো কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই বলে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি সরাসরি আঘাত হানে। আর পৃথিবী থেকে মঙ্গল পর্যন্ত দূরত্ব এত বেশি যে সেখানে যেতে আধুনিক প্রযুক্তিতেও ছয় থেকে নয় মাস সময় লাগে। এই দীর্ঘ যাত্রায় জ্বালানি, খাদ্য, চিকিৎসা ও যোগাযোগ—সবকিছুই একেকটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।

সম্ভাব্য সমাধান

তবে বিজ্ঞান থেমে থাকেনি। নাসার MOXIE যন্ত্র প্রমাণ করেছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে অক্সিজেন উৎপাদন করা সম্ভব। বরফ থেকে পানি সংগ্রহের পরিকল্পনা চলছে, যা পান করার পাশাপাশি রকেট জ্বালানিও তৈরি করতে সাহায্য করবে। খাদ্য উৎপাদনের জন্য হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি, জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত ফসল, এমনকি মঙ্গলের মাটিকে শোধন করে ব্যবহার করার পরীক্ষাও চলছে। আর আশ্রয়ের জন্য ভাবা হচ্ছে বিশেষভাবে নকশা করা গম্বুজ, 3D প্রিন্টেড ঘর বা ভূগর্ভস্থ আস্তানা। স্পেসএক্স ইতিমধ্যেই স্টারশিপ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা নিয়মিতভাবে মানুষকে মঙ্গলে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে।

মঙ্গলের জীবনের কল্পচিত্র

কল্পনা করা যায়, একদিন মঙ্গলে মানুষ সকালবেলা জানালার বাইরে তাকালে দেখবে লাল ধুলোয় ঢাকা দিগন্ত, ছোট আকারের সূর্য আর গোলাপি রঙের আকাশ। বাইরে বেরোতে হলে সবসময় বিশেষ স্যুট পরতে হবে, আর ভেতরে তৈরি আশ্রয়ে অক্সিজেন ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ছোট ছোট উপনিবেশে থাকবে শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ। শিশুদের জন্য তৈরি হবে নতুন স্কুল, বিজ্ঞানীরা কাজ করবেন স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদনের উপায় বের করতে। শুরুতে মঙ্গল নির্ভর করবে পৃথিবীর সরবরাহের ওপর, কিন্তু ধীরে ধীরে সেখানে গড়ে উঠবে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি। আর সেই সঙ্গে গড়ে উঠবে নতুন সংস্কৃতি—মঙ্গলগ্রহে জন্ম নেওয়া শিশুরা হয়তো নিজেদের আলাদা পরিচয়ে বেড়ে উঠবে, যাদের একদিন “মঙ্গলবাসী” বলা হবে।

নৈতিক প্রশ্নের সামনে মানুষ

কিন্তু এ পথে কিছু গুরুতর নৈতিক প্রশ্নও উঠে আসে। আমরা কি সত্যিই অন্য একটি গ্রহকে নিজেদের প্রয়োজনে বদলে দেওয়ার অধিকার রাখি? পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করতে না পারা মানুষ কি মঙ্গলকেও একই পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে? নাকি এটাই হবে মানুষের দায়িত্বশীলতার নতুন সূচনা, যেখানে আমরা শিখব টেকসই উপায়ে বাঁচতে? এই প্রশ্নগুলো কেবল বৈজ্ঞানিক নয়, মানবতার ভবিষ্যৎ নিয়েও আমাদের ভাবায়।

ভবিষ্যতের দিগন্তে

বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ২০৩০-এর দশকেই প্রথম মানুষ মঙ্গলে নামতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে সেখানে ছোট ছোট উপনিবেশ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। শতাব্দীর শেষে হয়তো কয়েক লক্ষ মানুষ মঙ্গলে বসবাস করবে। তখন পৃথিবী আর মঙ্গল হবে মানব সভ্যতার দুই ভিন্ন কেন্দ্র—পৃথিবী হবে জন্মভূমি, আর মঙ্গল হবে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

আজকের দিনে মঙ্গলে মানুষের বসতি এখনও স্বপ্নের মতো শোনালেও বাস্তবতা আর কল্পনার দূরত্ব কমে আসছে দ্রুত। প্রযুক্তি, সাহস আর মানবিক অনুসন্ধিৎসা একত্র হয়ে ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নকে ছুঁতে চলেছে। একদিন পৃথিবীর আকাশ থেকে আমরা হয়তো দেখব—দূরের লাল গ্রহের বুক জুড়ে ঝিকমিক করছে মানুষের আলো। তখন আর মানুষ কেবল পৃথিবীর প্রাণী থাকবে না, বরং মহাবিশ্বের প্রকৃত নাগরিক হয়ে উঠবে।


তাহসিনুর রাইয়ান,
অষ্টম শ্রেণির ছাত্র,
বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী।
প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইয়ান’স রিডারস কর্নার।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org