সৌন্দর্য ও সুস্থতার সঙ্গে ওজনের সম্পর্ক বহু পুরোনো। যুগে যুগে মানুষ নানা উপায়ে অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসাবিজ্ঞান একেবারে নতুন পথ খুলে দিয়েছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি হওয়া কিছু ওষুধ—ওজেম্পিক, উইগোভি ও মাউনজারোর মতো নাম—আজ পরিণত হয়েছে ওজন কমানোর অলৌকিক সমাধানে।
এই ওষুধগুলো এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, অনুমোদনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে ঘাটতি দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি আটজন প্রাপ্তবয়স্কের একজন অন্তত একবার এই ওষুধ ব্যবহার করেছেন। শুধু প্রেসক্রিপশনপ্রাপ্ত রোগীরাই নয়, বরং ফ্যাশন-সচেতন সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত, সবাই ইন্টারনেট ঘেঁটে এগুলো পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
এই ওষুধগুলো মূলত GLP-1 নামক একটি অন্ত্র-উৎপন্ন রাসায়নিককে অনুকরণ করে কাজ করে। GLP-1 ইনসুলিন বাড়ায়, রক্তে শর্করা কমায় এবং ক্ষুধা দমন করে। প্রথমদিকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হলেও গবেষণায় প্রমাণিত হয়, এগুলো অভূতপূর্বভাবে ওজন কমাতে সক্ষম। ২০১৫ সালের একটি ট্রায়ালে দেখা যায়, এক বছরে ৫ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত ওজন কমেছে রোগীদের। আর ২০২১ সালের এক বৃহৎ গবেষণায় দেখা যায়, সেমাগ্লুটাইড নামের উপাদান ব্যবহারকারীরা দেড় বছরে গড়ে ১৫ কেজি ওজন কমিয়েছেন।
কিন্তু ওজন কমানোই এদের একমাত্র শক্তি নয়। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হৃদরোগ ও কিডনির ঝুঁকি কমানোতেও এরা কার্যকর। ২০২৪ সালে ৪১টি দেশে পরিচালিত এক ট্রায়ালে দেখা যায়, অতিরিক্ত ওজনধারী হৃদরোগীদের হৃদযন্ত্র ব্যর্থতার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে এই ওষুধ। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রে উইগোভি অনুমোদন পায় হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক কমানোর জন্য। এমনকি ওজেম্পিক কিডনি রোগ প্রতিরোধেও অনুমোদন পেয়েছে।
ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতাও আশ্চর্যজনক। অনেকেই জানিয়েছেন, খাওয়ার আগ্রহ যেমন কমছে, তেমনি মদ, তামাক বা অন্য নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতিও অনীহা তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি মাইগ্রেন বা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা লাঘব করতেও সহায়ক। পরীক্ষাগারে পাওয়া গেছে, এরা স্নায়ুকোষকে রক্ষা করতে পারে, যা আলঝেইমার কিংবা পারকিনসনের মতো রোগের ভবিষ্যৎ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতে পারে।
তবে এতসব আশাব্যঞ্জক দিকের পাশাপাশি রয়েছে অন্ধকার বাস্তবতা। সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে বমি, ডায়রিয়া, বা বমিবমি ভাব। কিন্তু গুরুতর ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ বা গলব্লাডারের রোগের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, ওজন কমার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মাংসপেশিও ক্ষয় হচ্ছে প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত। বয়স বাড়লে এ মাংসপেশির ক্ষয় দুর্বলতা, চলাফেরার সমস্যা ও হাড়ভাঙার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
আরো একটি জটিল দিক হলো গর্ভধারণ। যদিও গর্ভাবস্থায় এই ওষুধ ব্যবহারের অনুমতি নেই, কিন্তু এগুলো হরমোনের প্রভাবে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে কিংবা জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধকে কম কার্যকর করে দিতে পারে। এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি ভ্রূণের ওপর এর প্রভাব কতটা। কিছু গবেষণায় ঝুঁকি নেই বলে প্রমাণ মিললেও, সাম্প্রতিক তথ্য বলছে—গর্ভকালীন জটিলতা যেমন প্রি-এক্লাম্পসিয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
ফলে বোঝা যায়, এই ওষুধ একদিকে জীবন বদলে দিচ্ছে, অন্যদিকে নতুন ঝুঁকিও তৈরি করছে। সমাজে পাতলা শরীর হয়তো আকর্ষণীয় হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু তা স্বাস্থ্যকর জীবনের নিশ্চয়তা নয়। ওজন কমানো যদি আসে শরীরের অন্যান্য ক্ষতির বিনিময়ে, তবে তাকে আদৌ সুস্থতা বলা যায় না।
শেষ পর্যন্ত একটি সত্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে—কোনো ওষুধই শতভাগ নিরাপদ নয়। ওজন কমানোর এই ওষুধগুলো যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষের আশা জাগাচ্ছে, তেমনি অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নতুন স্বাস্থ্যসঙ্কটও তৈরি করতে পারে। তাই বিজ্ঞানের এই বিস্ময়কর উদ্ভাবনকে ঘিরে আমাদের প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় বিচার, সমালোচনামূলক বোঝাপড়া, আর সবচেয়ে বেশি—সতর্কতা।
Leave a comment