আমরা যখন কোনো বই পড়ি, তখন প্রতিটি অক্ষর, শব্দ, বাক্য একত্রিত হয়ে গল্প তৈরি করে। কিন্তু যদি আমরা মানবদেহ বা যেকোনো জীবের গোপন রহস্য জানতে চাই, তাহলে সেই গল্পটি লেখা রয়েছে চারটি অক্ষরে—A, T, G, C। এগুলো হলো ডিএনএ-এর চারটি নিউক্লিওটাইড। প্রশ্ন হলো—কীভাবে এই কোটি কোটি অক্ষর পড়া সম্ভব? উত্তর হলো এক যন্ত্রে, যার নাম ডিএনএ সিকোয়েন্সার (DNA Sequencer)। এটি হলো জীবনের পূর্ণাঙ্গ অভিধান খোলার চাবিকাঠি।
ইতিহাস: কার হাত ধরে জন্ম
ডিএনএ সিকোয়েন্সিং পদ্ধতির প্রথম যুগ শুরু হয় ১৯৭৭ সালে, যখন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার (Frederick Sanger) একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যা পরে তাঁর নামে পরিচিত হয়—স্যাঙ্গার সিকোয়েন্সিং। এই অবদানের জন্য তিনি দ্বিতীয়বারের মতো রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। স্যাঙ্গারের পদ্ধতি ছিল অপেক্ষাকৃত ধীর এবং কষ্টসাধ্য, কিন্তু এটি প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীদের সামনে জীবনের “অক্ষরমালা” খুলে দেয়।
এরপর ১৯৯০-এর দশকে আসে অটোমেটেড ডিএনএ সিকোয়েন্সার। বড় বড় মেশিন তখন হাজার হাজার ডিএনএ ফ্র্যাগমেন্ট একসাথে পড়তে পারত। আর ২০০০ সালের শুরুর দিকে আবির্ভূত হয় নেক্সট-জেনারেশন সিকোয়েন্সিং (NGS)—যা বিপ্লব এনে দেয়। এখন একটি যন্ত্র কয়েকদিনেই মানুষের পূর্ণ জিনোম পড়তে পারে, যা আগে কয়েক বছর লেগে যেত।
বৈজ্ঞানিক মূলনীতি: কীভাবে কাজ করে?
ডিএনএ সিকোয়েন্সারের মূলনীতি হলো—একটি ডিএনএ টুকরোকে বারবার কপি করা, এবং প্রতিটি কপির শেষে একটি চিহ্নিত নিউক্লিওটাইড বসানো।
- স্যাঙ্গার সিকোয়েন্সিং: এখানে ফ্লুরোসেন্ট চিহ্নযুক্ত নিউক্লিওটাইড ব্যবহার করা হয়। যখনই চেইন বন্ধ হয়, তখন একটি নির্দিষ্ট অক্ষর ধরা পড়ে। এইভাবে একটির পর একটি অক্ষর সাজিয়ে পুরো সিকোয়েন্স পাওয়া যায়।
- NGS (Next Generation Sequencing): এখানে লক্ষ লক্ষ ছোট ডিএনএ ফ্র্যাগমেন্ট একসাথে কপি হয় এবং ক্যামেরা বা সেন্সর দিয়ে তা পড়া হয়। ফলে খুব অল্প সময়ে বিপুল তথ্য পাওয়া সম্ভব।
- তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি (Oxford Nanopore, PacBio): এখানে ডিএনএ সরাসরি সেন্সরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, এবং প্রতিটি নিউক্লিওটাইডের বৈদ্যুতিক সিগনাল আলাদা করে শনাক্ত করা হয়। এর ফলে দীর্ঘ ডিএনএ একটানা পড়া সম্ভব হয়।
কী কী পরীক্ষায় ব্যবহার হয়?
ডিএনএ সিকোয়েন্সার দিয়ে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়:
- মানব জিনোম গবেষণা: হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট সম্পন্ন হয়েছিল সিকোয়েন্সারের কল্যাণে।
- রোগ নির্ণয়: ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়া, ডায়াবেটিস বা বিরল জিনগত রোগে কোন জিনে সমস্যা আছে, তা বের করতে।
- ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণ: কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স করা হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহে, যা ভ্যাকসিন উন্নয়নে সহায়ক হয়েছিল।
- কৃষি গবেষণা: ধান, গম বা ভুট্টার জাত উন্নয়নে জিন সিকোয়েন্সিং ব্যবহার হয়।
- ফরেনসিক বিজ্ঞান: ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়াও গভীরতর বংশতালিকা বিশ্লেষণে সিকোয়েন্সার ব্যবহার হয়।
গুরুত্ব ও সহজলভ্যতা
ডিএনএ সিকোয়েন্সার আজকের বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারগুলোর একটি। এটি শুধু মৌলিক গবেষণা নয়, চিকিৎসা ও শিল্প—সব ক্ষেত্রেই বিপ্লব এনেছে। তবে এর একটি সীমাবদ্ধতা হলো—মেশিনটি এখনো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল। বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সিকোয়েন্সার আছে, কিন্তু এগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন।
তবে সুখবর হলো—NGS প্রযুক্তি সস্তা হচ্ছে। আগে একটি মানুষের জিনোম পড়তে যেখানে কয়েক কোটি ডলার লাগত, এখন তা কয়েকশো ডলারে সম্ভব। একইসঙ্গে অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি ছোট আকারের বেঞ্চটপ সিকোয়েন্সার তৈরি করেছে, যা তুলনামূলক সাশ্রয়ী।
বৈজ্ঞানিক মাইলফলক
ডিএনএ সিকোয়েন্সারের কল্যাণে আমরা যে কয়েকটি বড় সাফল্য পেয়েছি:
- হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট (২০০৩): প্রথমবার সম্পূর্ণ মানব জিনোম পাঠ।
- ক্যান্সার জিনোম অ্যাটলাস: বিভিন্ন ক্যান্সারের জিনগত কারণ শনাক্ত।
- কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন: ভাইরাসের জিনোম দ্রুত সিকোয়েন্স করার ফলে ভ্যাকসিন উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে এক বছরেরও কম সময়ে।
বাংলাদেশের গবেষকদের জন্য প্রাসঙ্গিকতা
বাংলাদেশে ডিএনএ সিকোয়েন্সার ব্যবহার এখনো সীমিত, তবে এর প্রয়োগ প্রতিদিন বাড়ছে। কৃষি গবেষণা, চিকিৎসা গবেষণা, এমনকি পরিবেশ বিজ্ঞানে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। অনেক সময় বাংলাদেশের গবেষকরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় স্যাম্পল বিদেশে পাঠিয়ে সিকোয়েন্সিং করান।
শিক্ষার্থীদের জন্যও সুযোগ রয়েছে—অনলাইনে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং সিমুলেটর, টিউটোরিয়াল ও ওপেন-ডেটাসেট ব্যবহার করে তারা বিশ্লেষণ শেখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, NCBI Genome Database অথবা Ensembl ব্যবহার করে সিকোয়েন্স ডেটা বিশ্লেষণ করা যায়।
উপসংহার: জীবনের কোড পড়ার হাতিয়ার
ডিএনএ সিকোয়েন্সার হলো এমন এক যন্ত্র, যা আমাদের জীবনের মৌলিক রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করছে। এটি শুধু রোগ নির্ণয় বা কৃষি গবেষণার যন্ত্র নয়, বরং আমাদের অস্তিত্বের জিনগত নকশা পড়ার দরজা খুলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের জন্য এই বার্তা—যদি তোমরা ভবিষ্যতের বিজ্ঞানে নেতৃত্ব দিতে চাও, তবে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি আয়ত্ত করো। অনলাইনে শিখো, ওপেন ডেটা বিশ্লেষণ করো, আর আন্তর্জাতিক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করো। হয়তো আগামীদিনে কোনো বাংলাদেশি গবেষকই খুঁজে পাবেন নতুন কোনো রোগের জিনগত রহস্য, কিংবা কৃষির জন্য নতুন কোনো জিন আবিষ্কার করবেন।
জীবনের গল্প লেখা আছে ডিএনএ-তে—ডিএনএ সিকোয়েন্সার হলো সেই গল্প পড়ার বইয়ের প্রথম আলো।
Leave a comment