গবেষকদের জন্যে বই

কেন পড়ে না পৃথিবী: কাঠামোর বিজ্ঞান ও আমাদের দৈনন্দিন বিস্ময়

Share
Share

আমরা প্রতিদিন হাজারো জিনিসের পাশে দিয়ে চলি, বসি, দাঁড়াই, হাঁটি—একটা সেতু, একটা বিল্ডিং, একটা চেয়ার, এমনকি একটা প্লেনের ডানাও। কিন্তু এই জিনিসগুলো পড়ে না কেন? কীভাবে এত বড় বড় কাঠামো নিজেদের ভার নিয়ন্ত্রণ করে, বাতাস, ভূমিকম্প বা মানুষের ভর সয়ে টিকে থাকে? প্রশ্নটা শুনতে সহজ, কিন্তু এর উত্তর শুধু প্রকৌশলবিদ্যার পাঠ্যবই নয়, বরং আমাদের চিন্তা ও কৌতূহলের জায়গা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। জে. ই. গর্ডনের Structures: Or Why Things Don’t Fall Down বইটি ঠিক এই সহজ অথচ গভীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে এনে দেয় আমাদের জন্য।

এই বইয়ের অন্যতম সেরা দিক হলো, এটি পদার্থবিদ্যা বা প্রকৌশলের ছাত্রদের জন্যই লেখা হয়নি। বরং যে কেউ—একজন সাধারণ পাঠক—যিনি জানেন না ‘টেনশন’ আর ‘কম্প্রেশন’-এর পার্থক্য, তিনিও এটি পড়ে বুঝতে পারেন কেন একটা গির্জার বিশাল ছাদ পড়ে না, কিংবা কেন একটা নকশা ছোট্ট ভুলেই ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। গর্ডনের লেখনীতে রয়েছে একধরনের মেধাবী সরলতা, যেখানে কঠিন বিষয়গুলোও গল্পের মতো বোধগম্য হয়ে ওঠে।

তিনি বোঝান, প্রকৌশলের মূল কথা হলো ভারসাম্য—টান আর চাপের মধ্যকার সূক্ষ্ম খেলা। কাঠামো কোনো বস্তু নয়, এটি হলো শক্তি কীভাবে প্রবাহিত হয় তার কল্পনাপ্রসূত এক চিত্র। উদাহরণস্বরূপ, একটি সেতু কীভাবে শুধুমাত্র তার নিজস্ব ওজনই নয়, বরং প্রতি মুহূর্তে চলমান গাড়ির ভর, বাতাসের চাপ, এমনকি তাপমাত্রার পরিবর্তনও সহ্য করে থাকে—সেই বর্ণনা গর্ডন দিয়েছেন এমনভাবে, যেন আমরা নিজের চোখেই দেখতে পাই ধাতব বিমগুলোর ওপর দিয়ে কেমন করে চাপ ভেঙে যায় বা ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি ইতিহাসের পাতায়ও আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যান—রোমান আর্চ, গথিক ক্যাথেড্রাল, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির স্কেচ, কিংবা ১৯শ শতকের ব্রিজ ডিজাইন। এই যাত্রায় বোঝা যায়, কাঠামো নিয়ে ভাবনা কেবল আধুনিক বিজ্ঞানীদের বিষয় নয়; বরং এটি হাজার বছর ধরে চলমান এক মানবিক অনুসন্ধান, যার মূলে রয়েছে আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার চেষ্টা।

বইটির আরেকটি অনন্য দিক হলো গর্ডনের রসবোধ। প্রকৌশল এমন একটি বিষয়, যা প্রায়শই ক্লান্তিকর মনে হতে পারে সাধারণ পাঠকের কাছে। কিন্তু গর্ডন এমনভাবে হাস্যরসের সঙ্গে বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন যে, পাঠক নিজের অজান্তেই জটিল ধারণা আত্মস্থ করে ফেলেন। তিনি যখন ব্যাখ্যা দেন, কেন পাঁজরের কাঠামো আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশল—তখন তা শুধু একটি বৈজ্ঞানিক তথ্য নয়, বরং এক ধরনের বিস্ময়ও তৈরি করে যে, প্রকৃতি নিজেই একজন মহান প্রকৌশলী।

এখানেই উঠে আসে আরেকটি বড় ভাবনা—মানব সভ্যতার প্রতিটি অগ্রগতি একেকটি কাঠামোর গল্প। কৃষি সভ্যতার গোড়ায় ছিল মাটির ঘর, সভ্যতার বিবর্তনে এসেছে ইট, লোহা, স্টিল আর এখন তো আমরা কথা বলি ন্যানোটিউব দিয়ে তৈরি ভবিষ্যতের স্থাপত্যের। কিন্তু এর মূল কথা একই—কীভাবে কিছু উপাদানকে এমনভাবে গাঁথা যায়, যাতে সেটি পড়ে না যায়, ভেঙে না পড়ে। এই যে ভেঙে না পড়ার বিজ্ঞান—এটাই আমাদের উন্নয়নের এক মৌলিক ভিত্তি।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে ভবন, সেতু, ফ্লাইওভার—সেখানে কাঠামোগত জ্ঞানের অভাব কখনও কখনও প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। আমরা প্রায়ই খবর পাই ভবন ধসের, অব্যবস্থাপনার, কিংবা দুর্বল নির্মাণের ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার। এই বই আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রকৌশল শুধু অঙ্ক আর যন্ত্রপাতির বিষয় নয়, এটি এক ধরনের নৈতিকতা, যেখানে প্রতিটি নকশার পেছনে থাকে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা।

তবে শুধু বিপদের কথাই নয়, বইটি আমাদের শেখায় কিভাবে এই জ্ঞান ব্যবহার করে সুন্দর ও টেকসই জগৎ গড়া যায়। বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের জন্য এটি অনুপ্রেরণাদায়ক—যারা ভাবছে কীভাবে বিজ্ঞান, গণিত বা প্রকৌশলকে জীবনের পথ হিসেবে নেবে। এই বই বুঝিয়ে দেয়, প্রকৌশলী হওয়া মানে কেবল কারিগরি কাজ নয়, বরং দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মোকাবেলায় নিজের মেধাকে কাজে লাগানো।

গর্ডনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কাঠামো মানেই কেবল বিল্ডিং বা সেতু নয়, এটি জীবনেরও প্রতীক। আমাদের সামাজিক কাঠামো, রাজনৈতিক কাঠামো, এমনকি আমাদের চিন্তার কাঠামোও একইভাবে ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। একটি তর্ক বা বিতর্ক যখন ভেঙে পড়ে, তখন সেটিও এক ধরনের কাঠামোগত ভেঙে পড়া। এই রূপক ভাষায়, বইটি এক গভীর মানবিক পাঠ হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের তরুণদের জন্য এমন একটি বই বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশে প্রকৌশল শিক্ষার চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বাস্তব জ্ঞানের অভাব। শিক্ষার্থীরা হয়তো থিওরি মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো করছে, কিন্তু সেই জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে। এই বই এমন এক মাধ্যম, যেখানে শিখন প্রক্রিয়া আনন্দদায়ক এবং মানবিক উভয়।

সবশেষে বলা যায়, Structures: Or Why Things Don’t Fall Down শুধু একটি বই নয়, এটি একটি দর্শন। এটি আমাদের শেখায় কিভাবে বিশ্বকে দেখতে হয় কাঠামোর চোখ দিয়ে—নতুন দৃষ্টিকোণে, নতুন বিস্ময়ে। গর্ডনের ভাষায়, প্রকৌশল হলো “বিশ্বকে এমনভাবে সাজানো, যাতে তা আমাদের ক্ষতি না করে বরং সহায়ক হয়”—এবং এই দর্শনই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে একটি নিরাপদ, সুন্দর, ও সচেতন সমাজের দিকে।

অতএব, যে কেউ যিনি নিজের চারপাশের জগৎকে একটু গভীরভাবে বুঝতে চান—একটি চেয়ার কেমন করে আমাদের ভার ধরে রাখে, কিংবা একটা সেতু ভেঙে না পড়ে কী করে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকে—তার জন্য এই বইটি এক আবশ্যিক পাঠ। এবং হয়তো পাঠ শেষে তাকেও আর ‘সাধারণ’ পাঠক বলা যাবে না—তিনি হয়ে উঠবেন এক কাঠামোবোদ্ধা, এক অনুসন্ধিৎসু, যিনি জানেন জগৎ পড়ে না কেন।


এই বইয়ের পিডিএফ লিংক: Structures: Or Why Things Don’t Fall Down

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষকদের জন্যে বই

বিদ্রোহী বিজ্ঞানীর মানসপট: ফ্রিম্যান ডাইসনের ডাকে বিজ্ঞানচর্চার নতুন পাঠ

"দ্য সায়েন্টিস্ট অ্যাজ রেবেল"-এর মাধ্যমে ফ্রিম্যান ডাইসনের বিদ্রোহী চেতনা অন্বেষণ করুন। এই...

গবেষকদের জন্যে বই

নানান পথ ঘুরে দেখার শক্তি: পেশাদার হবার আগে সাধারণ হওয়ার মাহাত্ম্য

দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের মূল চাবিকাঠি কেন বিশেষজ্ঞীকরণের আগে একাধিক পথ অন্বেষণ করা হতে...

গবেষকদের জন্যে বই

সিস্টেম চিন্তার প্রয়োজনীয়তা: একটি পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য সিস্টেম চিন্তাভাবনা কেন অপরিহার্য তা আবিষ্কার করুন। কীভাবে...

গবেষকদের জন্যে বই

বিজ্ঞান কীভাবে এগিয়ে যায়: কার্ল পপার এবং মিথ্যা প্রমাণের যুক্তি

কার্ল পপারের মিথ্যা প্রমাণের ধারণা কীভাবে বিজ্ঞানের প্রকৃত অগ্রগতি ব্যাখ্যা করে তা...

গবেষকদের জন্যে বই

গণনার গোপন নায়িকারা: বিজ্ঞান, বর্ণবাদ ও নারীর লড়াইয়ের এক অনুপ্রেরণামূলক ইতিহাস

নাসার লুকানো ব্যক্তিত্বদের অকথ্য গল্প আবিষ্কার করুন - আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলা বিজ্ঞানীরা যারা...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org