সম্পাদকীয়

লিগ্যাসি তৈরি এবং নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা

Share
Share

ড. মশিউর রহমান

আমার ব্যক্তিগত বেশ কিছু প্রজেক্টে আমি নিজেই নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তার জন্যে কোন নতুন নেতৃত্বের কাউকে আনতে পারছি না। কেন এই ব্যর্থতা? সেটাও পর্যালোচনা করে এই লেখাটি লিখা, অনেকটা আত্মবিশ্লেষণের মতন করে।

মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষকে মূলত দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। একটি শ্রেণী ছিল সামাজিকভাবে সংযুক্ত, যারা এককভাবে কিছু করত না বরং মিলিতভাবে বড় শিকার করত। নৃতত্ববিদরা তার নাম দিয়েছিল নিয়ান্ডারথাল মানব (Homo neanderthalensis) যারা আমাদের পূর্বপূরুষ বলে ধারনা করা হয়। অন্যদিকে, আরেকটি শ্রেণী ছিল যারা একাকী জীবনযাপন করত, তারা শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং কর্মঠ ছিল। তারা একা একা শিকার করত এবং নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করত। নিতৃত্ববিদরা এর নাম দিয়েছে Homo erectus or Australopithecus। (আমি যতটা সাধারণ ভাবে বললাম, তা নিতৃত্ববিদদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছ, তা উল্লেখ করে নিচ্ছি)

তবে নৃতত্ত্ববিদরা বলছেন যে সময়ের সাথে সাথে দেখা যায় যে, কেবলমাত্র সামাজিকভাবে সংযুক্ত ব্যক্তিরা যারা নিয়ান্ডারথাল মানব শুধু তারাই টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, আমাদের সামাজিক সংযোগ যত বেশি হবে, আমাদের উন্নতি ততই নিশ্চিত হবে।

কেন ধারাবাহিকতা থাকে না?

উদ্দ্যোক্তা বা নেতাদের প্রথম দিকে সেই কনসেপ্টগুলি প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথমিক ভাবে একাই কাজ করতে হয়। তবে সমস্যা হলো, এই লিজেন্ডরা নতুন কিছু তৈরিতে এতটাই ফোকাস থাকেন যে অনেকেই পরবর্তী নেতৃত্ব তৈরি করার প্রতি মনযোগ দেন না, ফলে তা প্রবাহমান রাখতে ব্যর্থ হন। “একা” উদ্যোগ নিয়ে সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার কারণে এটিকে প্রবাহিত করে বহমান রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

আমাদের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কারণ আমরা চিরকাল বাঁচতে পারি না। তাই লিগ্যাসি অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের মনোযোগ দিতে হবে কিভাবে আমাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ২০১৮ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, দেশের ৭২% তরুণেরা নতুন উদ্যোগ ও নেতৃত্ব তৈরি করতে আগ্রহী, কিন্তু মাত্র ২৮% কার্যকর নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ পায়। সুতরাং, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি না হয়।

নেতৃত্বের উদাহরণ:

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, সক্রেটিস তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন একটি ধারা সৃষ্টি করেছিলেন যা তার মৃত্যুর পরেও সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করে। প্লেটো, জেনোফোন, অ্যান্টিসথেনস, অ্যারিস্টিপাস এর মতন মহান চিন্তাবিদরা ছিল সক্রেটিসের ছাত্র। আধুনিক যুগে এটি আরও সহজ হয়ে গেছে, কিন্তু এজন্য প্রয়োজন কৌশল এবং নেতৃস্থানীয় চিন্তাভাবনা।

লিজেন্ডরা কিভাবে ধারাবাহিকতা রাখবেন?

১. ডকুমেন্টেশন: নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং দর্শনগুলো লিখে প্রকাশিত করা খুব প্রয়োজন। এই কাজটি করার জন্য আমাদের প্রচুর লেখালেখি, বই প্রকাশ কিংবা ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে তা সবার সাথে শেয়ার করতে হবে।

২. কমিউনিটি তৈরি: আপনার চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি ফলোয়ার বা কমিউনিটি তৈরি করুন, যারা সমাজের বিভিন্ন অংশে আপনার আইডিয়াগুলো ছড়িয়ে দিতে পারবে।

৩. নেতৃত্বের বিকাশ: ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করুন এবং তাদেরকে স্বাধীনভাবে নেতৃত্ব দেবার জন্য স্পেস বা জায়গা দিন, যেন তারা নিজের পদ্ধতিতে সেই লিগ্যাসিকে বহন করতে পারে।

৪. মেন্টরিং করুন: লিগ্যাসি তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মেন্টরশিপ। নেতাদের উচিত কেবল তাদের নিজের অর্জনগুলোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। মেন্টরশিপ ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৫. দর্শন এবং মূল্যবোধের গুরুত্ব: লিগ্যাসি কেবলমাত্র অর্জনের উপর নির্ভর করে না, বরং মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেতাদের উচিত তাদের মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা, যাতে তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের অনুসারীরা সেই পথ ধরে চলতে পারে। সেই ক্ষেত্রে নেতাদের উচিত নিজের “আমিত্ব”-কে গুরুত্ব না দিয়ে বৃহৎ আকারে ভবিষ্যতের উপর দৃষ্টি দেওয়া।

৬. ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করুন: আধুনিক যুগে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি লিগ্যাসি ধরে রাখার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। নেতারা তাদের চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা এবং কাজ ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করে যেতে পারেন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সেগুলো ব্যবহার করতে পারে।

উত্তরাধিকার তৈরির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

জাপানে পিএইচডি করার সময় আমি লক্ষ্য করেছি যে, ল্যাবগুলো সাধারণত নতুন একটি গবেষণার ক্ষেত্র তৈরী করার কাজ করে। সেই ল্যাবের প্রধান গবেষক বা প্রফেসর কিছু জুনিয়র শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে বিজ্ঞানে নতুন কিছু আবিষ্কার করে জ্ঞান তৈরিতে ভুমিকা রাখে। এই কাজ করতে যেয়ে তিনি নতুন গবেষক তৈরি করেন, তার দক্ষতা ও কর্মপন্থা নবীব বিজ্ঞানীদের শেখান। তার মৃত্যুর পরেও তার জুনিয়র গবেষকরা সেই প্রকল্পগুলো পরিচালনা করেন। এর ফলে দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে একই ল্যাবে সেই বিশেষ ক্ষেত্রটি নিয়ে কাজ হয়, এবং গবেষনার সেই কাজগুলি আরও পরিপূর্ণ হয়। বিজ্ঞানীর মৃত্যুর সাথে সাথে জ্ঞানার্জন থেমে যায় না, বরং তা প্রবাহমান থাকে, এবং সেই গবেষকের লিগ্যাসি বা উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই ধারণা মাথায় রেখে, আমি যখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি, তখন আমি আমার অফিসের পাশে একটি ল্যাব স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রযুক্তি বিষয়ে নতুন জ্ঞান তৈরি করা। কিন্তু আমি স্বীকার করি, সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। তবে, পরবর্তীতে আমি বিজ্ঞানী ডট অর্গ প্ল্যাটফর্মে কাজ শুরু করি এবং ভার্চুয়ালি সেই আদর্শটি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছি। ভার্চুয়াল মাধ্যমে কাজ করার সুবিধা হলো, আমার আইডিয়া এবং কনসেপ্টগুলো খুব সহজেই ছড়িয়ে দিতে পারছি।

এই প্রবন্ধটি লিখছি শুধু পাঠকদের জন্য নয়, বরং নিজের জন্যও। বিজ্ঞানী ডট অর্গ প্ল্যাটফর্মটি কেবল আমার জন্য নয়, এটি যাতে দীর্ঘমেয়াদী হয় এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম এটি বহন করতে পারে, সেই দিকেই আমার মনোযোগ দিতে হবে এবং সেজন্য আমি কাজ করছি। আমি এখন কমিউনিটি তৈরি এবং এই প্ল্যাটফর্মের জন্য ব্র্যান্ড এম্বাসেডর ও নবীন নেতাদের তৈরি করার জন্য কাজ করছি। যারা আমাদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী, তাদেরকে আমার সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করছি। আমরা একসঙ্গে আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারি।


পরিশেষে বলবো, যারা কমিউনিটি লিডার, তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে—আপনার কনসেপ্ট এবং নেতৃত্বকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি করুন। আপনাদের তৈরি করা আদর্শের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে শুধু নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, বরং সেটিকে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে তেমন নেতা ও কমিউনিটি তৈরি করা প্রয়োজন যেন সেই আদর্শ কিংবা উদ্দ্যোগটি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন।

Share

1 Comment

  • ভালো লাগলো লেখাটা, তবে আরেকটু সহজবোধ্য উদাহরণ দিলে বেশ হোত। ধন্যবাদ লেখককে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
সম্পাদকীয়

গবেষকের ক্যারিয়ার: বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক নতুন বাস্তবতা

ড. মশিউর রহমান বাংলাদেশের তরুণ গবেষকরা যখন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যান,...

সম্পাদকীয়

চীনের নতুন স্বপ্ন: নিজের এনভিডিয়া গড়ার পথে

প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে চীন এনভিডিয়ার বিকল্প হিসেবে নিজস্ব এআই চিপ তৈরির উপর...

সম্পাদকীয়

বিদেশে গবেষণার সাহসী যাত্রা: নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষা

HFSP-এর মতো আন্তর্জাতিক ফেলোশিপের মাধ্যমে বাংলাদেশী তরুণ গবেষকরা কীভাবে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে...

সম্পাদকীয়

গবেষকের কূটনীতি: বিজ্ঞানের ভাষায় বিশ্বকে বোঝা

বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষকরা কীভাবে কূটনীতিক হিসেবে কাজ করতে পারেন তা আবিষ্কার...

সম্পাদকীয়

বিজ্ঞানীদের জন্য আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক করা কেন প্রয়োজন?

বিজ্ঞানীদের জন্য আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক কেন অপরিহার্য তা আবিষ্কার করুন। তরুণ বাংলাদেশী...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org