একটা সময় ছিল যখন ‘কম্পিউটার’ শব্দটি ছিল কেবলমাত্র গবেষণাগারের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইন্টারনেট তখনও ছিল কল্পনারও বাইরে। অথচ আজ এই দুই প্রযুক্তি ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না আমাদের জীবন। কীভাবে ঘটল এই রূপান্তর? কে ছিল এই বিপ্লবের নেপথ্যের পথিকৃৎরা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার এক অনন্য প্রয়াসই হলো ওয়ালটার আইজ্যাকসনের বিখ্যাত বই The Innovators। একাধারে সাংবাদিক ও জীবনীকার, আইজ্যাকসনের লেখনীতে ফুটে উঠেছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট বিপ্লবের অন্তর্নিহিত ইতিহাস, ব্যক্তিত্ব, ও সমাজগত প্রেক্ষাপট।
আইজ্যাকসন আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন সেই মানুষগুলোর সঙ্গে, যাঁরা একা নন, বরং দলবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন আধুনিক প্রযুক্তির ভিত। এই বই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একজন মেধাবী প্রোগ্রামার কিংবা বিজ্ঞানী যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, প্রযুক্তির জগতে বড় রকমের পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজন হয় সমবেত চিন্তা ও পারস্পরিক সহযোগিতার। আইজ্যাকসন প্রতিটি অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন কীভাবে বিভিন্ন সময়ের বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, উদ্যোক্তা ও দার্শনিকদের মধ্যে সমন্বয় ঘটেছে। তাঁদের সম্মিলিত চিন্তাভাবনা ও শ্রমের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে আমাদের আজকের ডিজিটাল বিশ্ব।
বইটির শুরুতেই আমরা দেখতে পাই আডা লাভলেসের গল্প। উনিশ শতকের এই মহীয়সী নারী ছিলেন গাণিতিক বিশ্লেষণের দিক থেকে এক বিপ্লবী চিন্তাবিদ। তাঁকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। চার্লস ব্যাবেজের অ্যানালাইটিক্যাল ইঞ্জিনের ধারণাকে তিনি যে গভীরতায় বুঝেছিলেন এবং যেভাবে তিনি কল্পনা করেছিলেন ভবিষ্যতের যন্ত্র কীভাবে অ্যালগরিদম অনুসরণ করবে, তা সত্যিই অভাবনীয়। অথচ তাঁর এই অবদান বহু বছর অবহেলিত ছিল—যা প্রযুক্তির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বাস্তবতার দিকও উন্মোচন করে।
এরপর আমরা পাই অ্যালান টুরিং-এর মতো ব্যক্তিত্বকে, যিনি কেবল কম্পিউটারের কাঠামোগত ভিত্তি তৈরি করেননি, বরং গণিত ও যুক্তিবিদ্যার জগতে নতুন দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর কাজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি কোড ভাঙার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। টুরিং-এর দৃষ্টিভঙ্গি—যে যন্ত্র চিন্তা করতে পারে—সেই ধারণা আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি হয়ে উঠেছে। আবার জিনিয়ার্ড হপারের মতো মানুষদের দেখেছি, যাঁরা ভাষার জগতে নতুনত্ব এনেছেন—কম্পিউটার প্রোগ্রামিংকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজ করে তোলার পথ তৈরি করেছেন।
তবে বইটি শুধু বৈজ্ঞানিকদের সাফল্যের কথাই বলে না; বরং এখানে উঠে আসে তাঁদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, ব্যর্থতা, ও সীমাবদ্ধতার কথাও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিল গেটস, স্টিভ জবস কিংবা স্টিভ ওজনিয়াকের কথা। এঁরা সবাই একেকজন ভিন্নধর্মী মানুষ, যাঁদের চিন্তাভাবনা, ব্যবসায়িক কৌশল, এবং প্রযুক্তিকে ঘিরে স্বপ্ন ছিল আলাদা। কেউ ছিলেন আত্মপ্রচারে আত্মবিশ্বাসী, কেউ আবার ছিলেন নিভৃতচারী স্রষ্টা। কিন্তু একত্রে, তাঁরা যুগের চাহিদাকে চিনতে পেরেছিলেন এবং সময়ের আগেই ভাবতে শিখেছিলেন কীভাবে প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের জীবনে ঢুকে পড়বে।
আইজ্যাকসন বইটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা তুলে ধরেছেন—বড় উদ্ভাবন কেবল একক প্রতিভার ফল নয়, বরং তা একাধিক ব্যক্তির চিন্তার যোগফল, যাঁরা বিভিন্ন সময়, জায়গা ও পরিস্থিতিতে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেখতে পাই কীভাবে ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের পর সিলিকন ভ্যালি গড়ে ওঠে এবং সেখান থেকে ব্যক্তিগত কম্পিউটারের যাত্রা শুরু হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন IBM, Microsoft, Apple, এবং পরবর্তীতে Google, Amazon কিংবা Facebook—সবাই কোনো না কোনোভাবে পূর্ববর্তী উদ্ভাবনকে ভিত্তি করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে।
এখানে লেখক এক বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন ওপেন কালচারের ধারণায়। রিচার্জ টারলটন কিংবা টিম বার্নার্স-লির মতো ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে ইন্টারনেটকে একটি উন্মুক্ত, অংশগ্রহণমূলক এবং জনকল্যাণমূলক মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার যে দৃষ্টান্ত রয়েছে, সেটিকে তিনি উদ্ভাবনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। যখন প্রযুক্তি শুধু মুনাফার জন্য ব্যবহৃত হয় না, বরং সমাজকে সংযুক্ত করে, তথ্যকে উন্মুক্ত রাখে, এবং জ্ঞানচর্চাকে ত্বরান্বিত করে—তখন তা সত্যিকারের ‘উদ্ভাবন’ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এই বইটির প্রাসঙ্গিকতা আরও গভীর। আমরা প্রায়শই প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকেই মনোযোগী হই, কিন্তু এর পিছনের চিন্তা, ইতিহাস ও মানসিকতার দিকে তেমন দৃষ্টিপাত করি না। উদ্ভাবনী শক্তি কেবল উন্নত দেশগুলির জন্য সংরক্ষিত নয়; বরং বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে এক একজন আডা লাভলেস, এক একজন টুরিং উঠে আসতে পারে—যদি তাদের চিন্তা করার, ব্যর্থ হওয়ার ও আবার দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। The Innovators এই আস্থা আমাদের জোগায়।
আইজ্যাকসনের লেখনীতে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট—তথ্যভিত্তিক ব্যাখ্যা ও মানবিক দৃষ্টিকোণের মিশ্রণ। তিনি প্রতিটি উদ্ভাবকের পেছনের মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের আবেগ, কষ্ট, আত্মবিশ্বাস, এবং ভুল সিদ্ধান্ত সবই উঠে এসেছে একটি গল্পের ছন্দে। যে কারণে বইটি নিছক একটি প্রযুক্তির ইতিহাস নয়, বরং এক মানবিক অভিযাত্রার দলিল। এই দৃষ্টিকোণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তি কখনোই নিছক যন্ত্র নয়, তা মানুষের স্বপ্ন ও সমাজের প্রতিফলন।
এই বই থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্মের শেখার আছে অনেক কিছু। প্রথমত, উদ্ভাবন মানেই এক রাতের সাফল্য নয়; বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা, অধ্যবসায়, সহযোগিতা ও অসংখ্য ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, যেকোনো নতুন চিন্তা বা আবিষ্কার তখনই কার্যকর হয়, যখন তা সমাজের বাস্তব প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি প্রযুক্তি তৈরির মনোভাব গড়ে তোলাও জরুরি—বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের জন্য, যারা ভবিষ্যতের বিশ্বে নিজেদের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে চায়।
যখন আমরা আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কিংবা স্পেস টেকনোলজির কথা ভাবি, তখন The Innovators বইটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় একটি মূল সত্য—প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ কেবল কোডে লেখা নয়, বরং তা লেখা হয় মানুষের কল্পনা, বিশ্বাস ও সাহসের অদৃশ্য অক্ষরে। এই বিশ্বাস নিয়েই আইজ্যাকসন আমাদের উৎসাহিত করেন, যেন আমরা নিজেরাই হই আগামী দিনের উদ্ভাবক। যেমন তিনি নিজেই বলেন, ‘ইতিহাস শুধু রক্ষণশীলদের লেখা নয়, এটি তৈরি হয় নতুন চিন্তার সাহসীদের হাত ধরে।’
তাই এই বই পড়া মানে শুধুই প্রযুক্তির ইতিহাস জানা নয়; এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতির অংশ, একটি অভ্যন্তরীণ আহ্বান—চিন্তা করো, প্রশ্ন করো, ব্যর্থ হও, এবং আবার উঠে দাঁড়াও। আর সেই পথেই তৈরি হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ, যেখানে প্রযুক্তি শুধু আমদানি করা হবে না, বরং রপ্তানির মতো রফতানি হবে আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি। The Innovators তাই একসময় ইতিহাসের দলিল হলেও, আজকের প্রজন্মের জন্য একটি জীবন্ত অনুপ্রেরণা।
Leave a comment