বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল ভিত্তি হল সত্যের অনুসন্ধান, যেখানে সততা ও নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অনেক গবেষণাপত্র প্রত্যাহার (retraction) হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা বৈজ্ঞানিক জগতের নৈতিক সংকটকেই ইঙ্গিত করে। সম্প্রতি, Nature পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিশদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চীনের কিছু হাসপাতাল থেকে শুরু করে ভারতের কিছু বেসরকারি কলেজ—বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রত্যাহারের হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
প্রত্যাহার কী?
গবেষণায় বড় কোনো ত্রুটি, জালিয়াতি বা নৈতিকতার লঙ্ঘন ধরা পড়লে, প্রকাশিত সেই গবেষণাপত্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা হারায়। জার্নাল কর্তৃপক্ষ তখন উক্ত কাজটি “প্রত্যাহার” করে নেয়, যাতে বৈজ্ঞানিক তথ্যভান্ডার পরিষ্কার থাকে এবং ভুল বা প্রতারণামূলক তথ্য পুনর্ব্যবহৃত না হয়।
কেন এত প্রত্যাহার বাড়ছে?
১) পেপার পাবলিশে সংখ্যা দিয়ে মূল্যায়নের সংস্কৃতি: গবেষণায় নিয়মিত প্রকাশনার (পেপার পাবলিশ) সংখ্যা দিয়ে একজন গবেষকের যোগ্যতা বা সফলতা মূল্যায়নের প্রবণতা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজের স্বীকৃতি পাওয়া, পদোন্নতি অর্জন করা কিংবা গবেষণার তহবিল পেতে হলে অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যক গবেষণাপত্র প্রকাশনা বাধ্যতামূলক বা উচ্চমূল্যায়িত হয়ে দাঁড়ায়।
ফলে গবেষকরা প্রায়ই অতি দ্রুত ও ক্রমাগত নতুন নিবন্ধ প্রকাশ করতে চেষ্টায় থাকেন, যাতে তাঁরা প্রচুর পেপার জমা দিতে পারেন। এই চাপে কিছু গবেষক সততা কিংবা সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করার পরিবর্তে শর্টকাট বা অনৈতিক উপায়ে (যেমন ডেটা সাজানো, অনুচিত সহযোগিতা বা প্লাগিয়ারিজম) কাজ এগিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ফেলেন। এ কারণেই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জালিয়াতি বা ত্রুটিপূর্ণ নিবন্ধের সংখ্যা বাড়তে পারে এবং শেষে অনেকগুলো পেপার প্রত্যাহার (retraction) করতে হয়।
২) পেপার মিলের (Paper Mills) উত্থান: ‘পেপার মিল’ (Paper Mills) বা ভুয়া গবেষণাপত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসী উত্থান সাম্প্রতিক সময়ে এক বিশেষ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে সম্পূর্ণ বা আংশিক ভুয়া গবেষণাপত্র তৈরি করা। কীভাবে এরা কাজ করে, কেনো এটা মারাত্মক সমস্যা, এবং বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর প্রভাব কী—এসব বিষয় নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
- কিভাবে পেপার মিল কাজ করে: সাধারণত পেপার মিলগুলোর সাথে যুক্ত কিছু ‘ঘোষিত’ বা ‘গোপন’ লেখক (ghostwriters) থাকে, যারা নির্দিষ্ট বিষয়ে বা ক্ষেত্রবিশেষে পুরোপুরি কাল্পনিক তথ্য বা ডেটা দিয়ে গবেষণাপত্র লেখে। এরপর ‘ক্রেতা’ (অর্থাৎ যে গবেষক বা চিকিৎসক প্রকাশনা সংগ্রহ করতে চান) তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ও প্রয়োজনীয় ডিটেইলস যোগ করে সেই পেপারটিকে নিজের নামে চালিয়ে দেন। কখনো কখনো বিদ্যমান কোনো গবেষণাপত্র সামান্য সম্পাদনা বা রদবদল করে নতুন রূপে প্রকাশ করা হয়, যাকে প্লাগিয়ারিজম বা নকলপত্র হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
- কেনো এটি মারাত্মক সমস্যা: পেপার মিল থেকে আসা নিবন্ধগুলোতে ব্যবহৃত ডেটা প্রায়ই বানানো অথবা বিদ্যমান গবেষণার তথ্য ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়। ফলে মূলত এগুলো বিজ্ঞানের নামে ভুল তথ্য ছড়ায়।
- বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা: এমন ভুয়া কাজ বৈজ্ঞানিক সমাজকে বিভ্রান্ত করে; আসল গবেষকদের কাজ খুঁজে পেতে সময় ও শ্রম ব্যয় হয়।
- নৈতিক বিপদ: যাঁরা এসব ভুয়া নিবন্ধ কিনে নিজের নামে চালিয়ে দেন, তাঁরা মূলত চরম ধরনের গবেষণা-অনৈতিকতার (misconduct) সঙ্গে যুক্ত হন। এতে ব্যক্তিগত সততা ক্ষুন্ন হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে বৈজ্ঞানিক বিশ্বসামাজিক মূল্যবোধের ওপর আঘাত আসে।
৩) দুর্বল গবেষণা-নিষ্ঠতা নীতি: কিছু প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ইন্টেগ্রিটি অফিস বা নৈতিকতা-পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাপনা দুর্বল। এতে এক বা দুইজন নয়, প্রতিষ্ঠানের বহু গবেষক অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
৪) ভুল বা পক্ষপাতদুষ্ট পিয়ার রিভিউ: জাল বা স্বজন-প্রীতিনির্ভর রিভিউ, অতিমাত্রায় আত্ম-উদ্ধৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে নিম্নমানের কিংবা জাল গবেষণা প্রকাশিত হয়ে যায়। পিয়ার রিভিউ হল গবেষণাপত্র প্রকাশের আগে সমমনা বা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা কৃত পর্যালোচনার প্রক্রিয়া। এই পর্যালোচনার লক্ষ্য—প্রকাশনার যোগ্যতা, মান, বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা ও নির্ভুলতা যাচাই করা। তবে অনেক ক্ষেত্রে পিয়ার রিভিউ পদ্ধতিতে নানা ধরনের অপব্যবহার ও ত্রুটি দেখা যায়, যার ফলে নিম্নমানের বা ভুয়া গবেষণাপত্রও প্রকাশ পেয়ে যায়।
- জাল বা স্বজন-প্রীতিনির্ভর রিভিউ: কোনো গবেষক নিজের পরিচিত ব্যক্তি বা একই গবেষণা-দলের কাউকে রিভিউয়ার হিসেবে প্রস্তাব করতে পারেন। এতে গবেষণার গুণগত মান যাচাইয়ের পরিবর্তে বন্ধুত্ব বা পারিবারিক সম্পর্কের কারণে পেপারটি সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।
- অবৈধ ‘ফেক’ রিভিউয়ার: কেউ কেউ ভুয়া ই-মেইল অ্যাকাউন্ট বা জাল পরিচয় তৈরি করে পিয়ার রিভিউয়ে অংশগ্রহণ করেন। ফলে তারা নিজস্ব স্বার্থে বা গোষ্ঠীস্বার্থে পেপার গ্রহণের সুপারিশ করতে পারেন, যা রিভিউ পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে তোলে।
- অতিমাত্রায় আত্ম-উদ্ধৃতি: কিছু ক্ষেত্রে রিভিউয়ার নিজেই (বা লেখকদের সাথেও যোগসাজশে) উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজের অন্য গবেষণাপত্রগুলোকে বেশি মাত্রায় উল্লেখ করানো (self-citation) বা পেপারে সংযুক্ত করিয়ে নেন, যাতে নিজস্ব সাইটেশন বাড়ে।
এতে মূল পেপারের মান বা প্রাসঙ্গিকতা বাড়ে না; বরং শুধুমাত্র রিভিউয়ার বা লেখকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা হয়।
গবেষণাপ্রবন্ধ প্রত্যাহারের পরিণতি
প্রত্যাহার বেড়ে যাওয়ায় জনসাধারণের মনে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি আস্থা কমতে পারে। সরকারি নীতিনির্ধারণে ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে, যদি ভিত্তিতে থাকে জাল গবেষণা। চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে রোগীর জীবনহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে চিকিৎসা হলে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও গবেষকের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়, এবং ভবিষ্যতে গবেষণা তহবিল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
কিভাবে প্রত্যাহারগুলো সমাধান করা যায়?
১) প্রাতিষ্ঠানিক কঠোর নজরদারি: বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অনৈতিক কাজ প্রতিরোধে স্বাধীন রিসার্চ ইন্টেগ্রিটি অফিস স্থাপন করা উচিত। এই অফিসটি কোন গবেষণা প্রবন্ধ কোন জার্নালে পাঠানোর আগে তা পর্যালোচনা এবং নিয়মিত অডিট করা উচিত। এই ধরনের ও দায়বদ্ধতা বাড়ালে জালিয়াতির সম্ভাবনা কমবে।
২) মূল্যায়নে গুণগত মাপকাঠি: কেবলমাত্র প্রকাশনার সংখ্যা দিয়ে নয়, তার প্রভাব, পুনরায় পরীক্ষাযোগ্যতা ও গুণগত মান দিয়েও গবেষকদের মূল্যায়ন করতে হবে। সাধারণত, ভালো গবেষণার মান নির্ণয় করা উচিত তার প্রভাব, বৈজ্ঞানিক স্বচ্ছতা ও পুনরায় পরীক্ষাযোগ্যতার (reproducibility) ওপর ভিত্তি করে— কেবলমাত্র “কতগুলো” নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে নয়। কিন্তু বর্তমানে “পাবলিশ অর পেরিশ” সংস্কৃতির ফলে অনেকে শুধুমাত্র সংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে জোর দেন, যা গবেষণার গুণগত মানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৩) পেপার মিল ও ভুঁইফোঁড় জার্নালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: বৈশ্বিক পর্যায়ে সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে ভুয়া প্রকাশনা ও জাল পিয়ার রিভিউ রুখতে কঠোর আইন ও ব্ল্যাকলিস্ট তৈরি প্রয়োজন। বর্তমানে ক্যাবেল’স ব্ল্যাকলিস্ট (Cabell’s Predatory Reports), বিল’s লিস্ট (Beall’s List) এবং Retraction Watch Database
৪) স্বচ্ছ ও শক্তিশালী পিয়ার রিভিউ: রিভিউ পদ্ধতি যথাসম্ভব উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ করা, এআই-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তথ্যজাল ও চিত্র-জালিয়াতি সনাক্ত করা, এবং রেপ্লিকেশন স্টাডি বা পুনরায় পরীক্ষার সংস্কৃতি জোরদার করা দরকার।
৫) সততা ও মূল্যবোধের চর্চা: শিক্ষার্থীদের শুরুর দিক থেকেই গবেষণার নীতিমালা, ডেটা বিশ্লেষণ এবং লেখালেখির সততা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। প্রকৃত জ্ঞানসাধনা ও দায়বদ্ধতা—এই দুটি গুণই ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাবে।
সততা ও গুণগত মানই হল বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির চালিকা শক্তি কিংবা আমরা বলতে পারি মানব জাতির অগ্রগতি। গবেষণা কাছে নিষ্ঠা, পদ্ধতিগত স্বচ্ছতা এবং নৈতিক মূল্যের পরিপালন নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা রিট্র্যাকশনের আধিক্য থেকে বেরিয়ে সত্যিকারের বিজ্ঞানের আলোয় এগিয়ে যেতে পারবো। পাশাপাশি, প্রতিটি ধাপে গবেষককে আত্মসমালোচনার সুযোগ ও তথ্য যাচাইয়ের যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধ ও সততার ধারাবাহিক চর্চার মাধ্যমেই শুধু এই রিট্র্যাকশন প্রবণতা নয়, বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সব ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতির মুখোমুখি হওয়া সম্ভব হবে। শেষ পর্যন্ত, সত্যিকার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মূল উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ ও জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করা—এটাই গড়ে তুলবে ভবিষ্যতের সুষ্ঠু ও সুস্থ গবেষণা-সংস্কৃতি।
Reference——– https://www.nature.com/articles/d41586-025-00455-y
Leave a comment