নিউইয়র্ক শহরের কোন একটি রাস্তার ঘটনা, তখন ঘড়ির কাঁটা বিকেল ৫টা। এই রাস্তায় কুকুরপ্রেমী লীনা তার পোষা কুকুর ব্রুনোর সঙ্গে হাঁটতে বের হয়েছেন। ব্রুনো একটি মাঝারি আকৃতির ল্যাব্রাডর, যে সাধারণত আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। কিন্তু আজ তার চোখে যেন কিছুটা ক্লান্তি, নড়াচড়াও ধীরগতির। লীনা বুঝতে পারছেন না, ব্রুনো কি অসুস্থ? নাকি সে মন খারাপ করেছে?
কিন্তু যদি এমন একটি প্রযুক্তি থাকত যা মুহূর্তেই ব্রুনোর মুখের অভিব্যক্তি বিশ্লেষণ করে বলে দিতে পারত, সে কেমন অনুভব করছে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবেগ বিশ্লেষণ: কুকুরের মুখভঙ্গির মাধ্যমে বার্তা বোঝা
বিজ্ঞানীরা আজ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট অফ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় (UWE) এবং স্কটল্যান্ডের রুরাল কলেজ (SRUC)-এর গবেষকরা “ডগফেস রিডার” নামে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সিস্টেম তৈরি করছেন, যা কুকুরের মুখভঙ্গি বিশ্লেষণ করে তার আবেগ বোঝার চেষ্টা করছে।
এমনকি এই প্রযুক্তি শুধু কুকুরকে চিনতে সক্ষম নয়, এটি তাদের ব্যথা, মানসিক চাপ বা হতাশার চিহ্নও শনাক্ত করতে পারে। ঠিক যেমন মানুষ হাসলে বা কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করলে আমরা বুঝতে পারি, তেমনি কুকুরদের চোখ, কান, মুখের পেশি এবং লেজের নড়াচড়া তাদের মনের অবস্থা প্রকাশ করে।
কুকুরের মুখভঙ্গি কীভাবে বিশ্লেষণ করা হয়?
চার্লস ডারউইন ১৮৭২ সালে তাঁর বিখ্যাত বই The Expression of the Emotions in Man and Animals -এ লিখেছিলেন যে, প্রাণীরা তাদের মুখভঙ্গি দিয়ে আবেগ প্রকাশ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কুকুরদের কিছু নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি আছে যা তাদের আনন্দ বা ব্যথার প্রকাশ করে:
- চোখ বড় করে তাকানো – উচ্ছ্বাস বা উত্তেজনার লক্ষণ।
- মুখ চেপে রাখা বা ঠোঁট শক্ত করে রাখা – হতাশা বা ব্যথার ইঙ্গিত।
- কান পেছনে টেনে নেওয়া – আতঙ্ক বা উদ্বেগ প্রকাশের চিহ্ন।
- জিহ্বা বারবার বের করা – মানসিক চাপের লক্ষণ।
গবেষকরা হাজার হাজার কুকুরের ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে AI মডেলকে এই অভিব্যক্তিগুলি শনাক্ত করতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
AI-এর মাধ্যমে দ্রুত এবং নির্ভুল নির্ণয়
মানুষের পক্ষে প্রাণীদের প্রতিটি নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করা কঠিন, কিন্তু AI এই বিশ্লেষণ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে করতে পারে। গবেষকরা বিভিন্ন প্রাণীর ছবি সংগ্রহ করে AI মডেলকে প্রশিক্ষণ দেন। এভাবে AI স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুখের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি শনাক্ত করে এবং মুখের বিভিন্ন বিন্দুর দূরত্ব পরিমাপ করে বুঝতে পারে, প্রাণীটি ব্যথা বা উদ্বেগে আছে কিনা।
বিগত বছরগুলোতে বেশ কিছু AI মডেল প্রাণীদের ব্যথা শনাক্ত করতে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছে। যেমন:
- কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ২০১৬ সালে এক গবেষণায় দেখান যে, তাদের তৈরি AI সফটওয়্যার দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে ভেড়ার ব্যথার মাত্রা নির্ধারণ করতে পারে।
- হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বিড়ালদের ব্যথার মাত্রা ৭৭% নির্ভুলতার সাথে শনাক্ত করতে সক্ষম AI মডেল তৈরি করেছেন।
- সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দেখিয়েছেন যে, AI ঘোড়ার মুখভঙ্গির উপর ভিত্তি করে ৮৮% নির্ভুলতার সাথে ব্যথা চিহ্নিত করতে পারে।
AI কি প্রাণীদের সুখ-দুঃখ বুঝতে পারবে?
এখন প্রশ্ন হলো, AI কি শুধু ব্যথা ও মানসিক চাপই শনাক্ত করতে পারবে, নাকি এটি আরও জটিল আবেগও বুঝতে সক্ষম হবে?
গবেষকদের মতে, এটি সম্ভব। যেমন:
- একদল বিজ্ঞানী ল্যাব্রাডর কুকুরদের মুখভঙ্গি বিশ্লেষণ করে AI মডেল তৈরি করেছেন, যা ৮৯% নির্ভুলতার সাথে “আনন্দ” এবং “হতাশা” চিহ্নিত করতে পারে।
- একইভাবে, ঘোড়ার মুখভঙ্গি বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন যে, AI ৬১% নির্ভুলতার সাথে বুঝতে পারে যে ঘোড়াটি হতাশ হয়েছে কি না।
এটি বোঝা যাচ্ছে যে, AI শুধুমাত্র ব্যথা বা মানসিক চাপই নয়, বরং প্রাণীদের আনন্দ, হতাশা বা উত্তেজনার মতো আবেগও বুঝতে শিখছে।
ভবিষ্যতে প্রাণী কল্যাণে AI-এর ভূমিকা
AI-এর এই উন্নতি প্রাণী কল্যাণে বিপ্লব ঘটাতে পারে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ফার্ম ও গবেষণাগারে AI ব্যবহার শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে:
- পশু চিকিৎসকরা দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে প্রাণীদের ব্যথা নির্ণয় করতে পারবেন।
- পোষা প্রাণীর মালিকরা মোবাইল অ্যাপে ছবি আপলোড করে সহজেই তাদের প্রাণীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য পেতে পারেন।
- স্মার্ট ফার্মিং প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিটি প্রাণীর স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখা সম্ভব হবে, যা প্রাণী কল্যাণের মান উন্নত করবে।
শেষ কথা
AI প্রাণীদের মুখভঙ্গি বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যথা, মানসিক চাপ এবং অন্যান্য আবেগ বোঝার দক্ষতা অর্জন করছে। যদিও এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে গবেষকদের বিশ্বাস, খুব শীঘ্রই AI প্রাণীদের আরও জটিল আবেগও বুঝতে পারবে। প্রাণী কল্যাণের ক্ষেত্রে এটি এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।
রেফারেন্স:———-
https://www.science.org/content/article/can-ai-read-pain-and-other-emotions-your-dog-s-face
আপনার মন্তব্য জানাতে পারেন: biggani.org
Leave a comment