রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে নিলয় বিস্ময়ে ভাবছিল, “কত অদ্ভুত এই মহাবিশ্ব! আমাদের ছোট্ট পৃথিবীর বাইরে বিশাল বিস্তীর্ণ নক্ষত্ররাজি, গ্যালাক্সি, নেবুলা—এসবের কতটুকুই-বা আমরা জানি?”
সে বিজ্ঞানপ্রেমী এবং জ্যোতির্বিদ্যায় প্রচণ্ড আগ্রহী। সম্প্রতি সে কারিনা নেবুলার (Carina Nebula) তিনটি আলাদা ছবি দেখেছিল, যা তিনটি ভিন্ন প্রযুক্তিতে তোলা হয়েছিল—একটি পৃথিবী থেকে, আর দুটি মহাকাশ থেকে। ছবিগুলোর মধ্যে পার্থক্য দেখে নিলয়ের মনে হলো, “একই বস্তু, কিন্তু এত আলাদা কেন?”
তাহলে চলুন, আমরা একসঙ্গে এই অসাধারণ নেবুলার তিনটি ছবি বিশ্লেষণ করি এবং দেখি, কীভাবে প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করছে।
প্রথম পর্যায়: লা সিলা অবজারভেটরি (La Silla Observatory) – পৃথিবীর চোখ থেকে মহাকাশ
চিলির আকাশ পৃথিবীর সবচেয়ে স্বচ্ছ রাতের আকাশগুলোর মধ্যে একটি। সেখানে অবস্থিত লা সিলা অবজারভেটরি, যা ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরি (ESO) পরিচালিত একটি শক্তিশালী স্থলভিত্তিক টেলিস্কোপ কেন্দ্র।
নিলয় যখন এই টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা কারিনা নেবুলার ছবি দেখল, তখন সে বুঝতে পারল যে ছবিটি সুন্দর হলেও, এতে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।
📌 পরিসংখ্যান:
- পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল (atmosphere) মহাকাশের আলোকে বিকৃত করে ফেলে, যার ফলে স্থলভিত্তিক টেলিস্কোপের তোলা ছবি ঝাপসা হয়।
- লা সিলা টেলিস্কোপের আয়না ব্যাস ৩.৬ মিটার, যা অনেক বড় হলেও, তা মহাকাশভিত্তিক টেলিস্কোপের সাথে তুলনীয় নয়।
- বিশ্বব্যাপী বর্তমানে ১০,০০০-এরও বেশি গ্রাউন্ড-ভিত্তিক টেলিস্কোপ রয়েছে, কিন্তু তাদের সবসময় আবহাওয়া ও বায়ুমণ্ডল দ্বারা সীমাবদ্ধ করা হয়।
কিন্তু মহাকাশের মধ্য থেকে যদি ছবি তোলা যায়?
দ্বিতীয় পর্যায়: হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (Hubble Space Telescope) – মহাকাশের জানালা
১৯৯০ সালে নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) যৌথভাবে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (HST) উৎক্ষেপণ করে, যা পৃথিবীর বাইরে থেকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে।
নিলয় যখন হাবলের তোলা কারিনা নেবুলার ছবি দেখল, তখন সে হতবাক হয়ে গেল! এখানে অসংখ্য নক্ষত্রের জন্ম হতে দেখা যাচ্ছে, বিশালাকার গ্যাস ও ধুলোর স্তম্ভ (Pillars of Creation) যেন মহাকাশের এক মহাকাব্য।
📌 পরিসংখ্যান:
- হাবল টেলিস্কোপ ৫.৪ মিটার দীর্ঘ, এবং এটি পৃথিবী থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার উপরে কক্ষপথে ঘোরে।
- হাবল মূলত আল্ট্রাভায়োলেট (UV) ও অপটিক্যাল রশ্মি ব্যবহার করে, যার ফলে গ্যাসীয় নেবুলার বিশদ ছবি পাওয়া যায়।
- ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাবল ১৫ লাখেরও বেশি ছবি তুলেছে!
তবে নিলয়ের মনে হলো, “হাবল এত ভালো ছবি তুলতে পারে, তাহলে আরও শক্তিশালী কিছু থাকলে কী হতো?”
তৃতীয় পর্যায়: জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) – মহাকাশের অদৃশ্য পর্দা উন্মোচন
২০২১ সালের ডিসেম্বরে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয় জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope – JWST), যা এখন পর্যন্ত মানুষের তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী মহাকাশ পর্যবেক্ষক যন্ত্র।
নিলয় যখন JWST-এর তোলা “Cosmic Cliffs” নামে পরিচিত কারিনা নেবুলার ছবি দেখল, তখন তার শ্বাস থমকে গেল! হাবলের তুলনায় এখানে ধুলোর স্তর অনেক কম দেখা যাচ্ছে, এবং তারার জন্মক্ষেত্রগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
📌 পরিসংখ্যান:
- JWST-এর আয়না ব্যাস ৬.৫ মিটার, যা হাবলের তুলনায় ২.৭ গুণ বড়!
- এটি ইনফ্রারেড প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যার ফলে ধূলিকণা ভেদ করে আরও গভীর পর্যবেক্ষণ করা যায়।
- এটি পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট (L2)-এ অবস্থান করছে।
- JWST মহাকাশের ১৩.৫ বিলিয়ন বছরের পুরনো আলোর উৎস বিশ্লেষণ করতে সক্ষম!
কেন JWST এত উন্নত?
1️⃣ ইনফ্রারেড প্রযুক্তি:
- যেখানে হাবল নেবুলার ধূলিকণায় আটকে যায়, সেখানে JWST ধূলিকণা ভেদ করে তারার জন্ম দেখাতে পারে।
2️⃣ বিশাল আয়না:
- বড় আয়না মানে বেশি আলো সংগ্রহ করা, যার ফলে আরও দূরের ও ক্ষীণ আলোর বস্তু দেখা সম্ভব।
3️⃣ অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় কাজ করে:
- JWST-এর অপটিক্যাল সিস্টেম -২৩৩°C এ রাখা হয়, যাতে ইনফ্রারেড বিকিরণে কোনো বিঘ্ন না ঘটে।
তিনটি ছবি তুলনা করলে যা পাওয়া যায়:
বৈশিষ্ট্য | লা সিলা (পৃথিবী ভিত্তিক) | হাবল (মহাকাশ ভিত্তিক) | JWST (সর্বোচ্চ উন্নত) |
---|---|---|---|
চিত্রের স্বচ্ছতা | মাঝারি (বায়ুমণ্ডলের কারণে সীমাবদ্ধ) | উজ্জ্বল ও বিস্তারিত | অত্যন্ত স্বচ্ছ, ধূলিকণা ভেদ করে দেখতে পারে |
আলোক তরঙ্গ | দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ | আল্ট্রাভায়োলেট ও দৃশ্যমান আলোক | ইনফ্রারেড (ধূলিকণা ভেদ করতে পারে) |
আয়নাচল ব্যাস | ৩.৬ মিটার | ২.৪ মিটার | ৬.৫ মিটার |
স্থানীয় বাধা | মেঘ, আবহাওয়া, দূষণ | বায়ুমণ্ডল নেই, পরিষ্কার ছবি | দীর্ঘতম তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিশদ পর্যবেক্ষণ |
শেষ কথা: ভবিষ্যৎ কোথায় যাচ্ছে?
নিলয় বুঝতে পারল, কেবল কয়েক দশকের ব্যবধানে আমরা মহাবিশ্ব দেখার পদ্ধতিতে বিপ্লব এনেছি। স্থলভিত্তিক টেলিস্কোপ থেকে শুরু করে, মহাকাশের সবচেয়ে উন্নত পর্যবেক্ষণ যন্ত্র JWST পর্যন্ত আমাদের যাত্রা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
🚀 আগামীতে কি আরও বড় টেলিস্কোপ আসবে?
- নাসা “হাবল উত্তরসূরী” নামে নতুন মহাকাশ টেলিস্কোপ তৈরির কাজ করছে।
- ESO “এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ (ELT)” তৈরি করছে, যার আয়না ৩৯ মিটার!
নিলয় মনে মনে ভাবল, “যদি আজ JWST আমাদের মহাবিশ্বের অন্ধকার কুয়াশা ভেদ করতে পারে, তাহলে ৫০ বছর পর আমাদের প্রযুক্তি কতদূর যেতে পারে?”
🌌 মহাকাশ অন্বেষণের যাত্রা এখনো শেষ হয়নি, বরং এটি কেবল শুরু!
Leave a comment