কৃতি বিজ্ঞানীদের সিরিজে আমি কথা বলেছি ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন এর সাথে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সান জোস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করে দেশের টানে বর্তমানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষাকতা করছেন। উল্লেখ্য ফারিয়াহ মাহযাবীন আমারই ছাত্রী ছিলেন এবং নিজের সেই ছাত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে পেরে খুব গর্ববোধ হচ্ছিল। বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য অনেকেই প্রবাস পাড়ি দিলেও ফারিয়াহ-র মতন অনেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসছেন এবং দেশের জন্যই নিজেকে নিবেদন করছেন। সেই অদ্ভূত পাগল মানুষগুলির মধ্যে ফারিয়াহ কে আবিষ্কার করে সত্যিই খুব গর্ববোধ হচ্ছে। সত্যিই ফারিয়াহ মাহযাবীন এর মতন বিজ্ঞানীরা আমাদের গর্ব। ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন এর সাক্ষাৎকারটি নিম্নে পড়ুন:
প্রথমেই আপনার সম্বন্ধে আমাদের একটু বলুন
আমি বর্তমানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ইলেকট্রিক্যাল এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং (ECE) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এখানে যোগদানের আগে, আমি যুক্তরাষ্ট্রের সান জোস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে টেনিউর-ট্র্যাক সহকারী অধ্যাপক ছিলাম। আমি এছাড়াও আলফাবেট ইনক. এবং গুগল ক্লাউডে হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছি।
আমি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আমার এমএস, পিএইচডি এবং পোস্টডক সম্পন্ন করেছি সম্পূর্ণ স্কলারশিপে (“ফুলব্রাইট” এবং “ফ্যাকাল্টি ফর দ্য ফিউচার” ফেলোশিপ)। আমার পিএইচডি এবং পোস্টডক্টরাল গবেষণা ছিল পয়েন্ট-অফ-কেয়ার রক্তের ডায়াগনস্টিকের জন্য একটি বায়োসেন্সর ডিজাইনের উপর। এটি নাসা গ্রান্টে নির্বাচিত হয়েছিল, যার মাধ্যমে আমরা নভোচারীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য বায়োসেন্সরটি আরও উন্নত করেছি। এই গবেষণায় সেমিকন্ডাক্টর এবং অপটিক্যাল সেন্সর ডিজাইন থেকে ক্লিনিক্যাল পাইলট স্টাডি পর্যন্ত বহুবিধ বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আপনার গবেষনার বিষয় কি?
ডিজিটাল হেলথ বিষয়টি বেশ ব্যাপক। এটি STEM-এর বিভিন্ন ক্ষেত্র, হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারকে সংযুক্ত করে, আমি সমন্বিত গবেষণা (interdisciplinary research) ধারণায় আগ্রহী। সমন্বিত গবেষণা বলতে বোঝায় – একটি এক্সপার্ট বিষয়কেই শুধু ফোকাস করে নয়, বরং বিভিন্ন এক্সপার্ট বিষয়গুলিকে সমন্বয় করে কিভাবে একটি সমস্যাকে আমরা সমাধান করতে পারি। আমার বর্তমান গবেষণা প্রকল্পগুলি শিক্ষার্থীদেরকে চ্যালেঞ্জিং এবং অর্থবহ সমস্যা সমাধান করার জন্য মনোযোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। উদাহরণস্বরূপ:
১. বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য বিদ্যমান স্মার্টওয়াচের ব্যবহারযোগ্যতা মূল্যায়ন। এই গবেষণার প্রথম ধাপ হল বয়স্কদের মধ্যে স্মার্টওয়াচের মতো পরিধানযোগ্য ডিভাইস গ্রহণের বাধাগুলি মূল্যায়ন করা, যাদের এই ধরনের হোম মনিটরিং প্রযুক্তি থেকে সর্বাধিক উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরবর্তী ধাপে, আমরা ফলাফলগুলি সংহত করে সাশ্রয়ী মূল্যে বয়স্ক প্রজন্মের জন্য একটি কাস্টমাইজড, ব্যবহারবান্ধব ঘড়ি উন্নয়ন করবো।
২. মাঠ পর্যায়ে টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া সনাক্তকরণের জন্য একটি বায়োসেন্সর উন্নয়ন। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সাথে সহযোগিতায় আমরা করছি, যেখানে আমাদের সেন্সরটি দ্রুত এবং আরও কার্যকরভাবে ব্যাকটেরিয়াকে সনাক্ত করতে সক্ষম হবে, ফলে টাইফয়েডের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে।
৩. তাপ-সম্পর্কিত রোগের ঝুঁকি পূর্বাভাসের জন্য AI (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং IRB (“Institutional Review Board” বা “প্রাতিষ্ঠানিক পর্যালোচনা বোর্ড”) (নোট সম্ভবত: EHR: Electronic Health Records বা হাসপাতালগুলিরে সংরক্ষিত ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড) থেকে প্রাপ্ত রোগীর ডেটা ব্যবহার।
৪. মেশিন লার্নিং মডেলের মাধ্যমে গ্লুকোমা সনাক্তকরণ। গ্লুকোমা হলো চোখের একটি রোগ যেখানে চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ (ইন্ট্রাওকুলার প্রেসার) বৃদ্ধি পায়, যা অপটিক নার্ভকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অপটিক নার্ভ চোখ থেকে মস্তিষ্কে দৃশ্যমান তথ্য প্রেরণ করে, তাই এই নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে পারে এবং এমনকি স্থায়ী অন্ধত্বও ঘটতে পারে।
৫. বয়স্কদের জন্য পতন সনাক্তকরণ মনিটরিং সেন্সর, অর্থাৎ বয়স্ক মানুষেরা বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার সতর্কবার্তা জানাতে সক্ষম হবে।
৬. একাধিক সেন্সর এবং মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে বাড়িতে হৃদরোগের ঝুঁকি মনিটরিং।হৃদরোগের ঝুঁকি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমাতে এবং হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যায়।
৭. স্মার্টফোনের ছবি এবং মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে একাধিক চর্মরোগ সনাক্তকরণ: স্মার্টফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে চর্মের ছবি তুলে মেশিন লার্নিং এবং ডিপ লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চর্মের সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়। এটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যেখানে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞদের অভাব রয়েছে সেখানে এই প্রযুক্তিটি ভূমিকা রাখবে বলে গবেষকরা মনে করেন।
একজন বিজ্ঞানীর কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আমি মনে করি একজন বিজ্ঞানীর নিম্নের ৭টি গুণ থাকা প্রয়োজন:
১. চ্যালেঞ্জ এবং অস্পষ্টতার মধ্য দিয়ে পথ খুঁজে নেওয়ার দৃঢ়তা: কোন কিছূ নিয়ে গবেষণার কাজে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তা আসে এবং সেটিই স্বাভাবিক। এই গুণটি হলো সেই মানসিক শক্তি ও সহনশীলতা যা আপনাকে এসব বাধা অতিক্রম করতে এবং সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। এটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্থিতিশীল থাকা এবং সমাধান খুঁজে বের করার ক্ষমতা নির্দেশ করে।
২. আজীবন শিখতে চাইবার আগ্রহ: এটি এমন একটি মানসিকতা যেখানে আপনি সবসময় নতুন কিছু শিখতে উৎসাহী থাকেন। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণ এবং নিজেকে উন্নত করার আগ্রহকে বোঝায়। ক্রমাগত শেখার মাধ্যমে আপনি সময়ের সাথে সাথে নিজেকে সমৃদ্ধ ও সক্ষম করে তুলতে পারেন।
৩. মনোযোগ ও নমনীয়তা: নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। এটি কাজের প্রতি একাগ্রতা বজায় রাখা এবং পরিবর্তনশীল পরিবেশে কার্যকরভাবে সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা বোঝায়।
৪. গভীর ও বিস্তৃতভাবে চিন্তা করার প্রযুক্তিগত দক্ষতা: প্রযুক্তিগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তা প্রয়োগ করতে পারা। এটি সমালোচনামূলক চিন্তা, সমস্যা সমাধান এবং উদ্ভাবনী ধারণা সৃষ্টি করার ক্ষমতা বোঝায়।
৫. প্রযুক্তি ও সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা: বর্তমান প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং একই সঙ্গে সামাজিক প্রভাব ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা। এটি প্রযুক্তির ব্যবহার ও তার প্রভাব সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা এবং সমাজের মঙ্গলার্থে তা প্রয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
৬. সহযোগিতা ও যোগাযোগ: বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা গবেষক ও স্পেশালিস্ট লোকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কাজ করা এবং কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করা। এটি দলগত কাজে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ দক্ষতা ও সহযোগিতামূলক মানসিকতা নির্দেশ করে।
৭. ধৈর্য: প্রতিকূলতা বা বিলম্বের সময়েও শান্ত ও স্থির থাকা। এটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করার এবং কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বোঝায়।
বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী যারা বিজ্ঞানে কাজ করতে চায় – তাদের জন্য আপনার কোন ম্যাসেজ কিংবা বার্তা কি?
আজকের এই ইন্টারনেট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বিজ্ঞান বা উদ্ভাবন নির্দিষ্ট কোনো সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়।
বাংলাদেশের যুবসমাজের মধ্যে এক অবিশ্বাস্য শক্তি রয়েছে, যা তারা সর্বাধিক ফলপ্রসূ পথে পরিচালিত করতে পারে। STEM ক্ষেত্রে, তরুণরা এখন উদীয়মান প্রযুক্তি সম্পর্কে শেখার জন্য প্রায় সমস্ত তথ্যগুলি হাতের নাগালে পাচ্ছে । শিক্ষার্থীদের উচিত STEM-এ বর্তমান প্রবণতা এবং সর্বশেষ ও সর্বোত্তম উদ্ভাবনের সাথে আপডেট থাকা। আজকের উদ্ভাবনগুলির জন্য আন্তঃবিষয়ক পদ্ধতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের গবেষণা প্রয়োজন — AI/ML, সেন্সর, সার্কিট, IoT, বায়োমেডিক্যাল, মেকানিক্যাল, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ — সবই এখন একে অপরের সাথে সংযুক্ত। আমাদের শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত এবং এমন প্রভাবশালী, আন্তঃবিষয়ক প্রকল্পে যুক্ত হতে আগ্রহী হওয়া উচিত — এবং আমরা শিক্ষকরা সর্বদা তাদের সেই যাত্রায় সহায়তা করতে উদগ্রীব!
আপনার সাথে যোগাযোগের তথ্য
fariahmahzabeen @ gmail.com
Leave a comment