লেখক: সাইফ ইসলাম
সিলিকন ভ্যালি গত কয়েক দশকে আকারে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এটি এখন San Jose’র দক্ষিণ অঞ্চল থেকে সান ফ্রান্সিসকো ছাড়িয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী স্যাক্রামেন্টোর উত্তর পর্যন্ত প্রায় ১৫০ মাইল বিস্তৃত হয়েছে।
সিলিকন ভ্যালিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী প্রযুক্তি ও স্টার্টআপ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়। এখানে প্রযুক্তি কোম্পানির একটি অতুলনীয় ঘনত্ব রয়েছে, যা apple, google আর Facebook এর মতো ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে হাজার হাজার স্টার্টআপ এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলটি উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা কার্যক্রম, এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তি শিল্পে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য পৃথিবীজুড়ে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নেতাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করছে বিগত দশক গুলোতে।
উচ্চপ্রযুক্তির কোম্পানি ছাড়াও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম (যেমন স্ট্যানফোর্ড, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) এবং একটি শক্তিশালী ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মের নেটওয়ার্ক এটিকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি এবং স্টার্টআপ কার্যক্রমের জন্য প্রধান কেন্দ্র করে তুলেছে। চীনের শেনঝেন এবং ভারতের বেঙ্গালুরুর মতো পৃথিবীর আরও কিছু অঞ্চল প্রযুক্তি উন্নয়নে একই পথে হাঁটছে।
আমেরিকার মাটিতে অনেক বছর ধরেই এধরণের চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং আর হচ্ছেনা, যদিও, মাইক্রোচিপ বিপ্লব ৬০ এর দশকের শেষের দিকে সিলিকন ভ্যালিতেই শুরু হয়েছিল। একাজগুলো গত তিন দশকে নিঃশব্দে চলে গেছে দূর প্রাচ্যের দেশগুলোতে যাদের কেউ কেউ আর আমেরিকার মিত্র নয়। বর্তমানে আমেরিকায় মাইক্রোচিপ উৎপাদনের মাধ্যমে হার্ডওয়্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে আর সেকারণে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি আমেরিকার মাটিতে অথবা বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে (যেমন ভিয়েতনাম, মালয়শিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মেক্সিকো, ইত্যাদি) চিপ নির্মান করে আমেরিকায় রপ্তানি করার পরিকল্পনা করছে। ২০২২ সালে, প্রায় $৪২০ বিলিয়ন (৪২ হাজার কোটি ডলার) মূল্যের সেমিকন্ডাক্টর চিপ আমেরিকা আমদানি করেছিল।
জার্মান কোম্পানি Robert Bosch GmbH-এর বাৎসরিক আয় প্রায় ১০,০০০ কোটি মার্কিন ডলারের কাছাকাছি (অনেকটা বাংলাদেশের পুরো বৈদেশিক ঋণের সমতুল্য)। তাদের প্রায় সাড়ে চার লাখ কর্মী রয়েছে বিশ্বজুড়ে।
সম্প্রতি Bosch ঠিক করেছে আমেরিকার মাটিতে মাইক্রোচিপ তৈরি করবে আর সেই উদ্দেশ্যে আমার শহর Davis থেকে ৩০ মাইল দূরের Roseville-এ (স্যাক্রামেন্টোর একটি উপশহর) একটি পুরনো মার্কিন চিপ নির্মাতা TSI Semiconductors Corporation (প্রাক্তন নাম Telefunken Semiconductor) এর সম্পদ কিনে নিয়েছে। প্রায় ১৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের এচুক্তিতে রয়েছে আধুনিকীকরণের এক বড় উদ্যোগ।
কিন্তু প্রশিক্ষিত জনবল পাওয়াটাই এখন সবচেয়ে কঠিন সমস্যা Bosch এর জন্য।
কীভাবে Bosch এ সমস্যা সমাধান করার পরিকল্পনা করছে?
Bosch এখন বৃহত্তর স্যাক্রামেন্টোর সবগুলো ইউনিভার্সিটি, কমিউনিটি কলেজ (২ বছরের অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রী প্রদানকারী) আর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সাথে কাজ করছে প্রকৌশলী আর টেকনিশিয়ান (যন্ত্রবিৎ) প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। নতুন করে ডিপার্টমেন্ট খোলা হচ্ছে ইউনিভার্সিটি আর কমিউনিটি কলেজে, আধুনিক মানের হাতে -কলমে শিক্ষার ল্যাব বানানো হচ্ছে, কারিগরি সাহায্য দিতে সক্ষম এমন সকল কোম্পানি, এনজিও, আর প্রফেশনাল ক্লাবের সাথে কাজ করছে Bosch এর কর্মকর্তারা।
Greater Sacramento Economic Council (GSCR) এসব উদ্যোগে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করছে। এ অঞ্চলে সবাইকে একতাবদ্ধভাবে কোনো প্রকল্পে কাজ করাতে পারে তারা। তাদের প্রভাব আর গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা আমাদের ডক্টর ইউনুসের মতো এবং এটাকে তারা কাজে লাগাচ্ছে পুরোপরি। জুলাই মাসে তাদের নেতৃবৃন্দ একসাথে সান ফ্রান্সিসকোতে Semicon West যোগ দিয়েছিলেন কীভাবে সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি এঅঞ্চলে নতুন কর্মসংস্থানে আর অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে তা বোঝার জন্য। GSCR এর প্রবীণ নেতৃত্বের তারুণ্যময় উদ্দীপনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার অন্য সব প্রোগ্রাম বাতিল করে একটা অপরাহ্ন আমি তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করেছি Semicon West কনফারেন্সে।
ক্যালিফোর্নিয়া গভর্নরের অফিস আমি যেখানে কর্মরত সেই CITRIS-এর চারটা ক্যাম্পাসকে (বার্কলে, ডেভিস, সান্তা ক্রুজ আর মারসেড) অর্থ প্রদান করেছে যা দিয়ে প্রতিবছর ১০০ early stage আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র ছাত্রীকে ইন্টার্নশিপ প্রদান করা হয় যেন তারা ইন্ডাস্ট্রি আর ইউনিভার্সিটি ল্যাবগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। সেমিকন্ডাক্টর মাইক্রোচিপ ম্যানুফ্যাকচারিং এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ।
মার্কিন ফেডারেল এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের পক্ষ থেকে অনেক ওয়ার্কফোর্স ট্রেনিং (কর্মী প্রশিক্ষণ) অনুদান দেয়া শুরু হয়েছে। কাছাকাছি এবং দূরবর্তী প্রযুক্তি ভিত্তিক কোম্পানিগুলো এবং ন্যাশনাল ল্যাবগুলি কর্মশক্তির ঘাটতি সমাধানের জন্য তাদের সময় আর ল্যাব রিসোর্স প্রদান করছে৷ একইভাবে Intel, Micron, Texas Instrument এবং অন্যান্য অনেক কোম্পানি ইউনিভার্সিটি আর কলেজগুলোতে সাহায্য পাঠাচ্ছে কর্মী প্রশিক্ষণে জোর দেওয়ার জন্য। এবছর জুলাই-আগস্টের একটা বড় সময় আমি অনেকটা সময় এরকম বেশ কয়েকটি কার্যক্রমের পরিকল্পনায় জড়িত ছিলাম।
ক্যালিফর্নিয়া আমেরিকার সবচেয়ে ধনী অঙ্গরাজ্য, ভারত অথবা যুক্তরাজ্য থেকেও জিডিপির দিক থেকে উপরে। অথচ, এর রাজধানীতে আর আশেপাশের শহরগুলোতে দরীদ্র্য আর বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ফেডারেল, স্টেট, সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি, ন্যাশনাল ল্যাব, ইউনিভার্সিটি, কমিউনিটি কলেজের অগণিত ফ্যাকাল্টি, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক আর সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টায় এই কর্মী প্রশিক্ষণ এই অঞ্চলের সামাজিক আর অর্থনৈতিক উন্নতিতে সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস।
সাইফ ইসলাম Center for Information Tech Research in the Interest of Society-UC Davis এর ডিরেক্টর এবং University of California, Davis এর প্রোফেসর।
Leave a comment