বস্তুর প্রতিসাম্যের কথা

বস্তুর প্রতিসাম্যের কথা

লেখকঃ হিমাংশু কর

সংগৃহীতঃ ফেইসবুক পোস্ট

 

পদার্থবিজ্ঞানে প্রতিসাম্যের ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে- আমাদের মহাবিশ্বের মত একটি মহাবিশ্বের কেন অস্তিত্ব থাকবে তা প্রতিসাম্যের ধারণা ছাড়া বোঝাই সম্ভব না। তবে মজার বিষয় হলো, এই প্রতিসাম্যের ধারণাটা বোঝার জন্য আপনাকে বিশাল জটিল সমীকরণ না জানলেও চলবে। যদি কোন বস্তুকে কোন ধরনের পরিবর্তনের করার ফলেও তার কোন একটি বৈশিষ্ট্য ঠিক আগের মতই থাকে, তবে তাকে প্রতিসাম্য বলা যায়। কোন বস্তু যত বেশি পরিবর্তন সহ্য করতে পারবে, তার প্রতিসাম্য তত বেশি। বিষয়টাকে একটু ভিজুয়ালি ব্যাখ্যা করি। একটা বর্গক্ষেত্রের কথা ধরুন। এই বর্গক্ষেত্রকে যদি আপনি ৯০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ফেলেন, তখন বর্গক্ষেত্রটাকে দেখতে ঠিক আগের মতই লাগবে। বর্গক্ষেত্র আঁকাটা যদি সঠিক হয়, তবে আপনি শত চেষ্টা করেও ঘুরানোর আগের বর্গক্ষেত্র এবং ৯০ ডিগ্রি ঘুরানোর পরের বর্গের মধ্যে কোন পার্থক্য করতে পারবেন না। আপনি যতবার এভাবে ৯০ ডিগ্রি ঘুরাবেন ততবারই এটা একটা ছেম বর্গক্ষেত্র তৈরি করবে। এই যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না, এই বৈশিষ্ট্যটা এক ধরনের প্রতিসাম্য।

আবার একটি বৃত্তের কথা চিন্তা করুন। এটার পৃষ্ঠতল ঠিক রেখে আপনি ১ ডিগ্রি বা ১০০ ডিগ্রি যে কোনেই ঘুরান না কেন তা ঠিক আগের মতই থাকবে। কোন পার্থক্য করা সম্ভব না। যেহেতু বর্গের ক্ষেত্রে প্রতিবার শুধুমাত্র ৯০ ডিগ্রি ঘুরালে এটাকে আগের অবস্থায় পাওয়া যেত, আর বৃত্তের ক্ষেত্রে যেকোনো কোণে ঘুরানোর স্বাধীনতা আছে, তার মানে এখানে প্রতিসাম্যের জন্য স্বাধীনতার পরিমাণ বেশি। তাই বৃত্তের প্রতিসাম্য বর্গের চেয়ে বেশি।

এখন আপনার মনে হতে পারে- এতে কি এমন যায় আসে! যায় আসে ভাই, যায় আসে। আসলে প্রতিসাম্য আপনাকে বাধ্যবাধকতা দিয়ে দেয়, সীমা আরোপ করে দেয়। এটাই হলো প্রতিসাম্যের শক্তি। যেমন, আপনি যদি আমাকে বলেন- আমি কাগজের উপর এমন একটি ফিগার একেছি, যেটাকে তুমি ইচ্ছেমত ঘুরাতে পারবে, কিন্তু সেটা দেখতে হুবহু একই রকম থাকবে, তখন আমি বলে দিতে পারব যে ওই চিত্রটা আপনি বৃত্তই একেছেন। কারন বৃত্ত ছাড়া আপনি এমন কোনকিছুই আকতে পারবে না, যার এমন একটি শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য আছে। অর্থাৎ প্রতিসাম্য যত বৃদ্ধি পেতে থাকবে, যেকোনো কিছু ঘটার সম্ভাবনা তত কমতে থাকবে। এভাবেই বিভিন্ন শক্তিশালী প্রতিসাম্যের কারণে রুলস বা নিয়ম তৈরি হতে পারে। এমনটাই হয়। গেজ সিমেট্রি থেকেই প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের উদ্ভব হয়। এটাই কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির মূলকথা। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ধরনের প্রতিসাম্যে নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেগুলো মধ্যকার বৈচিত্র নিয়ে না হয় অন্য একদিন আলোচনা করা যাবে।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান স্থান-সংক্রান্ত তিনটি প্রতিসাম্যের কথা বলে। সেগুলো হলো প্রতিফলন, ঘূর্ণন এবং স্থানান্তরন প্রতিসাম্য। আমাদের জানা মৌলিক কনিকাগুলো ঘূর্ণন এবং স্থানান্তরণ প্রতিসাম্য মেনে চলে, কিন্তু প্রতিফলন প্রতিসাম্য মেনে চলে না। এই প্রতিফলন প্রতিসাম্যকে আমরা সবাই P-Symetry বা parity প্রতিসাম্য বলে চিনি। চারটি মৌলিক বলের ক্রিয়ার মধ্যে শুধুমাত্র দুর্বল-নিউক্লিয় বল ছাড়া বাকি তিনটি বলের ক্রিয়াতে এই প্রতিফলন প্রতিসাম্য ঠিক থাকে। সমস্যা হয় শুধু দুর্বল বলের ক্ষেত্রে।

 

দুর্বল বলের ক্রিয়ার সময় যে প্রতিফলনের প্রতিসাম্য রক্ষা হয়না এটা প্রথম ধারণা করেন অ্যামেরিকার বিজ্ঞানী লি এবং চাইনিজ বিজ্ঞানী চেন নিং। সেটা সেই ১৯৫৬ সালের কথা। তারা তাদের ধারনা পরীক্ষা করার জন্য বেশ কয়েকটি এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেন। প্রায় মাস ছয়েক পর পরীক্ষা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, দুর্বল বল আসলেই প্রতিফলন প্রতিসাম্য মানে না।

কেন এই প্রতিসাম্য ভঙ্গ হচ্ছে তার বেশ কয়েকটা ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু এর মধ্যে একটা একটু অদ্ভুত তত্ত্ব আছে। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী প্রতিটি মৌলিক কনিকার একটা করে মিরর কনিকা আছে। অর্থাৎ সেই কনিকাটা হবে আমাদের পরিচিত কনিকার আয়নার প্রতিফলনের মত। তার ডান দিকটা হবে আমাদের বাম দিক। এইসব কনিকা দিয়ে একটা নতুন মহাবিশ্ব হলে সেটা হবে আমাদের দুনিয়ার উল্টো দুনিয়া। তত্ত্বটা অদ্ভুত হলেও নিঃসন্দেহে মজার। কিন্তু এই তত্ত্ব সঠিক কি’না তা আমরা জানি না।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য নিউ সায়েন্টিস্টে দুটি উপায় প্রস্তাব করেছেন। তার মধ্যে একটির কথা এখানে বলছি। এই পরীক্ষাতে নিউট্রন ব্যবহার করা হবে। নিউট্রন পরমাণুর মধ্যে থাকলে বেশ ভালই থাকে। কিন্তু নিউটনকে যদি পরমাণু থেকে বের করে একলা ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন এটা আর স্ট্যাবল থাকে না। নিউট্রন তখন ভেঙ্গে গিয়ে একটা প্রোটন, একটা ইলেকট্রন আর একটা ইলেকট্রন এ্যান্ট্রি নিউট্রিনোতে পরিণত হয়। এই ঘটনাকে বিটা ডিকে বা বিটা ক্ষয় বলা হয়। এই ডিকে কিভাবে পরিমাণ করা হবে তার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা নিউট্রনের দুই রকম হাফ লাইফ পান। একভাবে পাওয়া যায় ১৪ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড, অন্যভাবে পাওয়া যায় ১৪ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড। দুইটি পদ্ধতি ব্যাবহারের কারণে দুই ধরনের ফলাফল আসছে। একটি পদ্ধতিতে নিউট্রন কাউন্ট করা হয়, অন্য পদ্ধতিতে নিউট্রনের পরিবর্তে নিউট্রন ভেঙ্গে যে প্রোটন তৈরি হয় সেটা কাউন্ড করা হয়। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই একই ফলাফল আসার কথা। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে- এই নয় সেকেন্ড ব্যবধানের কারন মূলত মিরর নিউট্রন। যদি নিউট্রন ইমিশন আর ডিটেকটিরে গিয়ে ডিটেকশনের মধ্যে সাধারণ নিউট্রন মিরর নিউট্রনে পরিবর্তিত হয়, তবে প্রোটন কাউন্টে গরবর হতে পারে। যেহেতু এক পদ্ধতিতে নিউট্রন কাউন্ড করা হয় আর অন্যটাতে প্রোটন কাউন্ট করা হয়, তাই ফলাফলও গরবর হবে। এই গরবরের কারনেই ফলাফলে ৯ সেকেন্ড কমবেশি হচ্ছে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের উপস্থিতিতে এই মিরর ভার্সনে রুপান্তরে সম্ভাবনা একটু বেশি। আর পরীক্ষাটাতে দুর্বল টাইপের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করা হয়। এখন এই বিষয়টাই ঘটে কিনা তা জানার জন্য বিজ্ঞানীরা একটি এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছেন। দেখা যাক আসলেই নিউট্রন মিরর ভার্সনে পরিবর্তীত হয় কি’না। অবশ্য আমাদের তাতে কিছু যায় আসে না। নিউট্রন যদি মিরর ভার্সনে রূপান্তরিত হয় তবুও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বর্বরই থাকবে, আর ফেসবুক বুদ্ধিজীবীরা নেকু আর আত্মসম্মানহীনই থাকবে। কিন্তু বেচে থাকতে হলে কিছু একটা করতে হয়, তাই আমি লিখলাম, আপনি পড়লেন। দ্যাটস ইট!!

 
 
নিউজডেস্ক

About নিউজডেস্ক

আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাতকার প্রকাশ করি। আপনারা কোন লেখা প্রকাশিত করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: editor@biggani.org, biggani.org@gmail.com।

Check Also

তেজস্ক্রিয়তা ও কুরি দম্পতির কারিকুরি

আবুল বাসার আধুনিক জার্মানি আর চেক রিপাবলিকের সীমান্ত এলাকা। ১৬ শতকের শুরুতে এই অঞ্চলকে দুই …

ফেসবুক কমেন্ট


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।