“সায়েন্টিস্ট” শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে পরীক্ষাগারে সাদা এপ্রোন পরা একজন মানুষ, যিনি নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু ডেটা সায়েন্টিস্ট একেবারেই ভিন্ন জগতের চরিত্র। তাঁদের পরীক্ষাগার হলো ল্যাপটপ, তাঁদের যন্ত্র হলো অ্যালগরিদম, আর তাঁদের গবেষণার বিষয় হলো অসংখ্য ডেটা। তবুও এঁদের বিজ্ঞানী বলা যথার্থ। কারণ তাঁরা সংখ্যার ভেতর লুকিয়ে থাকা সত্যকে খুঁজে বের করেন, যেমন একসময় বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির গোপন রহস্য উন্মোচন করতেন।
আজকের পৃথিবীতে এই পেশাটি কেন এত আলোচিত? এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে ডেটার দুনিয়ায়। ইন্টারন্যাশনাল ডেটা কর্পোরেশনের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট ডেটার পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭৫ জেটাবাইটে। এ সংখ্যাটা এত বড় যে সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে। প্রতিদিনই আমরা যখন ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছি, ইউটিউবে ভিডিও দেখছি, কিংবা মোবাইল দিয়ে টাকা দিচ্ছি, তখনই তৈরি হচ্ছে নতুন ডেটা। এই অসীম ডেটার স্রোতকে সঠিকভাবে ব্যবহার করলেই কেবল আধুনিক অর্থনীতি এগোতে পারে। আর সেখানেই ডেটা সায়েন্টিস্টরা হয়ে উঠেছেন অপরিহার্য।
কেন এত জনপ্রিয় এই পেশা?
ডেটা সায়েন্টিস্ট পেশার জনপ্রিয়তা হঠাৎ তৈরি হয়নি। এর পেছনে আছে তিনটি বড় কারণ। প্রথমত, বিগ ডেটার উত্থান। প্রতিদিন প্রায় ২.৫ কুইন্টিলিয়ন বাইট ডেটা উৎপন্ন হচ্ছে। কল্পনা করুন, এর ভেতর কত তথ্য লুকিয়ে আছে। এই তথ্যকে কাজে লাগাতে হলে চাই দক্ষ মানুষের হাত।
দ্বিতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের বিস্তার। মেশিন লার্নিংয়ের বাজার ২০২৭ সালের মধ্যে প্রায় ৯৬.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখানে ডেটা সায়েন্টিস্টরাই মূল কারিগর, যারা অ্যালগরিদম প্রশিক্ষণ দিয়ে ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস তৈরি করেন।
তৃতীয়ত, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা। ফোর্বসের এক সমীক্ষা বলছে, ডেটা-চালিত প্রতিষ্ঠানগুলো ২৩ গুণ বেশি গ্রাহক অর্জনে সক্ষম। অর্থাৎ, যে ব্যবসা ডেটা ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেয়, তার সাফল্যের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আজ ডেটা সায়েন্টিস্ট চাইছে।
বাস্তব জীবনে অবদান
তবে এই পেশার গুরুত্ব শুধু তাত্ত্বিক নয়, বরং আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান।
- স্বাস্থ্যসেবা: ডেটা বিশ্লেষণ করে রোগের আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, এমনকি ব্যক্তিগত চিকিৎসার পরিকল্পনাও তৈরি হচ্ছে। করোনা মহামারির সময় আমরা দেখেছি কীভাবে ডেটা বিশ্লেষণ রোগের বিস্তার অনুমান করতে সাহায্য করেছে।
- বাণিজ্য ও ই-কমার্স: Amazon বা Daraz আমাদের পছন্দ অনুযায়ী নতুন পণ্য সাজেস্ট করছে। এর পেছনেও কাজ করছে ডেটা সায়েন্টিস্টদের মডেল।
- ব্যাংকিং খাত: প্রতারণা শনাক্তকরণ থেকে শুরু করে ক্রেডিট স্কোরিং—সব ক্ষেত্রেই ডেটা বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ।
- শিক্ষা: শিক্ষার্থীর ফলাফল দেখে কে কোথায় দুর্বল তা নির্ণয় করে ব্যক্তিগত শিক্ষণ পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে।
অর্থাৎ, চিকিৎসা থেকে ব্যবসা, শিক্ষা থেকে বিনোদন—সব জায়গায় ডেটা সায়েন্টিস্টদের হাতছানি স্পষ্ট।
বাংলাদেশে সম্ভাবনা
বাংলাদেশও এই প্রবাহ থেকে আলাদা নয়। মোবাইল অপারেটর, ব্যাংক, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এমনকি সরকারি সংস্থাগুলোও এখন ডেটা-চালিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ শুরু করেছে। তবে এখনো পর্যাপ্ত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হয়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডেটা সায়েন্স ও মেশিন লার্নিংয়ের কোর্স চালু হচ্ছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানে প্রতিযোগিতা করতে হলে আরও বিনিয়োগ, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের দরকার আছে।
একই সঙ্গে, বাংলাদেশে ডেটা সায়েন্টিস্টদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কারণ এখানে রয়েছে প্রচুর ব্যবহারকারী তথ্য—মোবাইল ফোন ব্যবহার, মোবাইল ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যখাতের তথ্য, এমনকি কৃষিক্ষেত্রের ডেটা। সঠিকভাবে এগুলো বিশ্লেষণ করা গেলে নীতি-নির্ধারণ থেকে শুরু করে ব্যবসা উন্নয়ন পর্যন্ত অসংখ্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্ভব।
কী কী দক্ষতা দরকার?
ডেটা সায়েন্টিস্ট হতে চাইলে কেবলমাত্র কম্পিউটার চালাতে জানলেই হবে না। এখানে দরকার বহুমুখী দক্ষতা।
- গণিত ও পরিসংখ্যানের উপর দৃঢ় ভিত্তি।
- প্রোগ্রামিং ভাষা—বিশেষত Python, R, SQL-এর দক্ষতা।
- মেশিন লার্নিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণা।
- ব্যবসায়িক বোধ, যাতে ডেটার ফলাফল বাস্তব প্রয়োগে কাজে লাগে।
- এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—জটিল বিশ্লেষণকে সহজভাবে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করার ক্ষমতা।
একজন ডেটা সায়েন্টিস্ট তাই একাধারে গবেষক, প্রকৌশলী, বিশ্লেষক ও গল্পকার।
চ্যালেঞ্জও আছে
অবশ্যই এই পেশা ফুলেল পথে হাঁটার মতো সহজ নয়। প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো ডেটার গুণমান। সব তথ্য সমান নির্ভরযোগ্য নয়; অসম্পূর্ণ বা বিভ্রান্তিকর ডেটা বিশ্লেষণকে কঠিন করে তোলে। দ্বিতীয়ত, গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা। ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের সময় নৈতিকতা বজায় রাখা এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই বড় দায়িত্ব। আর তৃতীয়ত, দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি। নতুন নতুন টুলস ও অ্যালগরিদম শিখতে না পারলে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
ডেটা সায়েন্টিস্টদের জন্য আগামী পৃথিবী এক সুবর্ণ সম্ভাবনা। ইন্টারনেট অব থিংস (IoT), স্মার্ট সিটি, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা—সব ক্ষেত্রেই ডেটা বিশ্লেষণ হবে কেন্দ্রীয় শক্তি। ইতিমধ্যেই বিশ্বের অনেক নামকরা গবেষক একে “২১শ শতকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পেশা” বলে অভিহিত করেছেন।
শেষকথা
একসময় ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়া তরুণদের স্বপ্ন ছিল। আজকের তরুণদের কাছে নতুন স্বপ্নের নাম—ডেটা সায়েন্টিস্ট। এই পেশা শুধু ভালো আয়ই নিশ্চিত করছে না, বরং সমাজ ও মানবতার জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করা, ব্যবসায় সাফল্য আনা কিংবা শিক্ষা ও গবেষণায় নতুন পথ খুঁজে বের করা—সব ক্ষেত্রেই ডেটা সায়েন্টিস্টরা আধুনিক কালের পথপ্রদর্শক।
অতএব, যারা আজ ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছেন, তাঁদের জন্য ডেটা সায়েন্স শুধু একটি পেশা নয়; এটি হতে পারে ভবিষ্যতের সেরা বিনিয়োগ। সংখ্যার ভেতর লুকানো গল্পগুলোই আগামী দিনের ইতিহাস রচনা করবে, আর সেই ইতিহাস লিখবেন ডেটা সায়েন্টিস্টরা।
Leave a comment