স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ব্রেইন ফ্রীজ

Share
ব্রেইন ফ্রীজ
Share

তপ্ত গ্রীষ্মকালে কিছু অনুভূতি সত্যিই আরামপ্রদ – যেমন ঠান্ডা আইসক্রীম-এর স্বাদ। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবে যে, খুব ঠান্ডা বরফ বা আইসক্রীম খুব তাড়াতাড়ি মুখে নিলে মাথা ঝন্ঝন্ করে ওঠে। স্নায়ুবিজ্ঞানে আলোচিত এই ঘটনাই সাধারণ মানুষের কাছে  “ব্রেইন ফ্রীজ” নামে পরিচিত।

মা-বাবা বা বড়রা আমাদের সব সময়ই  ধীরে-সুস্থে ভালোভাবে চিবিয়ে খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন  – কারণ তা আমাদের খাওয়া খাবার হজমে সহায়ক হয়। খুব ঠান্ডা খাবার দ্রুত খেতে গেলে মাথা ঝন্ঝন্ করে ওঠা হলো সেরকমই এক নিষেধাজ্ঞা যা সরাসরি আসে আমাদের মস্তিষ্কের কাছ থেকে, তবে এই বারণের সাথে হজমের কোন সম্পর্ক নেই। আসলে আমাদের মস্তিষ্ক যে কোন বিষয়ের খুব দ্রুত পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। খুব ঠান্ডা বরফ বা আইসক্রীম তাড়াতাড়ি মুখে নিলে, মুখগহ্বরের উষ্ণতা দ্রুত হারে কমে – যার ফলে আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়াও অস্বাভাবিক হয়। মুখে দ্রুত আইসক্রীম নিলে মস্তিষ্কের এই অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া কিভাবে ঘটে তার বৈজ্ঞানিক ধাপগুলো বুঝতে গেলে আমাদের মানুষের রক্ত-সংবহন তন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কে কিছু বিষয় জেনে রাখতে হবে।

প্রথমে রক্ত-সংবহন তন্ত্রের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জেনে নিই। আমাদের ঘাড়ের বামদিকে একটি বাম ক্যারোটিড্ ধমনী ও ডানদিকে একটি ডান ক্যারোটিড্ ধমনী থাকে। ভেবে দেখো যে ভ্যাম্পায়ার বা জম্বি সংক্রান্ত আতঙ্কের চলচ্চিত্রে দেখানো হয় যে তারা মানুষের ঘাড় কামড়ে রক্ত শোষণ করে। এর পেছনেও একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে  ও তা হলো যে ঘাড় কামড়ে সহজেই অনেক বেশী পরিমাণে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত শোষণ করে নেওয়া যায় যা সম্ভব হয় বাম ও ডান ক্যারোটিড্ ধমনীর উপস্থিতির জন্যই। আমরা জানি যে ধমনীর মাধ্যমে হৃৎপিন্ড থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ রক্ত সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বাম ও ডান ক্যারোটিড্ ধমনীর প্রতিটিই দুটি করে শাখা ধমনীতে বিভক্ত হয় – ইন্টারনাল বা আভ্যন্তরীণ ক্যারোটিড ধমনী ও এক্সটারনাল বা বাহ্যিক ক্যারোটিড ধমনী। আভ্যন্তরীণ ক্যারোটিড ধমনী মস্তিষ্কে বিশুদ্ধ রক্ত পৌঁছে দেয় এবং বাহ্যিক ক্যারোটিড ধমনীর মাধ্যমে মুখমন্ডল ও ঘাড়ে বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ হয়। আভ্যন্তরীণ ক্যারোটিড ধমনী কিছু শাখা-ধমনীতে বিভক্ত হয়ে সমগ্র মস্তিষ্কে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ রক্ত ছড়িয়ে দেয়। এদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ  শাখা-ধমনী হলো আন্টেরিয়া সেরিব্রাল ধমনী যা মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব ও সুপিরিয়র প্যারাইটাল লোবের একদম মধ্যভাগে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত নিয়ে যায়।

 

সময় এসেছে  মানুষের স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি দরকারি বিষয় জেনে ফেলার। শুরুটা মস্তিষ্কের ঐ দুটি অংশ – “ফ্রন্টাল লোব” ও “সুপিরিয়র প্যারাইটাল লোব” দিয়েই করা যাক্। ফ্রন্টাল লোব হলো মস্তিষ্কের অগ্রভাগে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা মানুষের আবেগপ্রবণ অভিব্যক্তি, সমস্যার সমাধান, স্মৃতি, ভাষা, বিচার ও বিবেচনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। আর সুপিরিয়র প্যারাইটাল লোব অংশটি প্রধানত আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে চারপাশের পরিবেশ এবং সেই পরিবেশ সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের অবস্থান ও গতির ধারণা রাখতে সাহায্য করে।

মস্তিষ্ক সহ মানুষের সমগ্র স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হয় বহু স্নায়ুকোষ বা নিউরোন নিয়ে। স্নায়ুকোষ এর একটি সরু সুতোর মত অংশ থাকে যাকে “অ্যাক্সন” বলে ও স্নায়ুকোষের গোলকাকার অংশটি যেখানে নিউক্লিয়াস থাকে তা “কোষ-দেহ” বা “সেল বডি” বা “সোমা” নামে পরিচিত। অনেক ক্ষেত্রে বেশ কিছু স্নায়ুকোষ দল বেঁধে থাকেলে তাদের কোষ-দেহগুলি জটলা করে এক একটি বিশেষ অংশ তৈরি করে যাকে “গ্যাংলিয়ন” বলে। খুব সুস্বাদু খাবার দেখে বা গন্ধ শুঁকে জিভে জল চলে এসেছে এমন ঘটনা বোধ করি তোমাদের সাথে বহুবার ঘটেছে। এর জন্য দায়ী এক বিশেষ ধরনের গ্যাংলিয়ন যাদের “প্যারাসিম্প্যাথেটিক গ্যাংলিয়ন” বলে। “স্ফেনোপ্যালেটাইন” হলো এমনই একটি  প্যারাসিম্প্যাথেটিক গ্যাংলিয়ন যে পূর্বোক্ত বাহ্যিক ক্যারোটিড ধমনীর মধ্যে রক্ত প্রবাহের হারকে বাড়িয়ে বা কমিয়ে মুখমন্ডল (অর্থাৎ নাসাগহ্বরের আভ্যন্তরীণ প্রাচীর, মুখগহ্বরের ছাদ, নাসাগহ্বরকে ঘিরে থাকা চার জোড়া সাইনাস ইত্যাদি) ও ঘাড়ের তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।

 

 

খুব ঠান্ডা আইসক্রীম তাড়াহুড়োয় খেলে, মস্তিষ্ক কিভাবে আমাদের থামাতে তৎপর হয় তার ব্যাখ্যা এখন আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে। আইসক্রীম বা কুল্ফির মত ঠান্ডা খাদ্য রয়ে সয়ে না খেলে, স্ফেনোপ্যালেটাইন গ্যাংলিয়ন মুখগহ্বরের ছাদের তাপমাত্রা দ্রুত কমানোর জন্য সেখানে রক্ত-প্রবাহের হার খুব দ্রুত কমিয়ে দেয়। ফলে বাহ্যিক ক্যারোটিড ধমনীর মধ্যে রক্ত-প্রবাহের হার খুব দ্রুত কমে। হৃৎপিন্ড থেকে বাম বা ডান ক্যারোটিড ধমনীর মধ্য দিয়ে বয়ে আসা রক্ত-প্রবাহই বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ ক্যারোটিড ধমনীতে বিভক্ত হয় – তাই বাম বা ডান ক্যারোটিড ধমনীর মধ্যে রক্ত প্রবাহের হার একই রেখে যখন বাহ্যিক ক্যারোটিড ধমনীর মধ্যে রক্ত-প্রবাহের হার খুব দ্রুত কমে, তখন আভ্যন্তরীণ ক্যারোটিড ধমনীতে বিশেষত তার শাখা আন্টেরিয়া সেরিব্রাল ধমনীর মধ্যে রক্ত প্রবাহ খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে চলে। ফলস্বরূপ, মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব ও সুপিরিয়র প্যারাইটাল লোবের মধ্যভাগে রক্ত-সরবরাহের হার হঠাৎ খুব বেড়ে যায় যা মুহূর্তের জন্য মাথায় তীব্র ব্যথার কারণ।

স্নায়ু-পথের যেকোন ব্যথাকে স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় “নিউরালজিয়া” বলা হয়। আমাদের আলোচিত ব্যথা অর্থাৎ “ব্রেইন ফ্রীজ” এর কারণ হিসাবে স্ফেনোপ্যালেটাইন গ্যাংলিয়ন-র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য এই ব্যথার অপর নাম “স্ফেনোপ্যালেটাইন গ্যাংলিওনিউরালজিয়া”।

একইরকমভাবে খুব গরম হাওয়া ঘাড় বা মুখমন্ডল স্পর্শ করে গেলে বা ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অনেকক্ষণ থাকার পর খুব শীঘ্র বাইরে কাঠ ফাটা রোদ্দুরে বেরিয়ে গেলে মুহূর্তের জন্য মাথা ধরে যায় কারণ স্ফেনোপ্যালেটাইন গ্যাংলিয়ন ঘাড় বা মুখমন্ডলে রক্ত-প্রবাহের হার খুব দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। গরমে মাথা ধরে যাওয়ার বাকি ব্যাখ্যাটা এখন নিজেই করার চেষ্টা কর।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো নতুন নতুন সংবাদ জানতে সাবস্ক্রাইব করুন।

[mc4wp_form id=”3448″]

Share
Written by
Diganta Paul -

জন্ম: ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার "সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি" কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিজ্ঞান নিবন্ধ, কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, কল্পবিজ্ঞান কবিতা, গাণিতিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান নাটক, ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা। প্রসার ভারতীর একজন বিজ্ঞান-কথিকা লেখক ও শিল্পী। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি রৌপ্য পদক। প্রকাশিত বই: উদ্দীপনার খেলাঘর। যোগাযোগ: [email protected]

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আবহাওয়া বদল আর মাইগ্রেন: মাথাব্যথার সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কী?

হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন - যেমন তাপমাত্রার পরিবর্তন, ব্যারোমেট্রিক চাপের হ্রাস, বা দূষণ...

চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

বয়স ধীর বা দ্রুত বাড়ে কেন? রাজনীতি ও বৈষম্যের অদৃশ্য প্রভাব

বিভিন্ন দেশে বার্ধক্যের গতি কীভাবে ভিন্ন হয় এবং রাজনীতি, বৈষম্য এবং সামাজিক...

চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ডিজিটাল সেতুবন্ধন: গ্রাম থেকে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশের যাত্রা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, টেলিমেডিসিন এবং উইকিমেডিক্সের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে গ্রামীণ...

পরিবেশ ও পৃথিবীস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও নীল অর্থনীতি।

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য এবং নীল অর্থনীতি অন্বেষণ করুন — সুন্দরবন এবং সামুদ্রিক সম্পদ...

চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

গাঁজনের জাদু: ফার্মান্টেড খাবারের গুণাগুণ ও গুরত্ব

দই, কিমচি এবং রুটির মতো গাঁজানো খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতা, প্রস্তুতি প্রক্রিয়া এবং...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org