সাক্ষাৎকারঃ ড. শামিয়া হক

সাক্ষাৎকারঃ ড. সামিয়া হক

বিজ্ঞানী.অর্গঃ বিজ্ঞানী.অর্গ এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আমাদেরকে সাক্ষাৎকার দেবার জন্য ধন্যবাদ। প্রথমেই আপনার সম্বন্ধে আমাদের একটু বলুন।  

ড. সামিয়া হকঃ আপনাকে ধন্যবাদ। আমার বাবার কাজের সূত্রে আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে নাইজেরিয়ায়। সেখানেই আমার জন্ম ও। ১৯৮৯ সালে দেশে ফিরে আসার পর আমি রেডিয়েন্ট স্কুল থেকে ও -লেভেল (O-level) এবং পরবর্তীতে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করি। ২০০১ সালে বুয়েট থেকে কেমিকৌশলে স্নাতক লাভের পর আমি কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমি ও পরিবেশ প্রকৌশলে মাস্টার্স সম্পন্ন করি ২০০৪ সালে এবং পরিবেশ প্রকৌশলে পিএইচডি গ্রহন করি ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনা শেষ করে আমি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সীতে (EPA) আমার পোস্টডক্টরাল ট্রেনিং নেই। বর্তমানে আমি দক্ষিন ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরঃ ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছি। আমার গবেষণার বিষয় বায়ু দুষণ, বায়ু মাধ্যমে রোগ সংক্রমণ ও তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি “ইনডোর হেলথি এনভায়রনমেন্ট” (Indoor Healthy Environment)। পানি দূষণ যতটা আলোচনা বা গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে, বায়ু দূষণ ও তার ফলাফল দশ বছর আগেও একটা অবহেলিত বিষয় ছিল।  

বিজ্ঞানী.অর্গঃ আপনার এই  সফলতার পিছনে কারা ভূমিকা রেখেছে?  

ড. সামিয়া হকঃ এখনো সফল হয়েছি কিনা সেটা বলতে পারছিনা তবে যতটুকু এগিয়েছি তার পিছনে আমার বাবা, মা, ভাই বিশেষ করে আমার মা এবং আমার জীবন সঙ্গী বেশ বড় ভূমিকা রেখেছে সেটা উৎসাহ দিয়েই হোক বা স্রেফ পাশে থেকে। আর অনুপ্রেরণার কথা বললে, সেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এটি আমাদের কর্তব্য যাতে তারা বেঁচে থাকার জন্য একটা দূষণমুক্ত পরিবেশ পায় – এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার।

বিজ্ঞানী.অর্গঃ কেন বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করলেন? 

ড. সামিয়া হকঃ এই পেশার প্রতি আগ্রহ অনেক আগে থেকেই ছিল । বাবা মায়ের কাছে শোনা যে স্কুলে থাকতেই “বিজ্ঞান মেলা” (Science Fair) তে অংশগ্রহণ করতাম আর প্রচুর “কেন কেন” প্রশ্ন করতাম । আর শিক্ষকতার সাথে যুক্ত অনেক আগে থেকেই । প্রথমে পড়াতাম আমার ছোট ভাইকে, তারপর প্রাইভেট টিউটোরিং, কোচিং সেন্টার, – এটি একরকম অভ্যাসই ছিল । যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো গবেষণা নিবিড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকলে – শিক্ষকতা এবং গবেষণা এই দুই বিষয়েই কাজ করার সুযোগ থাকে এবং সমমানের অগ্রাধিকার দেয়া হয়।  

বিজ্ঞানী.অর্গঃ একজন বাঙালী মহিলা নারী হিসাবে এতদূর এসেছেন। সত্যিই আমরা আপনাকে নিয়ে গর্বিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণ মেয়েরা আপনার মতন ক্যারিয়ার খুব কমই গ্রহণ করেন। যারা আপনার মতন হতে চান, সেইসব নারীদের জন্য আপনার উপদেশ কি? 

ড. সামিয়া হকঃ উপদেশ দেয়ার মতো কিছু করছি বলে মনে হয় না । আমার আগেই অনেক বাঙালী নারী যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়েছেন এবং কৃতিত্বের সাথে গবেষণার কাজ পরিচালনা করেছেন, আরো অনেকে প্রযুক্তি শিল্পে তা ব্যাবস্থাপনায় হোক কিংবা গবেষণা ও উন্নয়নেই হোক বড় ভূমিকা রেখেছেন। আমি তাদের দেখানো পথেই চলেছি – অধ্যাবসায়, ইচ্ছা শক্তি, নিবেদিত প্রাণ হওয়া এবং সর্বোপরি মেনে নেয়া যে ব্যর্থতা সফলতার সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। একবার ব্যর্থ হয়েছি ভেবে ভেঙে পড়লে চলবে না।

বিজ্ঞানী.অর্গঃ বর্তমানে কি নিয়ে গবেষণার কাজ করছেন? 

ড. সামিয়া হকঃ গত কয়েক বছরে আমার গবেষণাগারে আভ্যন্তরীণ বায়ুর গুণমান (indoor air quality), আবাসনে বা ভবনে জীবাণুর জীবনচক্র (microbe lifecycle), হিউমান-বিল্ডিং ইন্টারঅ্যাকশন (human building interaction) এবং কন্টামিনেন্ট ট্রান্সপোর্ট (contaminant transport) এর উপর কাজ চলছে। আমরা তত্ত্বীয়, ল্যাব স্কেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা, (lab-scale experiments) এবং ভবন কেন্দ্রিক উপাত্ত পর্যালোচনা করে একটা প্রক্রিয়া বের করার চেষ্টা করছি যা আভ্যন্তরীণ বায়ুর গুণমান সম্পর্কে একটা পূর্ণ ধারণা দিতে পারে ।

বিজ্ঞানী.অর্গঃ nanoparticle diesel fuel নিয়ে কি ধরনের কাজ করছেন?

ড. সামিয়া হকঃ এ পর্যায়ে NOx এবং Volatile Organic Compound (VOC) নিঃসরণ নিয়ে কিছু কাজ করছি। কাজটা মুলতঃ গাড়ি থেকে এই ধরণের নিঃসরণ আসে পাশের পরিবেশে কি ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সেইটি বোঝার চেষ্টা। জ্বালানি তেলের গুণগত মানের অর্থাৎ কি ধরণের জ্বালানি তেল ব্যবহার করা যাবে তার উপর যথেষ্ট নিয়ম-নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, কিন্তু সারা বিশ্বে গাড়ির সংখ্যা বাড়াতে নিঃসরণের পরিমাণ ও বেড়েছে। নিঃসরণ ভিত্তিক দূষণ কতটা কমানো যায় সেই সাথে কতোদূর অবধি এর প্রভাব থাকে তার লক্ষে কাজটা করা।

 

বিজ্ঞানী.অর্গঃ computational fluid dynamics প্রযুক্তিটি সমন্ধে আমাদের বিস্তারিত বলুন।

ড. সামিয়া হকঃ এটা একটা তাত্ত্বিক অবকাঠামো বা পদ্ধতি যা খুব সাধারণ ভাবে বললে – আংশিক ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ (partial differential equation) সমাধান করে কম্পিউটারের এর মাধ্যমে। আংশিক ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ (partial differential equation) প্রকৌশলীরা সাধারাণত যেগুলো ব্যবহার করেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার কোনো এনালিটিক্যাল সল্যুশন (analytical solution) থাকেনা, তা সমাধান করতে হয় নুমেরিকাল পদ্ধতি (numerical methods) অবলম্বন করে । Computational Fluid Dynamics যা CFD নামেই বহুল পরিচিত কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে fluid flow pattern, transport simulate করে in a virtual environment । কম্পিউটার প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি এই ধরণের সিমুলেশন (simulation) করা কে কিছুটা হলেও সহজ করে দিয়েছে – High performance computing এই ধরণের simulation কে সহজতর করে দিয়েছে যা আগে ছিল খুবই সময় সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য ।

 

বিজ্ঞানী.অর্গঃ শিক্ষাকতা কেমন লাগছে? কোন জিনিসটি বেশী চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন?  

ড. শামিয়া হকঃ ভালো লাগছে। ক্লাসরুমে অনেক ধরণের ছাত্রছাত্রী আসে তাদের সবাইকে একই ভাবে পরিবেশ প্রকৌশল তথা পরিবেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করা কঠিন। একই সাথে, ছাত্র/ছাত্রী হিসাবে আমি কি জানি বা জানি না বা আমার জানার ব্যাপ্তি কতটুকু হওয়া উচিত সেই বিষয়টিও সফল ভাবে অনুধাবন করাতে অনেক চেষ্টা এবং পরিশ্রম করতে হয়।   

বিজ্ঞানী.অর্গঃ ভবিষ্যতে কি নিয়ে কাজ করতে চান?

ড. সামিয়া হকঃ পরিবেশ এর জন্য আমরা নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করছি ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত দুই ভাবেই। আমার ইচ্ছা পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের পুরোভাগে থাকতে predictive capability এর মাধ্যমে যা আমাদের আগে থেকে তৈরি করবে সেই সমস্যা থেকে দ্রুত উত্তরণের পথ নির্দেশনার জন্য ।

বিজ্ঞানী.অর্গঃ তরুণ শিক্ষার্থি যারা বিজ্ঞানে কাজ করতে চায় তাদের জন্য আপনার কোন উপদেশ বা বক্তব্য কি? 

ড. সামিয়া হকঃ মৌলিক (fundamentals) জ্ঞানের ভিত্তি যাতে শক্ত থাকে সে দিকে নজর দিতে হবে। আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে আজকাল আন্তঃ বিষয়ক (interdisciplinary) গবেষণায় পদার্থ, রসায়ন আর গণিতের কতটা প্রয়োজন এবং প্রয়োগ। তাই এই পদার্থ, রসায়ন আর গণিত এর ভিত্তিকে ঠিক রাখা খুবই জরুরি। সেই সাথে নতুন জিনিস শেখার আর ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ থাকতে হবে। একটি উদাহরণ দেই, পুরঃ ও পরিবেশ প্রকৌশলে কাজ করছি বলে জীববিজ্ঞান জানার প্রয়োজন নেই সেই ধারণা পোষণ করে রাখা ভুল। জৈবিক-রাসায়নিক ভিত্তিক কাজ হলে জীববিজ্ঞান এবং রসায়ন দুটারই প্রয়োজন হবে বৈকী। অনুসন্ধিৎসু মন থাকতে হবে যাতে সঠিক প্রশ্ন গুলো করা যায় । বিজ্ঞানের অনেক নতুন নতুন আবিষ্কার সঠিক প্রশ্নোর কারণেই বেরিয়ে আসে।  

   

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো নতুন নতুন সংবাদ জানতে সাবস্ক্রাইব করুন।

নিউজডেস্ক

About নিউজডেস্ক

আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাতকার প্রকাশ করি। আপনারা কোন লেখা প্রকাশিত করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: editor@biggani.org, biggani.org@gmail.com।

Check Also

সাক্ষাৎকার:  হেলথ ইনফরমেটিকস বিশেষজ্ঞ মো. আমিনুল ইসলাম

বিজ্ঞানী ডট অর্গ এর সাক্ষাতকার সিরিজে আমরা কথা বলেছিলাম হেলথ ইনফরমেটিকস বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ মো. …

ফেসবুক কমেন্ট


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।