আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
নামটা শুনলেই কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে। মনে হয়, সারা দিনের কাঠফাটা গরমের পর সন্ধ্যার দিকে নদীর কিনার থেকে আচমকা একটা ফুরফুরে বাতাস এসে গায়ে লাগল! আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বহুতর পরিচিতি তাঁর। তিনি বিটিভির জনপ্রিয় উপস্থাপক।
সফল শিক্ষাবিদ, সংগঠক ও সমাজ-সংস্কারক। দেশব্যাপী বইপড়া কর্মসূচির সফল
প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্ণধার। অসামান্য কিছু বইয়ের জনক এবং
জনপ্রিয় লেখক। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁর আবৃত্তি ও নৃত্য পরিচালনারও
খ্যাতি রয়েছে। পুরো জাতির কাছে তো এভাবেই পরিচিত তিনি। তবে আমাদের কাছে তাঁর একটিই পরিচয়।
তিনি আমাদের সায়ীদ স্যার। আমাদের শিক্ষক।
যিনি আমাদের বুকে কিছু আশ্চর্য তৃষ্ণার আগুন জ্বালিয়েছিলেন। তবে এই আগুন রাবণের চিতার আগুনের মতো নয়; এই আগুন বনের ভেতর ‘দাঙ্কো’র বিচ্ছিন্ন হূৎ পিণ্ডে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা সেই আগুন, যা পথ-হারানো মানুষকে পথ দেখায়। সায়ীদ স্যারের জন্য প্রতিটি দিনই জন্মদিন, প্রতিদিনই তিনি নতুন করে জন্মান, এখনো এই বয়সে! তবে গাণিতিক হিসাবে গতকাল ২৫ জুলাই ছিল তাঁর ৭৪তম জন্মদিন। আর সে সূত্রেই এক মুগ্ধ শিক্ষার্থী হিসেবে এই লেখার অবতারণা, হয়তো গুরুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানানোরই এক শাব্দিক প্রয়াস। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমি আসি ’৯২ সালে, কলেজ কর্মসূচির বইপড়া কর্মসূচিতে অংশ নিতে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ঢাকাসহ দেশজুড়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বই পড়ানো কর্মসূচির সামগ্রিক নাম ছিল ‘জাতীয়ভিত্তিক মানসিক উৎ কর্ষ কার্যক্রম’।
মনে পড়ে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সেই সরু পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঢোকা। সবুজ গাছের ছায়ায় ঢাকা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তখন দারুণ এক ভবন। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি যে সেই সময়ের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ছিল এক দুর্দান্ত স্থাপত্যের নিদর্শন। কলেজ থেকে পালিয়ে আসা এক তরুণ তখন অ্যালিসের মতোই অবাক চোখে দেখছে, এই ঢাকার ব্যস্তসমস্ত বাজার এলাকা বাংলামোটরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক ওয়ান্ডারল্যান্ডকে।
ভবনটাও কেমন অদ্ভুত সুন্দর, তার মানুষগুলোও কেমন অদ্ভুত আর দাবিটাও অদ্ভুত। তাঁরা চান আমাদের বই পড়াতে, বই নিয়ে কথা বলতে। মনে হলো, বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা যে আশ্চর্য সবুজ দ্বীপ, তাঁরা সবাই যেন সেই দ্বীপ থেকেই ভেসে এসেছেন।
সবচেয়ে অদ্ভুত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বড় মানুষটা। বয়সেও অনেক বড়; জ্ঞানে তো বটেই এবং লম্বায়ও বিশাল। আর দেখতেও ভারি সুন্দর। ভরাট গলায় শব্দমুখর কবিতার মতো, তরতরে ঝরনাধারার মতো কথা বলা শুনে প্রথম দিন থেকেই আমরা তাঁর একদম শক্ত ভক্ত বনে গেলাম!
তখনো জানতাম না, অবাক হওয়ার এই তো শুরু। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি বইটি দিয়ে শুরু হলো প্রথম বই আলোচনা। সদ্য কৈশোর পেরোনো একদল তরুণ-তরুণী ঘিরে বসেছি সায়ীদ স্যারকে। পড়ে শোনাচ্ছি আমাদের ভালো লাগা বইয়ের বিভিন্ন অংশ। সায়ীদ স্যার তাঁর জাদুকরি ভঙ্গিতে একের পর এক গল্প শুনিয়ে চলছেন বইয়ের ভেতরকার সেই চরিত্রদের নিয়ে। আজও, এখনো প্রায় ২০ বছর কেটে যাওয়ার পরও স্পষ্ট মনে পড়ে সেই আলাপগুলো। পাঠ্যপুস্তকের কত বই বারবার পড়েও তার ভেতরকার কথাটা হাজার মাথা ঠুকে বুঝতে পারিনি। অথচ এক দিনের সেই এক আলাপেই কবি বইয়ের প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি দৃশ্য নিজের জীবনের এক স্মৃতির মতোই মাথায় গেঁথে গেছে।
এখনো ভুলিনি, সেই সুদূর রেললাইন ধরে মাথায় কাঁসার কলস নিয়ে হেঁটে আসছে ঠাকুরঝি, দূর থেকে যাকে দেখাচ্ছিল একটি উজ্জ্বল বিন্দুর মতো। পালাগানের আসরে স্টেজে উঠে কবি নিতাই হাত নেড়ে গেয়ে উঠছেন সেই চোখে জল আনা গান: ‘আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি সুখের সার সে চোখের জলে রে/ তুমি হাসো, আমি কাঁদি, বাঁশি বাজুক কদমতলে রে…’।
একের পর এক বই। আশ্চর্য তাদের উপাখ্যান। অদ্ভুত তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো। আমি, আমার বন্ধুরা যেন প্রতিদিন জন্মাতে শুরু করলাম। সে সময় বন্ধুদের মনে হতো সহোদর ভাইয়ের চেয়েও বেশি। এই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বসে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমাদের কর্মসূচির বই পড়েছি; অর্থহীন তর্কবিতর্ক আলোচনায় গলা ফাটিয়ে ফ্যাঁসফেঁসে গলা নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছি। তার পরও মনে হয়েছে, কত কথা না-বলা রয়ে গেল! আর এসব কিছুর মধ্যেই সায়ীদ স্যার হাল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কপালে ভাঁজ-পড়া এক প্রবীণ মাঝির মতো। বরাবরের মতোই সায়ীদ স্যারের ৭৪তম জন্মদিনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কলেজ কর্মসূচির সব ছেলেমেয়ে আবার উপস্থিত হয়েছিলাম তাঁর সামনে।
সেই ’৮৫ সাল থেকে কলেজ বইপড়া কর্মসূচি শুরু হয়েছে, এখন ২০১২ সাল। বইয়ের সূত্রে আমরা সব নানা বয়সী ছোট-বড় এক দঙ্গল ভাইবোন। এঁদের অনেকেই বিখ্যাত, ব্যস্ত এবং প্রতিষ্ঠিত মানুষ। তার পরও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নতুন ভবনে সায়ীদ স্যারকে সঙ্গে নিয়ে প্রতি মাসের শেষ শুক্রবারে আবারও বইপড়া ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের নেশায় মেতে উঠেছি সবাই, সেই পুরোনো দিনের মতো করেই। এই মহাকাল আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিলেও বই পড়াটা কেড়ে নিতে পারেনি।
সায়ীদ স্যারের ৭৪তম জন্মদিনে গুণী এই মানুষের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু লিখবেন। ছাত্র হিসেবে আমি লিখে গেলাম শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা। যিনি আমাদের হূদয়মন্দিরে পাকা ঘর বানিয়ে সেখানে ২৪ ঘণ্টা আলো জ্বেলে রাখার বন্দোবস্ত করেছেন। যে আলো তেলে জ্বলে না, যে আলো জ্বলে স্বপ্ন দেখা মানুষের টগবগে রক্তে।
মৃদুল আহমেদ
Source: প্রথম আলো: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-07-26/news/173045
The mediocre teacher tells.
The good teacher explains.
The superior teacher demonstrates.
The great teacher inspires.
~ William Arthur Ward ~
The mediocre teacher tells.
The good teacher explains.
The superior teacher demonstrates.
The great teacher inspires.
abdullah abu sayed amar dekha onnotomo biroktikor character. I do not like him.