গবেষকদের জন্যে বই

শূন্য থেকে অনন্ত: সংখ্যার ইতিহাস ও মানব সভ্যতার অঙ্কগাণিতিক অভিযাত্রা

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ |

মানবসভ্যতার সূচনা লগ্নে, যখন মানুষ ছিল শিকারি ও সংগ্রাহক, তখন তাদের প্রয়োজন ছিল প্রকৃতির নিয়ম বোঝার, সময়ের হিসাব রাখার এবং খাদ্য কিংবা গৃহপালিত পশুর সংখ্যা নির্ধারণের। এই প্রয়োজন থেকেই জন্ম নিয়েছিল সংখ্যার ধারণা। আর এই সংখ্যার পথচলা আজ শূন্য থেকে অনন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত—শুধু গণনার একটি উপকরণ নয়, বরং চিন্তার এক পরিপূর্ণ জগৎ। কনস্টান্স রিড-এর লেখা Zero to Infinity: A History of Numbers বইটি আমাদের সেই জগতে নিয়ে যায়, যেখানে সংখ্যাগুলি শুধু গাণিতিক প্রতীক নয়, বরং এক একটি ইতিহাস, এক একটি সাংস্কৃতিক অন্বেষণ।

সংখ্যা কেবল গণনার বিষয় নয়—এটি মানবমনের গভীরতম বোধের প্রকাশ। রিড তাঁর লেখায় খুব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেন কিভাবে আমরা সংখ্যা সৃষ্টি করেছি, কিভাবে তা রূপান্তরিত হয়েছে দর্শনের, বিজ্ঞানের এবং এমনকি ধর্মীয় অনুষঙ্গের অংশে। আজ যে ‘শূন্য’ সংখ্যাটিকে আমরা এত সহজে ব্যবহার করি, তা কিন্তু এক সময় ছিল বিপ্লবাত্মক একটি আবিষ্কার। ভারতে শূন্যের ধারণা জন্ম নেয়, যা পরবর্তীতে আরব গণিতবিদদের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছে। এই একটিমাত্র সংখ্যা বদলে দেয় আমাদের গণনার পদ্ধতি, অঙ্কের যুক্তি, এমনকি ভাবনার গভীরতা।

প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে সংখ্যা ছিল চিত্রের সমাহার। তারা গাণিতিক হিসাব রাখতেন কৃষি কর সংগ্রহ কিংবা নীল নদের বন্যার হিসাব রাখার জন্য। অন্যদিকে, ব্যাবিলনীয়রা ষাট ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, যার প্রতিফলন আমরা আজও দেখি সময় গণনায়—এক ঘণ্টা ৬০ মিনিট, এক মিনিট ৬০ সেকেন্ড। এই ধারাবাহিকতা আমাদের দেখায় যে, সংখ্যা শুধুমাত্র গাণিতিক একক নয়, বরং এক একটি সভ্যতার জীবনচর্যার প্রতিফলন।

রিড তাঁর বইয়ে একাধিক সভ্যতার কাহিনি বুনে চলেছেন নিপুণভাবে। গ্রীকদের মধ্যে গণিত ছিল যুক্তির সর্বোচ্চ রূপ। পিথাগোরাস বলতেন, “সংখ্যাই হলো জগতের সুর।” ইউক্লিডের জ্যামিতি এবং আর্কিমিডিসের বিশ্লেষণ আজও আমাদের গণিতের ভিত্তি গড়ে দেয়। কিন্তু এসব চরিত্র শুধুমাত্র সংখ্যার উদ্ভাবক ছিলেন না, ছিলেন এক একটি কাহিনির নায়ক, যারা সংখ্যাকে রূপ দিয়েছেন বিশ্ব বোঝার এক যন্ত্রে।

কিন্তু কেবল ইতিহাস নয়, এই বই আমাদের নিয়ে যায় গণিতের রূপান্তরকামী অভিযাত্রায়। সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবজেক্টিভ র‍্যাশনালিটি, যেমন গাণিতিক যুক্তি, প্রমাণ, এবং সমীকরণ। পাই (π), ইম্যাজিনারি সংখ্যা (i), অথবা ইনফিনিটি (∞)—এগুলো যেন কল্পনার জগৎ থেকে উঠে এসেছে বাস্তব জগতে। কিভাবে একটি সংখ্যা অসীম হতে পারে, অথবা কিভাবে ঋণাত্মক সংখ্যার বর্গমূল বাস্তব নয় কিন্তু গণনায় অত্যাবশ্যক—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাঠক এক অনন্য বৌদ্ধিক ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণিত এখনো অনেকের কাছে ভয়ানক একটি বিষয়—শুধু পরীক্ষার নম্বর পাওয়ার জন্য মুখস্থ করার একঘেয়ে পাঠ। অথচ এই বইটি প্রমাণ করে দেয়, গণিতের মধ্যে রয়েছে কবিতা, রহস্য, সৌন্দর্য এবং মানবিকতা। রিড যখন সংখ্যার ইতিহাস বলেন, তিনি কেবল গণিতের ক্লাসের পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেন না; বরং সেই পথরেখা আঁকেন, যেটা ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভাবতে শিখেছিলেন, যুক্তি করতে শিখেছিলেন এবং পরিশেষে সভ্যতা গড়েছিলেন।

এই বইয়ের আরেকটি অনন্য দিক হলো এর প্রবেশযোগ্যতা। গণিত বিষয়ে লেখা অনেক বইই থাকে কঠিন পরিভাষায় ভর্তি, যা সাধারণ পাঠকের জন্য দুর্বোধ্য। কিন্তু Zero to Infinity ব্যতিক্রম। রিড এমনভাবে লেখেন যেন তিনি এক চায়ের আড্ডায় বসে পাঠককে বোঝাচ্ছেন সংখ্যার রহস্য, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা গণিতের রোমাঞ্চ। বিশেষ করে তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য এটি হতে পারে একটি অনুপ্রেরণাদায়ী পাঠ—গণিত শেখা মানে শুধুমাত্র সূত্র মুখস্থ নয়, বরং চিন্তার দরজা খুলে দেওয়া।

রিড সংখ্যাকে টানেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গেও। মধ্যযুগীয় ইউরোপে যখন গির্জা কর্তৃপক্ষ সংখ্যা নিয়ে ভীত ছিল—বিশেষ করে শূন্যের ধারণা, তখন মুসলিম গণিতবিদরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন অঙ্কশাস্ত্রের চর্চা। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রহ্মগুপ্ত কিংবা আর্যভট্টের মতো গাণিতিক দার্শনিকেরা যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তা পরবর্তীতে ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের ভিত্তি স্থাপন করে। এই সাংস্কৃতিক সংযোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বিজ্ঞান ও গণিত কখনোই কোনো এক জাতির সম্পত্তি নয়—এটি মানবজাতির যৌথ সম্পদ।

এই বইয়ের একটি চমৎকার দিক হলো, এটি সংখ্যার ভবিষ্যতের দিকটিও বিবেচনা করে। আমরা আজ যে ডিজিটাল যুগে বাস করছি—যেখানে প্রতিটি প্রযুক্তি, যোগাযোগ, এমনকি সামাজিক সম্পর্ক পর্যন্ত সংখ্যায় প্রকাশযোগ্য—তার শিকড় খুঁজে পাই সেই প্রাচীন সংখ্যার আবিষ্কারে। রিড বুঝিয়ে দেন, সংখ্যা কেবল অতীত নয়, এটি ভবিষ্যতের ভাষাও। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং—সবকিছুর মূলে রয়েছে গাণিতিক কাঠামো।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যদি আমরা গণিতকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করতে পারি, তবে হয়তো আগামী প্রজন্ম সংখ্যার মধ্যে ভয় নয়, সৌন্দর্য খুঁজে পাবে। আমরা যারা গণিত নিয়ে কাজ করি, কিংবা বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলি, তাদের দায়িত্ব এই বিষয়টিকে মানুষের চিন্তা ও কল্পনার জগতের সঙ্গে যুক্ত করে তোলা। কনস্টান্স রিড আমাদের সেই পথেই আহ্বান জানান—সংখ্যাকে ভালোবাসার, বুঝে নেয়ার, আর প্রশ্ন করার।

শেষমেশ, Zero to Infinity একটি বই নয়, একটি যাত্রাপথ—যেটি আমাদের নিয়ে যায় চিন্তার উৎসে, সভ্যতার শুরুর মুহূর্তে, আর ভবিষ্যতের অজানা সীমানার দিকে। সংখ্যার গল্প শুনতে, বুঝতে এবং ভালোবাসতে চাইলে, এই বইটি হতে পারে আপনার পরবর্তী প্রিয় সহচর। শূন্য থেকে শুরু করে অনন্ত পর্যন্ত সংখ্যার এই ইতিহাস আমাদের শোনায় মানুষ হবার গল্প—যুক্তির, সৌন্দর্যের আর কল্পনার এক অপার আয়োজন।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org