পৃথিবীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম এক দৃশ্য হচ্ছে বৃষ্টি। আকাশ থেকে যখন ছোট ছোট ফোঁটা পড়ে, তখন মনে হয় যেন আকাশ নিজেই তার কান্নার ভাষা প্রকাশ করছে। কিন্তু এই বৃষ্টির ফোঁটা কেন প্রায় সবসময় গোলাকার হয়? অনেকেই হয়তো অবাক হয়ে থাকেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে। এই আর্টিকেলে আমরা জানবো—বৃষ্টির ফোঁটা গোলাকার কেন হয়, এর পেছনে কোন কোন পদার্থবিজ্ঞান কাজ করে, এবং এর প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত।
বৃষ্টির ফোঁটার উৎপত্তি
বৃষ্টির ফোঁটার জন্ম হয় মেঘের মধ্যে। মূলত, বাতাসে ভেসে থাকা জলীয় বাষ্প যখন ঠান্ডা হয়ে ক্ষুদ্র জলকণায় পরিণত হয়, তখন এই কণাগুলো একত্রিত হয়ে বড় হতে থাকে। একসময় তারা এত ভারী হয়ে যায় যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে তারা আর মেঘে ভেসে থাকতে পারে না। তখনই তারা বৃষ্টির ফোঁটা হিসেবে পৃথিবীর দিকে পতিত হয়।
প্রথম ধারণা: ছোট ফোঁটা মানেই পারফেক্ট গোল
অনেকেই মনে করে বৃষ্টির ফোঁটা পানির ড্রপলেটের মতো একেবারে গোল, যেমনটা আমরা কোন পাতায় জমে থাকা শিশির কণায় দেখি। বাস্তবতা হলো, ছোট আকারের বৃষ্টির ফোঁটা সত্যিই প্রায় নিখুঁত গোলাকার হয়। এর কারণ হলো পৃষ্ঠতল উত্তেজনা বা surface tension।
Surface Tension কী?
পৃষ্ঠতল উত্তেজনা হলো পানির অণুগুলোর মধ্যে সংহত আকর্ষণ শক্তি। পানি অণুগুলো পরস্পরের দিকে আকর্ষণ করে একটি গাঢ় রূপ নিতে চায়। ফলে তারা সবচেয়ে স্থিতিশীল আকৃতি নিতে চায়—আর তা হলো গোলাকার। কারণ গোল আকৃতি সব দিক থেকেই সমান এবং এর পৃষ্ঠতল ক্ষেত্রফল সবচেয়ে কম। তাই, বাতাসে ছোট বৃষ্টির ফোঁটা ভাসার সময় তারা surface tension এর কারণে গোল থাকে।
বড় ফোঁটাগুলো কি গোল থাকে?
এখানেই আসে চমকপ্রদ তথ্য। যখন বৃষ্টির ফোঁটার আকার বড় হতে থাকে (প্রায় ১ মিলিমিটার বা তার বেশি), তখন পৃষ্ঠতল উত্তেজনা আর একা ফোঁটাকে ধরে রাখতে পারে না। তখন বাতাসের প্রতিরোধ (air resistance) ফোঁটার নিচের অংশকে চ্যাপ্টা করে ফেলে।
ফলে বড় ফোঁটাগুলো দেখতে অনেকটা প্যারাস্যুট বা হ্যামবার্গার আকৃতির মতো হয়—উপরে গোলাকার, নিচে সমতল। আবার খুব বড় ফোঁটা হলে তা মাঝপথেই ভেঙে ছোট ছোট ফোঁটায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এজন্যই আমরা কখনো বিশাল আকারের একটি বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়তে দেখি না।
বৃষ্টির ফোঁটার আকৃতি নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা
অনেক কার্টুন বা বইয়ে বৃষ্টির ফোঁটাকে নিচে সরু ও উপরে চওড়া (অশ্রু-আকৃতি বা teardrop shape) হিসেবে দেখানো হয়। এই আকৃতি বাস্তবে শুধু তখনই দেখা যায়, যখন কোন ফোঁটা দ্রুত বেগে নিচে পড়ছে এবং বাতাসের চাপ তার আকৃতিকে সাময়িকভাবে বিকৃত করছে। তবে এটি বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, বরং শিল্পীদের সহজ উপস্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হয়।
পৃথিবীর বাইরে কী হবে?
একটি মজার বিষয় হলো, যদি আপনি মহাকাশে (শূন্য মাধ্যাকর্ষণে) পানি ছিটান, তাহলে সেই পানির কণাগুলো প্রায় নিখুঁত গোলাকার হবে। কারণ সেখানে কোনো মাধ্যাকর্ষণ বা বাতাস নেই যা ফোঁটার আকৃতি বিকৃত করতে পারে। তাই একমাত্র পৃষ্ঠতল উত্তেজনাই কাজ করে এবং ফলাফল হয় নিখুঁত গোল পানি বল।
উপসংহার
বৃষ্টির ফোঁটার গোলাকার হওয়ার পেছনে কাজ করে বিজ্ঞান। ছোট ফোঁটাগুলো surface tension এর জন্য গোল থাকে, আর বড় ফোঁটাগুলোতে বাতাসের প্রতিরোধ কাজ করে বলে তারা গোল থাকে না। অর্থাৎ, সব বৃষ্টির ফোঁটা একেবারে পারফেক্ট গোল না হলেও, তাদের আকৃতি নির্ধারণ করে তাদের আকার, গতি, এবং বাতাসের চাপের মতো বিভিন্ন পদার্থবৈজ্ঞানিক প্রভাব।
বিজ্ঞান যেমন আমাদের প্রকৃতির রহস্য ব্যাখ্যা করে, তেমনি প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটাও বহন করে সেই রহস্যের একটি কণা। পরের বার যখন বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়বেন, তখন মনে রাখবেন—আপনার গায়ে যে ফোঁটা পড়ছে, সেটি প্রকৃতির এক অসাধারণ বিজ্ঞানের ফলাফল।
হোসেন মোঃ আরাফাত
রসায়ন বিভাগ,চট্টগ্রাম কলেজ।
Leave a comment