নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ |
আপনি কি কখনো এমন মন্তব্য করেছেন, “মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে, মাথাটা বেশ ভার লাগছে”? যদি আপনি মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগেন, তবে এমন অনুভব একেবারে অচেনা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ৩৯ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মাইগ্রেনে ভোগেন এবং তাদের মধ্যে ৩০% থেকে ৫০% মানুষ মনে করেন যে আবহাওয়ার পরিবর্তন তাদের ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও সম্পূর্ণভাবে বুঝে উঠতে পারেনি কেন এমন হয়।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই কলোরাডোর একজন স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল উইলহাওয়ার একটি গবেষণাভিত্তিক নিবন্ধ সম্প্রতি আমাদের সামনে এনেছে একটি জটিল কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক—আবহাওয়া ও মাইগ্রেনের মধ্যে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনে মাথাব্যথা কেন হয়?
প্রথমেই একটি কথা পরিষ্কার করা দরকার—মাইগ্রেন শুধুমাত্র মাথাব্যথা নয়, এটি একটি স্নায়ুবিক অবস্থা যার প্রভাব পুরো শরীরে পড়তে পারে। আলো বা শব্দের প্রতি অতিসंবেদনশীলতা, বমি বমি ভাব, চোখের সামনে ঝাপসা দেখা—এসবই মাইগ্রেনের উপসর্গ।
ডাঃ উইলহাওয়ার মতে, মাইগ্রেনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্নায়ুতন্ত্র সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল। ফলে পরিবেশে কোনো পরিবর্তন—যেমন তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধি, বায়ুর আর্দ্রতা, বাতাসে ধুলাবালি বা গ্যাসের উপস্থিতি, এমনকি আলো ও শব্দ—এই সবই তাদের স্নায়ুর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি কারণ হলো বায়ুচাপের পরিবর্তন, অর্থাৎ বারোমেট্রিক চাপ। যখন কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস থাকে, তখন পরিবেশের বায়ুচাপ হঠাৎ হ্রাস পায়। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, এই হঠাৎ চাপ পরিবর্তন মাথার অভ্যন্তরীণ চাপকে প্রভাবিত করতে পারে। এর ফলে মাথার ভেতরে থাকা সংবেদনশীল স্নায়ুগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে ব্যথার সূচনা করে।
আবহাওয়াজনিত মাইগ্রেনের সম্ভাব্য কারণসমূহ
১. বায়ুচাপের পরিবর্তন:
ঝড় বা মৌসুমি নিম্নচাপের সময় যখন বায়ুচাপ কমে যায়, তখন মাথার ভেতরে-বাইরের চাপের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। এই চাপের তারতম্য সরাসরি মাথার স্নায়ুতে প্রভাব ফেলে।
২. তাপমাত্রার চরমতা:
খুব গরম বা খুব ঠান্ডা দিন, অথবা হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তন অনেকের মাইগ্রেনের কারণ হতে পারে। উচ্চ আর্দ্রতা বা হঠাৎ আর্দ্রতার পরিবর্তনও সমস্যা বাড়াতে পারে।
৩. বায়ু দূষণ:
ওজোন, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডসহ বিভিন্ন বায়ুদূষক উপাদান স্নায়ুতে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা মাইগ্রেনের অন্যতম কারণ।
৪. উজ্জ্বল সূর্যালোক:
অনেক মাইগ্রেন রোগী আলোতে অতিসংবেদনশীল। সূর্যের তীব্র আলো বা ঝলমলে পরিবেশ তাদের মাথাব্যথা বাড়াতে পারে।
৫. বজ্রপাত ও প্রবল বাতাস:
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বজ্রপাত বা প্রচণ্ড হাওয়ার সময় মাইগ্রেনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যদিও এই সম্পর্ক এখনও গবেষণাধীন, তবে এটি মাইগ্রেন-প্রবণ মস্তিষ্কের অতিসংবেদনশীলতার একটি প্রতিফলন হতে পারে।
আপনি কী করতে পারেন?
আবহাওয়া আপনার নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও মাইগ্রেন কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ আপনি নিতে পারেন:
১. মাইগ্রেন ট্র্যাকিং করুন:
একটি ডায়েরি বা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে মাইগ্রেন কবে, কখন, কী অবস্থায় শুরু হলো—তা লিখে রাখুন। এতে করে আপনি নিজেই আবিষ্কার করতে পারবেন কোন ধরনের আবহাওয়া আপনার জন্য ট্রিগার হিসেবে কাজ করে।
২. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখুন:
নিয়মিত ঘুম, সুষম আহার, পানি পান এবং ব্যায়াম—এসবই মাইগ্রেন প্রতিরোধে সাহায্য করে। বিশেষ করে পানি শূন্যতা, অনিদ্রা বা খাবার বাদ পড়লে আবহাওয়ার প্রভাব আরও তীব্র হয়।
৩. সূর্য বা ধুলোবালুর দিনে ঘরে থাকুন:
উজ্জ্বল রোদে বাইরে না যাওয়া, সানগ্লাস পরা, চোখে ঠান্ডা মাস্ক ব্যবহার করা, এবং আর্দ্র দিনে এয়ার কন্ডিশনড ঘরে থাকা মাইগ্রেন কমাতে সাহায্য করতে পারে।
৪. মেডিটেশন ও মাইন্ডফুলনেস:
মনোসংযোগ, শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ, ও জৈব প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ (বায়োফিডব্যাক) শিখে আপনি আপনার স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত রাখতে পারেন।
৫. পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ওষুধ:
যদি পূর্বাভাসে জানা যায় ঝড় বা বৃষ্টি আসছে, আগে থেকেই প্রেসক্রাইব করা ব্যথানাশক ওষুধ নিতে পারেন। এতে করে মাথাব্যথা শুরু হওয়ার আগেই সেটি রোধ করা সম্ভব।
৬. প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা:
যদি প্রায়ই আবহাওয়া আপনার মাইগ্রেন বাড়িয়ে তোলে, তবে নিয়মিত প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার কথা ভাবতে পারেন—যেমন ওষুধ, নিউরোমডুলেশন যন্ত্র বা সাপ্লিমেন্ট।
শেষ কথা
মাইগ্রেন হলো বহুমাত্রিক একটি সমস্যা—এর পেছনে জেনেটিক কারণ, হরমোন, স্ট্রেস, ঘুমের সমস্যা, খাবার এবং আবহাওয়া—সবই ভূমিকা রাখে। আবহাওয়া হয়তো আপনার একমাত্র ট্রিগার নয়, তবে এটি এমন একটি কারণ যা আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাই একে মোকাবেলার জন্য তথ্য জানা, নিজেকে সচেতন রাখা, ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
মাইগ্রেন-আক্রান্ত জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়, বিশেষ করে যখন আকাশের রং বদলের সঙ্গে আপনার মস্তিষ্কও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তবে বিজ্ঞান এখনো চুপ নয়—গবেষণা চলছে, উত্তর আসছে ধীরে ধীরে। আপনি নিজেও আপনার শরীরের ভাষা বুঝে ও প্রস্তুতি নিয়ে এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারেন।
তথ্যসূত্র:
এই লেখাটি মূলত The Conversation থেকে প্রকাশিত নিবন্ধের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ ড্যানিয়েল উইলহাওয়ার তার অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকপাত করেছেন।
পাঠকদের প্রতি আহ্বান:
আপনার আশেপাশে কেউ যদি নিয়মিত মাইগ্রেন সমস্যায় ভোগেন, এই লেখাটি তার সঙ্গে শেয়ার করুন। তার হয়তো জানা দরকার, আকাশের একটুখানি ঘন মেঘ তার মাথাব্যথার ইঙ্গিত হয়ে উঠতে পারে!
Leave a comment