বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন এমন একটি ভ্যাকসিন তৈরি করতে যা ফ্লু (Flu) বা কোভিডের মত ভাইরাসের নানা রূপের (স্ট্রেইন) বিরুদ্ধেও কার্যকর হবে—একটি মাত্র ইনজেকশনেই বহু বছরের জন্য সুরক্ষা। কিন্তু এতদিনেও এই চেষ্টার সফলতা আসেনি।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগ (HHS) এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (NIH) “Generation Gold Standard” নামে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা মূলত আগের ‘Project NextGen’-এর তুলনায় একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। যেখানে Project NextGen ছিল নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক কোভিড ভ্যাকসিনের উন্নয়নে কেন্দ্রীভূত, সেখানে Generation Gold Standard ব্যবহার করছে একটি ক্লাসিক এবং পরীক্ষিত পদ্ধতি—BPL-inactivated killed whole-virus approach—যার মাধ্যমে একইসঙ্গে ফ্লু ও করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর, স্থায়ী এবং সর্বজনীন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। যার লক্ষ্য একযোগে ফ্লু ও করোনাভাইরাসের জন্য একটি বিশ্বজনীন ভ্যাকসিন তৈরি করা। প্রস্তাবিত বাজেট ৫০০ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে “BPL-inactivated whole-virus” পদ্ধতি—একটি পুরনো কিন্তু সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি, যেখানে পুরো ভাইরাসটি মেরে ফেলা হয় এবং তারপর টিকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কেন দরকার বিশ্বজনীন ভ্যাকসিন?
ফ্লু বা কোভিড ভাইরাস বারবার রূপ পরিবর্তন করে। তাই প্রতি বছর নতুন টিকা তৈরি করতে হয়। কিন্তু যদি এমন কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করা যায় যা ভাইরাসের পরিবর্তনশীল বাইরের অংশ নয় বরং স্থিতিশীল (conserved) ভেতরের অংশের বিরুদ্ধে ইমিউন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—তাহলে সেটি ভবিষ্যতের স্ট্রেইনের বিরুদ্ধেও কার্যকর হবে।
ড. উইলিয়াম শ্যাফনার, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, “এই গবেষণা উদ্যোগ উৎসাহব্যঞ্জক, কারণ এটা আমাদের ভবিষ্যতের ফ্লু ও কোভিড ভ্যাকসিন আরও উন্নত করতে সাহায্য করবে।”
এই প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
এই পদ্ধতিতে পুরো ভাইরাস সংগ্রহ করে তা ধংস করা হয়, যা টিকার জগতে একটি পুরনো এবং বহুবার ব্যবহৃত কৌশল। উদাহরণস্বরূপ, পোলিও এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকায় এই ধরণের ইনঅ্যাকটিভেটেড হোল-ভাইরাস পদ্ধতি সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ভাইরাসটি আর সংক্রামক থাকে না, কিন্তু এর স্থিতিশীল গঠন ইমিউন সিস্টেমকে প্রশিক্ষিত করতে সক্ষম হয়। যাতে ভাইরাসটি আর সংক্রামক না থাকে। এরপর সেটিকে ভেঙে টুকরো করা হয় এবং টিকা তৈরি হয়। এতে ইমিউন সিস্টেম ভাইরাসের বাইরের পাশাপাশি ভেতরের স্থায়ী গঠনগুলোর বিরুদ্ধেও সক্রিয় হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শুধু অদলবদল হওয়া অংশ নয়, বরং সর্বজনীন অংশগুলোতেও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
গবেষণার চ্যালেঞ্জ ও নৈতিক প্রশ্ন
ভ্যাকসিন তৈরি করলেই হবে না—তা নিরাপদ কি না, কার্যকর কি না, এসব পরীক্ষা করাও জরুরি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সবসময়ই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো প্লেসবো বা নকল ভ্যাকসিনের সাথে তুলনা করে পরীক্ষা। কিন্তু যদি বাজারে আগেই কার্যকর টিকা থাকে, তবে প্লেসবো দেওয়া অনৈতিক হতে পারে। তাই গবেষকরা এখন বিকল্প উপায়ে, যেমন বিদ্যমান ভ্যাকসিনের সাথে তুলনা করে নতুন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরিমাপের কথা ভাবছেন।
শুধু কোভিড নয়, সমস্ত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা
এই উদ্যোগ শুধু কোভিড-১৯ নয়, বরং MERS, SARS এবং অন্যান্য মানবশরীরের সাধারণ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ার উদ্দেশ্যে কাজ করবে। এটি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মহামারিও ঠেকাতে সহায়ক হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একাধিক রাস্তায় গবেষণা চলা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে mRNA-ভিত্তিক প্রযুক্তি, ভাইরাল ভেক্টর-ভিত্তিক ভ্যাকসিন, প্রোটিন-সাবইউনিট ভ্যাকসিন এবং T-cell ভিত্তিক টিকা নিয়েও গবেষণা চলছে। প্রতিটি প্রযুক্তির নিজস্ব সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই একাধিক পদ্ধতি নিয়ে একসাথে গবেষণা চালালে ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ সমাধান বের করে আনা সম্ভব হবে। হয়তো সব চেষ্টা সফল হবে না, কিন্তু কোনটি যে সঠিক পথে যাবে তা আগে থেকে বলা যায় না। তাই গবেষণার জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ, যথাযথ অর্থায়ন, ও নৈতিক গবেষণা পরিবেশ তৈরি করাই হবে ভবিষ্যতের বড় সাফল্যের চাবিকাঠি।
Leave a comment