মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং তা কখনো তাড়াহুড়োর মধ্যে, আবার কখনো ধীর চিন্তা করে নেওয়া হয়। ‘থিঙ্কিং, ফাস্ট অ্যান্ড স্লো’ বইয়ে ড্যানিয়েল কাহনেমান তাঁর সুনিপুণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখান, আমাদের মস্তিষ্ক দুটি আলাদা সিস্টেমের মাধ্যমে কাজ করে—একটি দ্রুত, স্বতঃস্ফূর্ত, এবং অন্যটি ধীর, চিন্তাশীল। কাহনেমান এই দুই ধরনের চিন্তাভাবনাকে ‘সিস্টেম ১’ এবং ‘সিস্টেম ২’ নামে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। সিস্টেম ১ হল আমাদের অপ্রত্যাশিত, অচেতন চিন্তা পদ্ধতি, যা আমরা স্বাভাবিকভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করি। অন্যদিকে, সিস্টেম ২ হল গভীর চিন্তা ও বিশ্লেষণের সিস্টেম, যা কিছুটা সময় নেয় এবং সচেতন মনোযোগের প্রয়োজন। এই বইটি আমাদের মস্তিষ্কের এই দুটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির সমন্বয়ের গুরুত্ব এবং তাদের মধ্যে সংঘর্ষের প্রভাবকে বুঝতে সাহায্য করে।
কাহনেমান তার বইতে বিশ্লেষণ করেছেন, কীভাবে সিস্টেম ১ অকারণ ভ্রম এবং পক্ষপাতের মধ্যে দিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করি, তখন আমরা অতিরিক্ত তথ্য বা প্রাসঙ্গিক চিন্তা না করেই মনোযোগী হয়ে উঠি। আমাদের মস্তিষ্ক সহজভাবে সাধারণীকরণ করে, যা মাঝে মাঝে ভুল সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। এই তাড়াহুড়া করা চিন্তা কেবল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নয়, বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে যারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন, অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন, যা তাঁদের গবেষণার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
তবে কাহনেমান জানাচ্ছেন যে, আমাদের মস্তিষ্ক শুধুমাত্র তাড়াহুড়া করে নয়, মাঝে মাঝে ধীরে ভাবনাও উপেক্ষা করে। সিস্টেম ২ ঠিকভাবে কাজ করতে, তাতে বেশি সময় এবং গভীর মনোযোগের প্রয়োজন হয়। এটি আমাদের পক্ষে কঠিন হতে পারে, কারণ এ ধরনের চিন্তা প্রক্রিয়ায় মানুষের শক্তি ও সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকে। তবে সিস্টেম ২-এর মাধ্যমে গভীর বিশ্লেষণ আমাদের সত্যিকার দক্ষতা প্রদান করে। আমাদের গবেষণা এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সিস্টেম ২-এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে ধৈর্য এবং মনোযোগ দিয়ে আরও উন্নত ফলাফল পাওয়া সম্ভব, যা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, আমরা কীভাবে সিস্টেম ১ এবং সিস্টেম ২ এর মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি? কাহনেমান এই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন। তার মতে, সঠিক সময় এবং পরিস্থিতিতে সিস্টেম ১ এবং সিস্টেম ২ উভয়কে একসাথে ব্যবহার করার ক্ষমতা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকরী করে তোলে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, আমরা যখন সহজ এবং রুটিন কাজ করি, তখন সিস্টেম ১ আমাদের জন্য উপকারী হতে পারে। তবে, যখন আমাদের সামনে কোনো জটিল বা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা থাকে, তখন সিস্টেম ২-এর মাধ্যমে গভীর চিন্তা করা উচিত।
এ বইটি কেবল একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রতিদিনের জীবনে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রতিদিন যে ছোট ছোট সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করি, তা সিস্টেম ১ এর মাধ্যমে প্রায়ই সম্পন্ন হয়। কিন্তু বড় সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে, যেমন পেশাগত জীবন, রাজনৈতিক মতামত, বা সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সিস্টেম ২ এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাহনেমান সঠিকভাবে দেখিয়েছেন, কখন সিস্টেম ১ কে বিশ্লেষণাত্মকভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং কখন সিস্টেম ২ এর গভীর মনোযোগ প্রয়োজন।
এই বইটির পাঠকদের কাছে একটি বড় শিক্ষা হলো, আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আরো সচেতন হতে হবে। কাহনেমান দেখিয়েছেন, কিভাবে আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাসের কারণে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, এবং কিভাবে আমাদের পক্ষপাতিত্ব আমাদের বিচারের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই বইটি আমাদের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের চিন্তা-ভাবনা, মতামত, এবং সিদ্ধান্তগুলোর মুল্যায়ন করতে পারি।
সুতরাং, ‘থিঙ্কিং, ফাস্ট অ্যান্ড স্লো’ কেবল একটি তত্ত্ব নয়, বরং একটি মূল্যবান শিক্ষা যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং গবেষণায় যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হতে পারে। সিস্টেম ১ এবং সিস্টেম ২ এর সমন্বয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারলে, আমরা আরও বেশি কার্যকরী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবো। এই বইটি বিজ্ঞানী, গবেষক, এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ, যা আমাদের চিন্তার গভীরতা ও সতর্কতা বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বের নানা কোণ থেকে যে সব বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কাজ করছেন, তাদের জন্য ‘থিঙ্কিং, ফাস্ট অ্যান্ড স্লো’ একটি দিকনির্দেশিকা হতে পারে। গবেষণার ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতির ব্যবহার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ এবং নির্ভুল করতে কাহনেমানের দেয়া পরামর্শ কার্যকর হতে পারে

Leave a comment