তথ্যপ্রযুক্তিপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

প্রযুক্তি খাতে কর্মীরা কি দ্রুত চাকরি পরিবর্তন করে? 

Share
Share

প্রযুক্তি খাতকে ঘিরে বিশ্বজুড়েই এক ধরনের ধারণা প্রচলিত—এখানে কর্মীরা ঘন ঘন চাকরি বদলান, নতুন স্কিল শেখেন ও প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেন। তবে অস্ট্রেলিয়ার একটি সাম্প্রতিক বড় গবেষণা এই প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

Tech Council of Australia-এর ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার প্রযুক্তি খাতে কর্মরতদের মধ্যে চাকরি পরিবর্তনের হার মাত্র ৮%, যেখানে অন্যান্য খাতে এই হার প্রায় ১১%। একই সঙ্গে দেখা গেছে, এক জন প্রযুক্তি কর্মী গড়ে ৫.৩ বছর একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।

কেন প্রযুক্তি খাতে এই স্থায়িত্ব?

অস্ট্রেলিয়ায় প্রযুক্তি খাতকে এক দীর্ঘমেয়াদি পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে কয়েকটি কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে:

  • প্রযুক্তি কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম
  • কর্মক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ও কর্ম-জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি
  • নারীদের জন্য আলাদা অনুপ্রেরণা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মপরিবেশ
  • সরকারিভাবে প্রযুক্তি খাতকে ‘Future-Proof Jobs’ হিসেবে ঘোষণা করা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: চিত্রটা কতটা ভিন্ন?

বাংলাদেশে আইটি ও সফটওয়্যার খাতে কর্মরতদের মধ্যে চাকরি পরিবর্তনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। BASIS-এর ২০২২ সালের এক জরিপ অনুসারে:

  • দেশের সফটওয়্যার ও আইটি সেক্টরে চাকরির গড় স্থায়িত্ব মাত্র ১.৮ বছর
  • ৬০% তরুণ ডেভেলপার ৩ বছরের মধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ পরিবর্তন করেন
  • ৭০% স্টার্টআপ কর্মী ২ বছরের মধ্যে নতুন সুযোগের জন্য স্থান পরিবর্তন করেন

তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের আইটি খাতে কর্মরত ৬৪% তরুণ কর্মী ৩০ বছরের নিচে, যাদের অধিকাংশই দ্রুত বেতন বৃদ্ধির আশায় চাকরি পরিবর্তন করে থাকেন। অন্যদিকে, ৭৫% প্রতিষ্ঠানে কোনও নির্দিষ্ট ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বা স্কিল ডেভেলপমেন্ট স্ট্রাকচার নেই।

এর কারণগুলো হল:

  • বেতনের বৈষম্য ও অস্থিরতা: অনেক প্রতিষ্ঠানে টেক ট্যালেন্ট ধরে রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই
  • ক্যারিয়ার উন্নয়নের সুযোগ কম: কোম্পানির মধ্যেই ভেতর থেকে প্রমোশন বা স্কিল ডেভেলপমেন্টের অভাব
  • ওভারটাইম কালচার ও ক্লান্তিকর পরিবেশ: কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য হারায়
  • স্টার্টআপ কালচারের কারণে উচ্চ হারে ইন-আউট ফ্লো

অস্ট্রেলিয়ার আরেকটি বড় শিক্ষা: প্রযুক্তিগত ব্যর্থতার ঝুঁকি

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান স্টক এক্সচেঞ্জ (ASX) একটি $২৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ব্লকচেইন ভিত্তিক প্রযুক্তি আপগ্রেড চালু করতে গিয়ে ভয়াবহ ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। এর ফলে অস্ট্রেলিয়ার রিজার্ভ ব্যাংক বলেছে যে, ASX-এর এই ব্যর্থতা পুরো দেশের ফিনান্সিয়াল সিস্টেমের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলেছে।

বাংলাদেশেও এরকম উদাহরণ রয়েছে:

  • ২০২৩ সালে একটি বড় ব্যাংকে ১২ ঘণ্টার জন্য Core Banking System ডাউন ছিল
  • অনলাইন সরকারি আবেদন ব্যবস্থায় বছরে অন্তত ৩-৪ বার সিস্টেম ফেইলর দেখা যায়
  • ২০২২ সালে ৩০টিরও বেশি সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক বা ডেটা লিকের শিকার হয় (সাইবার ক্রাইম ইউনিট রিপোর্ট)

কী শেখার আছে আমাদের?

১. চাকরির স্থায়িত্বের জন্য কর্পোরেট সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার: প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, এবং স্কিল ডেভেলপমেন্টে গুরুত্ব দিতে হবে

২. টেক ট্যালেন্ট ধরে রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার: যেমন ESOP (Employee Stock Ownership Plan), হাইব্রিড ওয়ার্কিং, ইনসেনটিভ

৩. প্রযুক্তি অবকাঠামোতে বিনিয়োগ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলিকে Disaster Recovery এবং Security Auditing বাধ্যতামূলক করতে হবে

ভবিষ্যতের দিকে চোখ

  • অস্ট্রেলিয়ায় এখন এমন আইন আসছে, যেখানে সরকারী টেন্ডার পেতে হলে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করতে হবে।
  • ছোট ব্যবসাগুলিকে অনলাইনে আনা হচ্ছে সক্রিয়ভাবে, যাতে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ে।
  • প্রযুক্তি এখন শুধু কাজ নয়, বরং সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে—যেখানে কোডিং, সমস্যা সমাধান ও উদ্ভাবনই মুখ্য।

বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতও যদি এই দিকগুলোতে মনোযোগ দেয়, তাহলে তরুণরা শুধু দক্ষতা অর্জনেই নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী ও মূল্যবান পেশাজীবনে রূপান্তরিত হতে পারবে।


আপনার মতামত দিন:
আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চাকরির স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য কতটা প্রস্তুত? নিচে মন্তব্য করে জানাতে পারেন।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
তথ্যপ্রযুক্তিনতুন প্রযুক্তি

চীনের রোবট সেনাবাহিনী: প্রযুক্তির নতুন রণক্ষেত্র

"মেড ইন চায়না ২০২৫" পরিকল্পনার আওতায় রোবোটিক্স এবং অটোমেশনে চীনের উত্থান কীভাবে...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

AI লেখা কীভাবে হিউম্যানাইজ করবেন?

AI-উত্পাদিত কন্টেন্টকে মানবিক করার জন্য সেরা ২০টি টুল আবিষ্কার করুন এবং একজন...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সাইবার অপরাধ: এআই-ই কি আমাদের শেষ ভরসা?

বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তায় এআই কীভাবে নতুন রূপ দিচ্ছে তা আবিষ্কার...

কোয়ান্টাম কম্পিউটিংতথ্যপ্রযুক্তি

কোয়ান্টাম কম্পিউটারে দৈবচয়ন সংখ্যার যুগান্তকারী সাফল্য

কোয়ান্টিনামের ৫৬-কিউবিট ট্র্যাপড-আয়ন কোয়ান্টাম কম্পিউটার কীভাবে সার্টিফাইড র‍্যান্ডম নম্বর জেনারেশন অর্জন করে...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

এআই কি সত্যিই বুদ্ধিমান?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনের সত্য আবিষ্কার করুন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সত্যিই বুদ্ধিমান নাকি...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.