বাংলাদেশের একজন গবেষক অধ্যাপক হোসাইনএম জাবেদ বর্তমানে চীনের গুয়াংজু ইউনিভার্সিটির স্কুল অব লাইফ সায়েন্স-এ অধ্যাপনা ও গবেষণা করছেন। চট্টগ্রামের দূরবর্তী দ্বীপ সন্দ্বীপে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তি অসংখ্য সামাজিক-আর্থিক বাধা অতিক্রম করে আজ জীবপ্রযুক্তির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত এক বিজ্ঞানী। তিনি বিশ্বের শীর্ষ ২% সর্বাধিক উদ্ধৃত (হাইলি-সাইটেড) বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন। সম্প্রতি এক আলোচনায় অধ্যাপক জাবেদ তাঁর সন্দ্বীপ থেকে গুয়াংজু পর্যন্ত শিক্ষাগত ও পেশাগত যাত্রার কথা বলেছেন, নিজের গবেষণা ক্ষেত্র সিন্থেটিক বায়োলজি ও জৈব-উৎপাদন (বায়োম্যানুফ্যাকচারিং) নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ তুলে ধরেছেন। Kung Fu Panda এনিমেশন কিংবা Mr. Bean-এর কৌতুক চরিত্রের উদাহরণ টেনে তিনি মজার ছলে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন। গবেষণা কেন এবং কিভাবে করতে হয়, এমনকি যারা ভবিষ্যতে বিসিএসের মতো ভিন্ন ধারার পেশাতেও যেতে চান তাদের জন্যও গবেষণার অভিজ্ঞতা কিভাবে সহায়ক হতে পারে সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাঁর কাজের ভূমিকা, কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে মূল্যবান পণ্য তৈরির উদ্যোগ এবং ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কীভাবে জীবপ্রযুক্তিতে বিপ্লব আনতে পারে তাও তিনি আলোচনা করেন। এই প্রবন্ধে অধ্যাপক জাবেদের সে আলোচনার আলোকে তাঁর জীবনকাহিনী, গবেষণার অন্তর্নিহিত দর্শন এবং নতুন প্রজন্মের প্রতি তাঁর প্রেরণাদায়ক বার্তা তুলে ধরা হলো।
শৈশবের সংকট থেকে উচ্চশিক্ষার পথযাত্রা
অধ্যাপক জাবেদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে, এক অভাবী পরিবারে। ছোটবেলা কেটেছে নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে; নদীগর্ভে ভিটেমাটি হারানো সাধারণ ব্যাপার ছিল তাঁর এলাকায়। সেখানকার উন্নয়ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতে খড়ি নিয়ে পরে সন্দ্বীপ কারগিল হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন তিনি। পরিবার ও সমাজের চাপে অনেকের মতো তিনিও প্রথমে ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে মেডিকেল কোচিং করেছেন, তবে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ওয়েটিং লিস্টে থাকায় শেষ পর্যন্ত ডাক্তারি পড়া হয়নি। প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন, কিন্তু কয়েক সেমেস্টার পর সেটা আর মন টানেনি। এক বছরের বিরতি নিয়ে পরের বছর ভর্তি হলেন মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে, সেখান থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এই সময়েই তিনি টিউশনি করিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন, যা শিক্ষকতার প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি করে।
মাস্টার্সের পরে অধ্যাপক জাবেদ চার বছর কাজ করেছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস-এ গবেষক হিসেবে। তিনি স্বীকার করেন, ইনসেপ্টায় চাকরি করার সময়ই বাস্তব কাজের মাধ্যমে গবেষণার অনেক কিছু শিখেছেন, যা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ল্যাবের সীমাবদ্ধতার কারণে সাধারণত শেখা কঠিন। ইনসেপ্টায় হাতে-কলমে কাজের সেই অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য ভিত্তি তৈরির কাজ করেছে বলে তিনি মনে করেন। তবে শিল্পক্ষেত্রে কাজ করতে করতেই তাঁর মন পড়েছিল শিক্ষাক্ষেত্রে ফেরার। তাই সুযোগ পেয়ে যোগ দেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইমেশিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে। কয়েক মাসের মধ্যেই উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে ২০১২ সালের শেষদিকে তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালায়ায় পিএইচডি করতে পাড়ি জমান।
মালয়েশিয়ায় পিএইচডি গবেষণার প্রথম দিকটা অধ্যাপক জাবেদের জন্য সহজ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্ত মৌলিক গবেষণা-জ্ঞান না থাকার কারণে শুরুতে প্রায় দুই বছর দিশাহীন অবস্থায় কাটাতে হয়েছে বলে তিনি অকপটে স্বীকার করেন। তবে অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তিনি পথ খুঁজে পান – নিজেই শিখে নেন কীভাবে গবেষণা পরিকল্পনা করতে হয়, ল্যাবরেটরি গুছিয়ে কাজ চালাতে হয় এবং পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করতে হয়। চার বছরে সফলভাবে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের সাত-সাতটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই প্রকাশনাগুলো বিশ্বের গবেষণা-মহলে তাঁর পরিচিতি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পিএইচডি শেষ করে দেশপ্রেমের টানে কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশে ফিরে এসে প্রাইমেশিয়াতে পুনরায় যোগ দেন। কিন্তু গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ ও আর্থিক স্থিতিশীলতার অভাবে দেশে টিকে থাকা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
এরপর আসে অধ্যাপক জাবেদের জীবনের আরেকটি বড় মোড়: চীনে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার সুযোগ। একটি প্রকল্পে যোগ দেওয়ার অফার পেয়ে তিনি ভবিষ্যতের অনেক হিসাব-নিকাশ না করেই সেই “গড-গিফটেড অপরচুনিটি” লুফে নেন। চীনের ঐ ল্যাবরেটরিতে তিনিই ছিলেন প্রথম বিদেশি গবেষক; নিজের দক্ষতা দিয়ে তিনি দলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পোস্টডক শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চীনে তাঁকে সরাসরি সহযোগী অধ্যাপক (প্রফেসর) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে তিন বছর গবেষণা ও অধ্যাপনায় কাটিয়ে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে অধ্যাপক জাবেদ চীনের গুয়াংজু ইউনিভার্সিটির লাইফ সায়েন্স স্কুলে যোগদান করেছেন এবং এখনও সেখানেই সাফল্যের সাথে কর্মরত আছেন। সন্দ্বীপের নদীভাঙা জনপদ থেকে গবেষণার বিশ্বমঞ্চে এই যাত্রা তাঁর অধ্যবসায়, অভিযোজনক্ষমতা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির অনন্য উদাহরণ।
গবেষণার ক্ষেত্র: সিন্থেটিক বায়োলজি ও সবুজ জৈব-উৎপাদন
অধ্যাপক জাবেদের গবেষণা ক্ষেত্র সিন্থেটিক বায়োলজি, যা জীবনবিজ্ঞানের এক আধুনিক শাখা। সহজ করে বলতে গেলে, সিন্থেটিক বায়োলজি হলো বিভিন্ন জৈবিক সিস্টেম (যেমন অণুজীব বা কোষ)কে আমাদের ইচ্ছামতো উদ্দেশ্যে পুনরায় নকশা (re-design) করে ব্যবহার করার বিজ্ঞান। প্রাকৃতিক জীবকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে মানুষের উপকারে লাগানোই এর মূল কথা। চিকিৎসা, পরিবেশ সংরক্ষণ, কৃষি ইত্যাদি নানা খাতে এর প্রয়োগ রয়েছে। অধ্যাপক জাবেদ এই শাখার একটি বিশেষ অংশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল বায়োটেকনোলজি, তথা জৈব-উৎপাদন (বায়োম্যানুফ্যাকচারিং) নিয়ে কাজ করছেন। এর লক্ষ্য হলো শিল্পকারখানায় যেসব রাসায়নিক পদার্থ ও জ্বালানি তৈরি হয়, সেগুলো যাতে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে উৎপাদন করা যায়, সে সমাধান খুঁজে বের করা। বর্তমানে অধিকাংশ শিল্প-রাসায়নিক petrochemical পদ্ধতিতে, অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক কাঁচামাল থেকে তৈরি হয়। সিন্থেটিক বায়োলজি সেই জায়গায় বিকল্প পথ দেখাচ্ছে – জীবাণু ও এনজাইমের সহায়তায় নবায়নযোগ্য উৎস থেকে প্রয়োজনীয় পদার্থ তৈরি করার পথ, যাকে বলা যায় গ্রিন ম্যানুফ্যাকচারিং। অধ্যাপক জাবেদের ভাষায়, তাঁদের কাজ “পেট্রোলিয়াম বা ফসিল ফুয়েল থেকে বেরিয়ে এসে সিন্থেটিক বায়োলজির টুল ব্যবহার করে সবুজ উৎপাদনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা”।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরুন, এথানল (জৈব-জ্বালানি) উৎপাদনের কথা চিন্তা করি। প্রথাগতভাবে মিষ্টিজাতীয় ফসল (যেমন আঙুরের রস) থেকে ইস্ট ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে fermentation করে মদ বা এথানল তৈরি করা হয়, যা এক অর্থে আদিম জৈব-উৎপাদনের উদাহরণ। তবে সেক্ষেত্রে জীবপ্রক্রিয়াটি (ইস্ট) ছিল একেবারেই প্রাকৃতিক। আধুনিক সিন্থেটিক বায়োলজি সেই প্রাকৃতিক অণুজীবকেই জিনগত পরিবর্তন (genetic modification) মাধ্যমে পুনরায় নকশা করছে যাতে উৎপাদন ক্ষমতা বহুগুণে বাড়ে। অর্থাৎ জীবপ্রক্রিয়ার বায়োপ্রডিউসার বা উৎপাদক জীবকে কৃত্রিমভাবে উন্নত করা হচ্ছে টার্গেট পণ্য বেশি পাওয়ার জন্য। এভাবে আমরা দই-রুটি তৈরির খামির থেকে শুরু করে জ্বালানি তৈরির জীবাণু – সবকিছুই আরও কার্যকর করে তুলতে পারি সিন্থেটিক বায়োলজির কল্যাণে।
সিন্থেটিক বায়োলজির দুটি প্রধান কার্যকরী উপাদান হল প্রোটিন/এনজাইম প্রকৌশল এবং মেটাবলিক (উপাপচয়) প্রকৌশল। প্রথমত, এনজাইম ইঞ্জিনিয়ারিং বলতে কোনো প্রোটিন-এনজাইমের কাঠামো ও গঠন সামান্য পরিবর্তন করে তার কর্মক্ষমতা বাড়ানোর প্রযুক্তিকে বোঝায়। শিল্পকারখানায় অনেক সময় উচ্চ তাপমাত্রা বা অস্বাভাবিক pH-এ বিক্রিয়া চালাতে হয়, অথচ প্রাকৃতিক এনজাইম এসব পরিবেশে কার্যকর নয়। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস আর্নল্ড ১৯৯০-এর দশকে পরিচালিত বিবর্তন (Directed Evolution) পদ্ধতিতে এনজাইমের জিনে ছোট ছোট পরিবর্তন এনে দেখতে পান, কিছু কিছু পরিবর্তনে এনজাইম উচ্চ তাপ-সহনশীলতা ও কার্যকারিতা অর্জন করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো এনজাইমের অ্যামিনো অ্যাসিড ক্রমে একটি অ্যালানিনকে যদি ভ্যালিন দিয়ে বদলানো হয় এবং তাতে এনজাইমের কর্মক্ষমতা বা স্থায়িত্ব বাড়ে, তবে ওই পরিবর্তনটি কাজে লেগেছে ধরতে হবে। এভাবে পরীক্ষাগারে বারবার রূপান্তরের মাধ্যমে উন্নত এনজাইম তৈরি করা যায়, যা শিল্পে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে দ্রুততর ও সস্তা করতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত, মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অর্থ হলো কোনো অণুজীবের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক পথ (metabolic pathway) বদলে দেওয়া, যেন তা ইচ্ছেমতো নতুন উপাদান তৈরি করতে পারে। কখনো একটি নির্দিষ্ট বায়োকেমিক্যাল পথ প্রকৌশলের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়, আবার কখনো পুরো কোষের মেটাবলিজমই পুনর্গঠন করা হয়, যাকে সিস্টেমেটিক মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। উদাহরণ হিসেবে, ব্যাকটেরিয়ার জিনোমে পরিবর্তন এনে এমনভাবে সাজানো যেতে পারে যাতে তা শর্করা খেয়ে প্রচুর ইথানল তৈরি করে বা বিপরীতে ক্ষতিকর CO₂ গ্যাস শোষণ করে অন্যান্য যৌগ তৈরি করে। প্রোটিন প্রকৌশল ও মেটাবলিক প্রকৌশল – এই দুই স্তম্ভের উপরেই সিন্থেটিক বায়োলজির উদ্ভাবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
নিজের পিএইচডি ও পরবর্তী গবেষণায় অধ্যাপক জাবেদ বিশেষভাবে জৈব-জ্বালানি (বায়োফুয়েল) এবং জৈবভিত্তিক রাসায়নিক উৎপাদনের উপর জোর দেন। তিনি পিএইচডিতে আখের রস থেকে বায়োএথানল তৈরির ওপর কাজ করেছেন। তবে এখন ২০২০-এর দশকে এসে এই বিষয়টিকে তিনি কিছুটা পরিণত (matured) ও অত্যন্ত প্রায়োগিক বলে মনে করেন। তাই সাম্প্রতিক বছরে তাঁর গবেষণা বায়োফুয়েল থেকে সরে আরো উচ্চমূল্যের বায়ো-কেমিক্যাল বা নতুন জৈব-উৎপাদনের দিকে মোড় নিয়েছে। গবেষণাকে সর্বদা সমসাময়িক ও চাহিদাসম্পন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত করার ব্যাপারে তিনি সচেতন। এতদসত্ত্বেও, জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্ভাবনে তাঁর কাজ পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রসঙ্গত, অধ্যাপক জাবেদের ইতোমধ্যেই অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রকাশনা রয়েছে – পিএইচডিএর সময়ে তাঁর লেখা দুটি রিভিউ প্রবন্ধ বিখ্যাত Renewable and Sustainable Energy Reviews জার্নালে প্রকাশিত হয়ে প্রতি বছর শত শতবার উদ্ধৃত হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁর মোট প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের সংখ্যা ৮০-এরও উপরে। এই অসামান্য গবেষণা-প্রবাহ তাঁকে বিশ্বব্যাপী উচ্চ-উদ্ধৃত গবেষকদের কাতারে পৌঁছে দিয়েছে। তবে তাঁর মতে, এ অর্জনও আসলে একটি ধারাবাহিক শিক্ষাযাত্রার ফসল – Sandwip থেকে Guangzhou পর্যন্ত যাত্রাপথের প্রতিটি ধাপই তাঁকে কিছু না কিছু শিখিয়েছে এবং তৈয়ারি করেছে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা: চ্যালেঞ্জের বাস্তবতা
একজন বাংলাদেশী হিসেবে দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে অধ্যাপক জাবেদ জানেন যে দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করতে গিয়ে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তাঁর বিশ্লেষণে, সমস্যাগুলো দুই ধরনের – (ক) কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা, এবং (খ) আমাদের নিজস্ব মানসিকতা ও প্রস্তুতির সমস্যা। অবকাঠামোর অভাবে আধুনিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রপাতি, ল্যাব সুবিধা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনুপস্থিত বা অপর্যাপ্ত। তিনি উদাহরণ দেন, অনেক ল্যাবরেটরিতে পর্যন্ত স্পেকট্রোফটোমিটার নেই, অথচ আমরা চাই বিশ্বমানের গবেষণায় সফলতা ফলাতে। গবেষণায় প্রসারতা আনতে যেখানে চীন ১৯৭৮ সাল থেকেই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ শুরু করে আজ শীর্ষে পৌঁছেছে, সেখানে বাংলাদেশে গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি। সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়া শুধু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কাঙ্খিত অগ্রগতি আসে না।
তবে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যাকেও তিনি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অনেক শিক্ষার্থীই কীভাবে গবেষণা শুরু করবে, কোন পথে এগোবে – এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। স্পষ্ট লক্ষ্য (Defined Goal) নির্ধারণের অভাব তাঁদের অগ্রযাত্রাকে শুরুতেই থামিয়ে দেয়। অধ্যাপক জাবেদ মজার ছলে বলেন, আমাদের অবস্থা অনেকটা Mr. Bean-এর মতো এক কমেডি দৃশ্যের মতো। জনপ্রিয় চরিত্র মিস্টার বিন একবার জানুয়ারি সেলে সবার আগে দোকানে ঢুকে গিয়েও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল – কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছিল না, কারণ তার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। বাংলাদেশের বহু ছাত্রছাত্রীর ক্ষেত্রেও একই দশা: সুযোগ পেলেও তারা কী করবে ঠিকঠাক ভেবে না নিতে পারায় পিছিয়ে যায়।
শুধু লক্ষ্যহীনতা নয়, আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক সময় পরিশ্রম ও আত্মউন্নয়নের সহজ পথ এড়িয়ে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আটকে থাকে। অধ্যাপক জাবেদের পর্যবেক্ষণ, দেশে বিভিন্ন সেমিনার-ওয়ার্কশপ, এমনকি ধর্মীয় ওয়াজ নসিহতেরও অভাব নেই; কিন্তু সেসব শুনে বাস্তবে খুব কমই পরিবর্তন আসে। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন, “বাংলাদেশে যত ওয়াজ হয়, পৃথিবীর আর কোথাও হয় না; কিন্তু তবু মসজিদে ঢোকার আগে জুতা বগলে নিতে হয়” – অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন ও নৈতিক বার্তা শোনার আয়োজন প্রচুর, কিন্তু আমরা শিক্ষাগুলো কাজে লাগাচ্ছি না। এই দৃষ্টান্ত টেনে তিনি বুঝিয়েছেন যে শুধু বক্তৃতা শোনা বা মুখস্থ বিদ্যায় কাজ হবে না, নিজের উন্নতির জন্য নিজেকেই উদ্যোগী হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের বাইরে নিজে থেকে নতুন কিছু শেখার মানসিকতা আমাদের অনেকেরই গড়ে ওঠেনি।
অধ্যাপক জাবেদ মনে করেন, নিজের শক্তিতে নিজেকে গড়ে তোলার বিশ্বাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরুরি। লক্ষ্য ঠিক করে আত্মবিশ্বাসের সাথে পরিশ্রমে লেগে থাকতে হবে – এ বিষয়ে তিনি বারবার জোর দেন। তাঁর কথায়, “আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে একমাত্র আপনি নিজের পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন।” Kung Fu Panda চলচ্চিত্রের কাহিনী উল্লেখ করে তিনি এই বার্তাটিই দেন যে শারীরিক গঠন, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বা পিছিয়ে পড়া পটভূমি কোনোটাই বাধা নয় যদি দৃঢ় প্রত্যয় থাকে। সেই ছবির নায়ক একটি মোটাসোটা পান্ডা হওয়া সত্ত্বেও কুংফু ওস্তাদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল এবং অবশেষে কঠোর প্রশিক্ষণ ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে ড্রাগন যুদ্ধাবাজ উপাধি অর্জন করে। সেখানে “গোপন সূত্র” হিসেবে যে স্ক্রলটির কথা বলা হয়, সেটা আসলে ফাঁকা – নিজের প্রতিফলন তাতেই দেখতে পায় পান্ডা; অর্থাৎ কোনো ম্যাজিক নেই, নিজের মধ্যেই শক্তি লুকিয়ে আছে। এই গল্প দ্বারা অধ্যাপক জাবেদ বোঝাতে চান যে আমাদের অনেক শিক্ষার্থীর সম্ভাবনা ও মেধা আছে, কিন্তু তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দৃঢ় সংকল্প, স্ব-প্রচেষ্টা ও আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন।
বাংলাদেশের তরুণদের মেধা নিয়ে অধ্যাপক জাবেদ অত্যন্ত আশাবাদী। মালয়েশিয়া, চীনে বিভিন্ন জাতির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করে তিনি দেখেছেন যে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিমত্তা ও শেখবার ক্ষমতা অসাধারণ। সমস্যা শুধু, আমরা সেটিকে কাজে লাগাচ্ছি না বা সঠিক পথে চালনা করছি না। উপযুক্ত দিকনির্দেশনা ও উদ্যোগের অভাবে আমাদের মেধা পুরো উদ্ভাসিত হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন। সামগ্রিক পরিবেশও গবেষণার অনুকূল নয়; তার উপর যদি শিক্ষার্থীরা নিজেরাও চেষ্টা না করে, তবে উন্নতি সম্ভব নয়। তাই অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার – পরনির্ভরতা ছেড়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়া, উৎসাহের অভাবে থেমে না গিয়ে ছোট সুযোগগুলোকেও কাজে লাগানো এবং অধ্যবসায় ধরে রাখা। তাহলেই সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও সৃষ্টিশীল গবেষণা সম্ভব হবে।
আগ্রহ থেকে অর্জন: শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা শুরুর বাস্তব পরামর্শ
গবেষণার জগতে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য অধ্যাপক জাবেদের মূল বার্তা হলো: লক্ষ্য নির্ধারণ করুন এবং শেখা শুরু করুন – কথা কম, কাজ বেশি। তিনি বলেন, “জাস্ট বি এ ওয়ার্কার, নট এ স্পিকার” অর্থাৎ বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা বড় বড় ভাবনায় নয়, সরাসরি কাজের মাধ্যমে শেখায় মন দিতে হবে। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নতুন গবেষণাপ্রত্যাশীদের জন্য কয়েকটি ধাপ অনুসরণের পরামর্শ দেন:
- বিষয় নির্বাচন: সবার আগে আপনাকে গবেষণার একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা সমস্যা বেছে নিতে হবে। তবে সেটা এমনভাবে নির্বাচন করুন যা আপনার মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত এবং বহুমুখী কাজে লাগে। অধ্যাপক জাবেদের পরামর্শ, যদি আপনি জীববিজ্ঞানের ছাত্র হন, তবে প্রোটিন ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিংএর মতো মৌলিক ও বিস্তৃত বিষয় দিয়ে শুরু করতে পারেন। এ ধরনের বিষয় একদিকে জীববিজ্ঞানের ভিত্তি মজবুত করবে, অন্যদিকে ভবিষ্যতে জীববিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় কাজ করতে এই জ্ঞান কাজে লাগবে। তিনি বলেন, এই দুটি বিষয় শিখে রাখলে জীববিজ্ঞানের ভেতরে কোনো গবেষণা ক্ষেত্রেই আপনি “ঠেকে যাবেন না” – প্রয়োজনমতো একটু বদলে যেকোনো শাখায় অবদান রাখতে পারবেন। সুতরাং শুরুতেই খুব সঙ্কীর্ণ বা সংকুচিত বিষয়ের গভীরে না গিয়ে এমন একটা বিষয় নিন যা বহু গবেষণার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
- সহজ পাঠে হাতেখড়ি: বাছাই করা বিষয়টি নিয়ে সরাসরি জটিল থিসিস পেপার পড়া শুরু না করে আগে সাধারণ ধারণা তৈরি করুন। অধ্যাপক জাবেদ নতুন ছাত্রদের প্রথমে ঐ বিষয়ে লেখা সহজ-ভাষার একটি রিভিউ প্রবন্ধ বা কোনো প্রায়োগিক প্রবন্ধ পড়তে দেন। যেমন তিনি এক ছাত্রকে দিয়েছিলেন কৃষিজ বর্জ্য থেকে কীভাবে বায়োফুয়েলের কাঁচামাল তৈরি করা যায় সেই নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধ। এ ধরণের লেখা অনেকটা গল্পের মতো – বাস্তব সমস্যার বর্ণনা ও সমাধানের চেষ্টা – যা পড়ে জটিল বিজ্ঞানকেও সরলভাবে বুঝতে সুবিধা হয়। সহজ লেখা দিয়ে শুরু করলে বিষয়ের প্রতি ভীতি কেটে গিয়ে কৌতূহল ও আগ্রহ জন্মায়। তাই গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে জটিল তত্ত্বের গভীরে ঝাঁপ না দিয়ে সহজবোধ্য আর্টিকেল, পপুলার সায়েন্স লেখা বা সাধারণ রিভিউ দিয়ে নিজের জ্ঞানভিত্তি তৈরি করুন।
- পঠন-পাঠন: গভীরতা এবং ধৈর্য: একবার আগ্রহ তৈরি হলে আস্তে আস্তে একটু গভীরে যেতে হবে। নির্বাচিত বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ (রিসার্চ আর্টিকেল) পড়া শুরু করুন এবং ধৈর্য ধরে পড়ে যান। শুরুতে অনেক কিছুই বোঝা যাবে না – এটি স্বাভাবিক এবং সব শিক্ষার্থীই এটা ফেস করে। কঠিন শব্দভাণ্ডার, জটিল ধারণা বা অজানা পদ্ধতির উল্লেখে মাথা ঘুরাতে পারে। এখানে অধ্যাপক জাবেদের মন্ত্র হল: হাল ছেড়ো না। তিনি বলেন, একটা গবেষণার সংক্ষিপ্তসার (abstract) প্রথমবার পড়ে যদি কিছুই মাথায় না ঢোকে, তবে সেটাকে দশ বার পড়ুন! প্রথম পাঠে বিষয়টি “অজানা পাহাড়ের” মতো লাগতে পারে, দ্বিতীয়বার পড়ায় কিছু আঁচ আসবে, তৃতীয়বারে আরও পরিষ্কার হবে। অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জট খুলতে থাকবে। এভাবে সময় লাগিয়ে পড়তে ছাত্রদের যথেষ্ট ধৈর্য থাকা চাই। এখানে একটা ভালো দিক হল – স্নাতক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের হাতে সময় থাকে প্রচুর, যেটা জীবনের পরের ধাপে আর থাকবে না। অতএব সেই স্পেয়ার টাইমটুকু পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে পড়াশোনায় নিবিষ্ট হয়ে।
- সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার: আগের যুগের তুলনায় আজকাল পড়াশোনাকে সহজ করার অনেক ডিজিটাল হাতিয়ার রয়েছে। ভাষাগত বা বিষয়বস্তুর জটিলতা দূর করতে ছাত্ররা এখন এআই ভিত্তিক অনুবাদ ও বিশ্লেষণ টুল ব্যবহার করতে পারেন। অধ্যাপক জাবেদ উল্লেখ করেন যে বর্তমানে এমন এআই সিস্টেম আছে যা আপনার না-বোঝা কোনো শব্দ বা ধারণাও বারবার ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবে। সুতরাং, কেবল ইংরেজি দুর্বল বা বিষয় কঠিন এই অজুহাতে পড়া থেকে পিছু হটলে চলবে না। গুগল স্কলার, বিভিন্ন ওপেন সোর্স রিসোর্স এবং ChatGPT-এর মতো এআই সহায়তা নিয়ে যেকোনো জার্নাল পেপারকেও এখন বহুলাংশে বোধগম্য করে নেওয়া সম্ভব। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে হলেও আসল কাজটা আপনাকেই করতে হবে – মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে এবং বুঝতে হবে।
- কনটেন্ট থেকে নির্যাস আহরণ: শুধু পড়লেই হবে না, পড়া থেকে কী শিখলেন তা বের করে আনতে হবে। অধ্যাপক জাবেদ জোর দিয়ে বলেন পড়াশোনাকে “আউটপুট-ওরিয়েন্টেড” হতে হবে। অর্থাৎ একটি প্রবন্ধ পড়ার পর আপনি নিজে থেকে তার একটি সারমর্ম বা ফলাফল টানার চেষ্টা করুন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি এনজাইম ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ পড়েন, দেখুন সেখানে কী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হয়েছে, কোন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে, পরিবর্তন করে কী উন্নতি পেল। হতে পারে, সে প্রবন্ধে উল্লেখ আছে অমুক এনজাইমের অমুক অ্যামিনো অ্যাসিড বদলে তাপ-সহনশীলতা ২০% বেড়েছে এবং এজন্য সাইট-ডাইরেক্টেড মিউটাজেনেসিস পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। তাহলে প্রবন্ধটি থেকে আপনার আউটপুট জ্ঞান হবে: “অমুক এনজাইমের কর্মক্ষমতা জিনগত পরিবর্তনে বৃদ্ধি করা সম্ভব এবং তার একটি পদ্ধতি আমি শিখলাম।” এভাবে প্রতিটি আর্টিকেল পড়ে অন্তত কিছু শেখার পয়েন্ট বের করুন। কিছু না বুঝলে প্রশ্ন নোট করুন, পরে খতিয়ে দেখুন। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে বিষয়ের উপর আপনার দখল বাড়বে, অন্যদিকে গবেষণার ফাঁক-ফোকর (research gap) কোথায় আছে তাও ধীরে ধীরে ধরতে পারবেন। আসলে যখনই নিজেকে প্রশ্ন করবেন “এখনও কী জানার বাকি, অন্যভাবে করা যেত কিনা, কীProbleM এখনো সমাধান হয়নি”, তখনই আপনি নতুন গবেষণার পথ খুঁজে পাবেন। গবেষণা-প্রশ্ন খুঁজে বের করাটা একজন নবীন গবেষকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্কিল, যা এই পর্যায়ে গড়ে তোলা যায়।
- লেখার অনুশীলন: জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি “বিজ্ঞানলেখার কৌশল” শেখা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে যারা ভবিষ্যতে অ্যাকাডেমিয়াতে যেতে চান। অধ্যাপক জাবেদ পরামর্শ দেন যে পড়ার পাশাপাশি সৃজনশীল লেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে। ধরুন আপনি একটি গবেষণাপত্রের অ্যাবস্ট্রাক্ট পড়লেন। এবার কাগজ কলম নিয়ে চেষ্টা করুন সেটা নিজ ভাষায় লিখতে। প্রথমবার দেখা দেখে লিখতে পারেন; তারপর ধীরে ধীরে না দেখে মূল পয়েন্টগুলো মনে করে লিখুন। এরপর মূল পাঠের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন কোথায় ভুল বা ঘাটতি হচ্ছে। এভাবে লেখার প্র্যাকটিস করলে আপনার দুটো লাভ হবে – (১) বিষয়বস্তু verdader বুঝেছেন কিনা তা যাচাই হবে, এবং (২) বৈজ্ঞানিক লেখাগল্পের শৈলী আয়ত্তে আসবে। অনেকে গবেষণা করতে চায় কিন্তু নিজের আইডিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে হিমশিম খায়, কারণ একাডেমিক রাইটিংয়ের অভ্যাস নেই। তাই শুরু থেকেই ছোট ছোটভাবে লিখুন: রিভিউয়ের সারাংশ লিখুন, নিজের গবেষণা-ব্লগ লিখুন বা নোট করুন। এতে ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস ও ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়বে, যা আপনাকে দীর্ঘমেয়াদে মৌলিক গবেষণা করতে ও ফলাফল প্রকাশ করতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করবে।
- ধৈর্য ধরে চালিয়ে যান ও নিজেকে প্রশ্ন করুন: গবেষণার শুরুতে বিরক্তি আসা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, বিশেষ করে বারবার পড়েও যদি কিছু কিছু না বোঝা অনুভব হয়। অনেকে এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয়। অধ্যাপক জাবেদ বলে থাকেন, “একটা abstract দশ বার পড়ুন” – অর্থাৎ ধৈর্যের বাধ ভেঙে আবার পড়ুন। যখনই মনে হবে “আর পারছি না, বুঝতে পারছি না”, ঠিক তখনই আরও একবার চেষ্টা করা দরকার। তবেই মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে এই নতুন ভাষা শিখতে শুরু করবে। নিজেকে সবসময় চ্যালেঞ্জ করুন: “এই কাজটা কেন এভাবে হলো? অন্যভাবে কি সম্ভব ছিল? এখন পর্যন্ত কতদূর অগ্রগতি হয়েছে?” – এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখবেন আপনার জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং আপনি পরের ধাপে কী করা উচিত সেটা বুঝতে পারছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে Fundamental উন্নতি কোনো শর্টকাটে হয় না – শত বক্তৃতা শুনেও কোনো লাভ হবে না যদি আপনি নিজে হাতে কলমে চর্চা না করেন। অনেক শিক্ষার্থী স্রেফ সেমিনার শুনে, সার্টিফিকেট জোগাড় করে সময় নষ্ট করে; বছর দুই পর দেখে কিছুই হাতে নেই। এই ভুলটা না করে বরং ছোট্ট একটা বিষয় নিয়েও হোক, বাস্তব কাজ শুরু করাই শ্রেয়।
উপরের পরামর্শগুলোর সার সংক্ষেপ হলো: নিজের আগ্রহের বিষয় নিয়ে গভীর পড়াশোনা করুন, শিখুন, শিখে তা লিখে প্রকাশের অভ্যাস করুন; অন্যকে নয়, নিজেকেই আপনাকে তৈরী করতে হবে। অধ্যাপক জাবেদ বলেন, “কোনো ধরনের লেকচার শুনার দরকার নেই… নিজেকে ডেভেলপ করতে হলে শুরু করতে হবে এবং শুরুটা হাতে-কলমেই হতে হবে”। অর্থাৎ বড়দের জ্ঞানধারায় ভেসে না থেকে ছোট পরিসরে হোক, নিজেই কাজ শুরু করুন। গবেষণা মানে শুধু ল্যাবে গিয়ে ফ্যান্সি যন্ত্র চালানো নয় – এটা একধরণের চিন্তাধারা, যা যে কেউ সীমিত উপকরণেও শুরু করতে পারেন। উদাহরণসরূপ, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন উন্নত ল্যাব না পান, হতাশ হওয়ার দরকার নেই; আপনি লাইব্রেরি বা ইন্টারনেটকে আপনার ল্যাব বানিয়ে নিন। একটি ভালো রিভিউ পেপার লিখে ফেলুন, কোনো সমস্যার ডেটা নিয়ে বাড়িতে বসে বিশ্লেষণ করে দেখুন, প্রয়োজনে সিনিয়রদের কাছে ই-মেইলে পরামর্শ নিন। এই যুগে খোলা অ্যাকসেস তথ্যের মাধ্যমে অনেক গবেষণা ঘরে বসেই করা যায়। যতক্ষণ না আপনি হাতে-কলমে কিছু অর্জন করছেন, ততক্ষণ নিজেকে গবেষকের পথে মনে করবেন না – এটাই তাঁর মূল কথা।
ক্যারিয়ার উন্নয়নে গবেষণার ভূমিকাঃ শুধু অধ্যাপক হওয়ার জন্য নয়
অনেকে ধারণা করেন যে গবেষণা হয়তো কেবল তাদের জন্যই যারা আজীবন বিজ্ঞানী বা অধ্যাপক হতে চান। কিন্তু অধ্যাপক জাবেদ এই চিন্তাকে ভেঙে দিয়ে দেখিয়েছেন যে গবেষণায় জড়ানোর অভিজ্ঞতা সর্বস্তরের ক্যারিয়ারেই উপকারী হতে পারে। প্রথমেই তিনি বাস্তবদৃষ্টিতে বলেন যে, গবেষণা তাঁর নিজের পেশার আবশ্যক অংশ – একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হিসেবে টিকে থাকতে ও এগোতে হলে তাঁকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক গবেষণা-পত্র প্রকাশ করতে হয়, প্রকল্পের তহবিল আনতে হয়। অর্থাৎ গবেষণা করা তাঁর জীবিকা ও জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হয়তো বাংলাদেশে থাকলে তিনি শুধু ক্লাস নিতেন, কিন্তু বিদেশের চাকরির চাহিদা অনুযায়ী তাঁকে নিয়মিত গবেষণা করতেই হবে। এ বাস্তব কারণের বাইরে গবেষণার পিছনে তাঁর নিবেদন আছে জ্ঞানচর্চার নেশা ও সমাজে অবদান রাখার বাসনা থেকেও – কিন্তু সেটাকে তিনি দ্বিতীয় কারণ বলে উল্লেখ করেন। প্রথমত জীবিকা, দ্বিতীয়ত জ্ঞানসেবা – দুইয়ে মিলে তিনি আজ গবেষণার পথে আছেন।
এবার ধরুন এমন একজন শিক্ষার্থীর কথা, যার লক্ষ্য ভিন্ন – সরকারী চাকরি (বিসিএস) বা ব্যাংকে চাকরি করা। তার জন্য গবেষণার আলাদা কোনো তাৎপর্য আছে কি? অনেকে ভাবেন অ্যাকাডেমিক গবেষণা তাদের কোনও কাজে আসবে না। অধ্যাপক জাবেদ স্পষ্ট করে বলেন, এই ধারণা ভুল। যদি কেউ স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার অবসরে একটু গবেষণার কাজ করেন বা একটি প্রকাশনা বের করেন, সেটি সরাসরি বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সমাধান করে নাও দিতে পারে, কিন্তু পরোক্ষভাবে তাঁর মস্তিষ্ককে যে শাণিত করবে তা অসাধারণ। গবেষণায় যুক্ত থাকলে মানুষ শেখে কীভাবে সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে হয়, সমস্যাকে ভেঙে দেখতে হয়, নতুন জিনিস দ্রুত আত্মস্থ করতে হয়, এবং অজানাকে জানার কৌশল আয়ত্ত করতে হয়। এগুলো এমন transferable skills যা যে কোনো পেশায় সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। বিসিএস ক্যাডার হোন বা কর্পোরেট কর্মকর্তা—আপনার বিশ্লেষণী ক্ষমতা, দ্রুত শিখে ফেলার যোগ্যতা, কঠিন চাপে থেকেও তথ্য বের করে আনার সক্ষমতা যদি থাকে, তবে আপনি অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকবেন। অধ্যাপক জাবেদের কথায়, “আপনি গবেষণার সাথে ইনভলভ ছিলেন… যেসব জিনিস আপনার মস্তিষ্কে ইতিমধ্যে সেটআপ হয়ে যাবে… সেগুলো কিন্তু আপনার অজান্তেই কর্মস্থলে সাহায্য করবে।” অর্থাৎ, গবেষণা আপনাকে অজান্তেই আরও কার্যকর কর্মীতে পরিণত করবে।
তবে তিনি এও বলেছেন যে উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকারের পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। যদি আপনার প্রয়োজন হয় যে স্নাতক শেষে দ্রুত চাকরিতে ঢুকতে হবে, পরিবারকে সাপোর্ট দিতে হবে, তাহলে হয়তো পড়াশোনার ফাঁকে বড় কোনো গবেষণা প্রকল্পে জড়ানোর অবসর বা সক্ষমতা আপনার নেই। সে ক্ষেত্রে নিজের মূল লক্ষ্য (যেমন বিসিএস) অর্জনের প্রস্তুতিতেই ফোকাস করা শ্রেয়। অধ্যাপক জাবেদ বলেন, যদি কেউ বিসিএস পরীক্ষার ঠিক আগে গবেষণার ঝুঁকি নেয় এবং তাতে এতটাই ডুবে যায় যে মূল প্রস্তুতি থেকে সরে যায়, সেটি হবে অবাস্তব সিদ্ধান্ত। তাই সময় ও সুযোগ বুঝে গবেষণা করতে হবে। ছাত্রজীবনের প্রথম দিকে বা মাঝামাঝি সময়ে যখন কিছু অবসর সময় থাকে, তখনই গবেষণায় হাতেখড়ি নেওয়া ভালো। একবার চাকরিতে ঢুকে গেলে বা শেষ সেমিস্টারের চাপ চলে এলে গবেষণার জন্য আলাদা সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ক্যারিয়ারের দিক থেকে গবেষণার আরেকটি লাভের কথা তিনি বলেছেন – এটি আপনাকে একটি অতিরিক্ত বিকল্প (backup option) দিয়ে রাখে। অনেকেই স্নাতকের সময়ে নিশ্চিত জানেন না ভবিষ্যতে ঠিক কী করতে চান। যদি সামান্য হলেও গবেষণার অভিজ্ঞতা আপনার থাকে, আপনি পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা বা বিদেশে বৃত্তির সুযোগ পেতে পারেন, গবেষণাকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেয়ার পথ খোলা থাকে। আর যদি পরিশেষে আপনি প্রশাসন বা ব্যবসায়-যে ক্ষেত্রেই যান না কেন, গবেষণার অভিজ্ঞতা মন্দের ভালো হতে পারে না; বরং আপনি যেকোনো তথ্য-নির্ভর কাজে সৃষ্টিশীলভাবে চিন্তা করতে পারবেন।
সারকথা, অধ্যাপক জাবেদ তরুণদের গবেষণামুখী হওয়ার পরামর্শ দেন ঠিকই, তবে কাউকে অবাস্তব স্বপ্ন দেখতে বলেন না। নিজের পরিস্থিতি, দায়িত্ব এবং স্বপ্ন – এই তিনের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে যতটা সম্ভব গবেষণার স্বাদ গ্রহণ করা উচিত, এমনটাই তাঁর পরামর্শ। কেউ যদি পুরোদস্তুর বিজ্ঞানী হতে চান, তবে তো কথাই নেই – যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপরে বর্ণিত কৌশলগুলো নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আর যদি অন্য পেশায়ও যান, অন্তত ছাত্রজীবনের কিছুটা সময় গবেষণায় যুক্ত থেকে নিজেকে শাণিত করুন, যাতে মস্তিষ্কটাকে একটু বেশিদিন সক্রিয় রাখা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই ভবিষ্যৎ: তাঁর গবেষণার ব্যাপক প্রভাব
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়, এবং অধ্যাপক জাবেদের গবেষণা এ সমস্যার সমাধানে অবদান রাখার সম্ভাবনা বহন করে। তিনি বলেন, তাঁর কাজ মূলত গ্রিন ম্যানুফ্যাকচারিং বা সবুজ উৎপাদন প্রযুক্তি নিয়ে – সহজ কথায় কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো যার উদ্দেশ্য। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে জীবভিত্তিক পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎস থেকে জ্বালানি ও রাসায়নিক তৈরি করলে একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে অবদান রাখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই গবেষণার ফলাফল বাস্তবে কতটা কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে?
প্রথমেই বায়োফুয়েলের প্রসঙ্গ ধরা যাক। যুক্তরাষ্ট্রে ভুট্টার শস্য থেকে এবং ব্রাজিলে আখের রস থেকে যেভাবে ইথানল (জৈব-জ্বালানি) তৈরি হয়, তা প্রথম প্রজন্মের বায়োফুয়েল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এগুলো খাদ্যযোগ্য ফসল ব্যবহার করে জ্বালানি বানায় বলে ব্যাপক সমালোচনা আছে—“ফুড ভার্সেস ফুয়েল” বিতর্ক। সেই সংকট এড়াতে বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে চেষ্টা করেছেন ফসলের বদলে লিগনোসেলুলোজিক বায়োমাস—যেমন ধানের তুষ, খড়, কাঠের গুঁড়ো ইত্যাদি কৃষি ও বনজ বর্জ্য—ব্যবহার করে দ্বিতীয় প্রজন্মের বায়োফুয়েল তৈরি করতে। এই কাঁচামাল সস্তা এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় (বাংলাদেশসহ প্রায় প্রতিটি দেশেই ফসল কাটার পরে বিপুল পরিমাণ খড়–কুটো অব্যবহৃত পড়ে থাকে)। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব থেকে ইথানল বা অন্যান্য জ্বালানি উৎপাদনের প্রযুক্তি বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল। উদাহরণস্বরূপ, সেলুলোজ ভাঙার এনজাইম খুব দামি, আর পুরো প্রক্রিয়াটি এখনো তেলজাত জ্বালানির তুলনায় বেশি ব্যয়বহুল। ফলে বিনিয়োগকারীরা এতে আগ্রহ দেখাননি। অধ্যাপক জাবেদ উল্লেখ করেন, কিছু দেশে এই প্রযুক্তিকে টিকিয়ে রাখতে সরকার ভর্তুকি (সাবসিডি) দিয়েছিল, যাতে খাদ্যশস্য ব্যবহার করতে না হয়। কিন্তু যখন সেই ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়, তখন অনেক দ্বিতীয় প্রজন্মের বায়োফুয়েল কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ জলবায়ু রক্ষার জন্য আমরা যত প্রস্তুতই হই, অর্থনৈতিক টেকসইতা না এলে সবুজ প্রযুক্তি বাস্তবে স্থায়ী হয় না।
তারপরও আশার কথা হচ্ছে, বিজ্ঞান থেমে নেই। অধ্যাপক জাবেদ জানান, এখন গবেষণা চলছে আরও উদ্ভাবনী দিকের দিকে—কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) গ্যাসকেই মূল্যবান পণ্যে রূপান্তর করার ওপর। এটি সত্যিই শত্রুকে বন্ধু বানানোর মতো ব্যাপার – পরিবেশের প্রধান ক্ষতিকর গ্যাসটিকে যদি আমরা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে জ্বালানি বা রাসায়নিক বানাতে পারি, তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে।তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই বেশ কিছু গবেষণায় CO₂ গ্যাস সংগ্রহ করে তা থেকে জৈব প্রক্রিয়ায় অ্যাসিটেট নামের দুই-কার্বনবিশিষ্ট যৌগ তৈরি করা গেছে, যা পরে অণুজীব ব্যবহার করে রূপান্তরিত করে নানান পণ্য তৈরির দিকে এগোনো যাচ্ছে। এসব এখনও পরীক্ষাগারে আছে, তবে সফল হলে ভবিষ্যতে শিল্পকারখানার ধোঁয়া বা পরিবেশ থেকে CO₂ সরিয়ে গ্যাসের পরিবর্তে তরল জ্বালানি বা উপযোগী রাসায়নিক পাওয়া যেতে পারে। আমরা যারা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত, এ ধরণের প্রযুক্তিকে একটি game-changer হিসেবে দেখা যায়।
আলোচনায় অধ্যাপক জাবেদ ভবিষ্যতের আরেকটি দিকের কথা বলেছেন – সেটি হলো গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) আগমন এবং তার বিপ্লবাত্মক প্রভাব। তিনি ব্যাখ্যা করেন, অতীতে প্রোটিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো কাজগুলো “ট্রায়াল অ্যান্ড এরর” ভিত্তিক ছিল – অর্থাৎ ল্যাবে হাজারটা মিউটেশন বানিয়ে দেখা হতো কোন পরিবর্তনে উন্নতি হয়। এতে সময় ও পরিশ্রম প্রচুর লাগত। এখন AI এলগরিদম ব্যবহার করে বিপুল ডাটাসেট বিশ্লেষণ করে মুহূর্তেই বলে দেওয়া যায়, অমুক এনজাইমে অমুক অ্যামিনো এসিড বদলালে স্থায়িত্ব বাড়বে কিনা। যা কাজে আগে বছর কেটে যেত, AI তা কয়েক সেকেন্ডে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম। একইভাবে, কোনো অণুজীবের জিনোম এবং বিপাক পথের তথ্যভাণ্ডার AI দিয়ে ঘাঁটলে এমন নতুন উপায় বেরিয়ে আসতে পারে যেগুলো দিয়ে মাইক্রোব যেন CO₂ বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস খেয়ে আমাদের চাহিদামতো প্রডাক্ট তৈরি করে। সুতরাং আগামী ৫-১০ বছরে সিন্থেটিক বায়োলজি ও AI-এর সংযোগ কেমন যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে তা এখন কল্পনা করাও কঠিন। গবেষণার দিকনির্দেশনা পুরো বদলে যেতে পারে—যেসব সমস্যায় শত গবেষক মিলেও অগ্রগতি করতে পারতেন না, AI–এর সহায়তায় সেগুলো হয়তো রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে।
অবশ্য AI ও সিন্থেটিক বায়োলজির এই আশার同时ই অধ্যাপক জাবেদ বাস্তবতার মাটিতেও পা রাখেন। তিনি বলেন, যতদিন না গ্রিন টেকনোলজি খরচের দিক থেকে প্রতিযোগিতা করতে পারছে, ততদিন জীবাশ্ম জ্বালানি একচেটিয়া প্রাধান্য বজায় রাখবে। বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর কাজ হলো প্রযুক্তিগত সমাধান বের করা; কিন্তু এগুলো মাঠে নামাতে অর্থনীতি ও নীতিনির্ধারণী সহায়তা দরকার হবেই। তাই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গবেষণা যেমন চলছে, তেমনি শিল্প-পতি ও সরকারকেও এটিকে সাশ্রয়ী ও বাস্তবায়নযোগ্য করতে এগিয়ে আসতে হবে।
সমষ্টিগতভাবে চিন্তা করলে, অধ্যাপক জাবেদের গবেষণা দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বকে কার্বনমুক্ত করার প্রচেষ্টার অংশ। গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস প্রসার, এবং টেকসই শিল্পউৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা সারা বিশ্ব নিয়েছে, তার সাথে তাঁর কাজ সরাসরি সম্পৃক্ত। একটি উন্নয়নশীল দেশের সন্তান হয়ে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে জ্ঞানসৃজনে অবদান রাখা – এটা আসলে বাংলাদেশের জন্যও গর্বের বিষয়। তাঁর এই ভূমিকা দেখিয়ে দেয় যে যদি সুযোগ ও মেধার সঠিক ব্যবহার হয়, তবে বাংলাদেশের গবেষকরাও জলবায়ু সংকটের মতো জটিল ক্ষেত্রেও পৃথিবীকে পথ দেখাতে পারে।
বহুবিষয়ক জ্ঞানার্জন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা
অধ্যাপক জাবেদের আলোচনার আরেকটি প্রধান আঙ্গিক ছিল বহুমুখী (মাল্টিডিসিপ্লিনারি) জ্ঞান ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এখন আর সেরা গবেষণা হচ্ছে না কোন একক বিষয়ের সীমানার ভেতরে; এক বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অবধারিতভাবে অন্য বিষয়ের জ্ঞান লাগবে। উদাহরণস্বরূপ, জীবপ্রযুক্তির গবেষণাতেও আপনাকে রসায়ন জানতে হবে – যন্ত্রের বিশ্লেষণ পদ্ধতি বুঝতে অ্যানালাইটিক্যাল কেমিস্ট্রি শিখতে হবে, ফলাফলের statistics করতে গণিত ও পরিসংখ্যান লাগবে, এমনকি জটিল ডাটা সামলাতে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বা মেশিন লার্নিং জানতে হবে। সুতরাং যারা শুধু নিজের বিষয়ের বই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে, তারা পিছিয়ে পড়বে। অধ্যাপক জাবেদ পরামর্শ দেন যে নিজের মূল দক্ষতার ক্ষেত্র ঠিক রেখে প্রয়োজনমতো অন্যান্য শাখার গুরুত্বপূর্ণ টুলগুলো শেখা উচিত। যেমন, তিনি নিজে মাইক্রোবায়োলজি পটভূমি নিয়ে পরে সিন্থেটিক বায়োলজিতে এসেছেন, যেখানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটেশনাল বায়োলজি – নানা বিষয়ের জ্ঞান সমন্বয় করতে হয়েছে। তাঁর ছাত্রদেরও তিনি বলেন, প্রোটিন বা মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিখলে তা দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে শিল্পবিজ্ঞান – সবখানেই কাজ করা যাবে। আবার কেউ যদি সমাজবিজ্ঞানে গবেষণা করেন, তাকেও জরিপের ডেটা বিশ্লেষণে পরিসংখ্যান বা মেশিন লার্নিং শিখতে হতে পারে। ২১শ শতকের গবেষককে বহুমাত্রিক হতে হবে – জ্ঞানের সীমানাগুলো পার হয়ে যেতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মেধা আছে কিন্তু অনেকে একটা বিষয়ের বাইরে বের হতে চায় না বা ভয় পায়। এই সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে পারলে তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভালো করবেন।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও অধ্যাপক জাবেদ অত্যন্ত উৎসাহী। তিনি নিজে মালয়েশিয়া ও চীনে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, বৈশ্বিক গবেষক সমাজের সাথে সংযুক্ত আছেন এবং বাংলাদেশের অনেক তরুণকেও বিদেশে সুযোগ খুঁজতে উৎসাহিত করেন। চীনে কাজ করার সময় তিনি দেখেছেন সেখানে বড় বড় গবেষণা দল (group) একসাথে অনেক প্রকল্প চালায়, যেখানে বিভিন্ন দেশের ও দক্ষতার লোক একত্রে কাজ করে ফলাফল তৈরি করছে। বিদেশী গবেষকদের ইংরেজিতে দক্ষতা চীনা দলগুলো কাজে লাগাচ্ছে এবং বিনিময়ে বিদেশীরা পাচ্ছেন সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও তত্ত্বাবধানের সুবিধা – এ যেন জয়-জয় পরিস্থিতি। বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদেরও এমন দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া দরকার। তিনি নিজে চীনের ল্যাবে প্রথম বিদেশি ছিলেন এবং সফলভাবে দলে অবদান রেখে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন, যা প্রমাণ করে যে যোগ্যতা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের স্থান করে নেওয়া সম্ভব।
প্রসঙ্গত, অধ্যাপক জাবেদ বিদেশে থেকেও দেশে গবেষণা সহযোগিতা অব্যাহত রাখছেন। তিনি জানিয়েছেন যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের কিছু শিক্ষার্থীর সাথে তিনি গবেষণা করছেন; তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যে তাঁর সহযোগিতায় গবেষণাপত্র প্রকাশও করেছে। এর মানে, দেশে থাকা মেধাবী তরুণরা চাইলে প্রবাসী বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করে আন্তর্জাতিক মানের কাজ করতে পারেন। দরকার শুধু যোগাযোগের সেতুটি তৈরি করা। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে বিশ্বমানের বিশেষজ্ঞদের কাছে পৌঁছানো খুব কঠিন নয় – একটু ইমেইল করা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সংযোগ ঘটিয়েই আলোচনা শুরু করা যায়।বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও অধ্যাপকরা তো আছেনই; তদুপরি অনেক বিদেশি অধ্যাপকরাও উদীয়মান দেশের ছাত্রদের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন, যদি তারা আগ্রহ ও নিষ্ঠা দেখতে পান। কাজেই আমাদের ছাত্রদের সঙ্কোচ ও আত্মবিশ্বাসের অভাব দূর করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের জায়গা করে নিতে সাহসী হতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আরেকটি বড় শিক্ষা হলো গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করা। অধ্যাপক জাবেদের সাফল্য প্রমাণ করে যে সঠিক যোগাযোগ থাকলে এবং যোগ্যতা অর্জন করলে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা অসম্ভব নয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সম্ভব হলে বিদেশে অধ্যয়ন ও যৌথ গবেষণা প্রকল্পে অংশগ্রহণকে সহজ করুক, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ছাত্র–শিক্ষকদের পাঠাক। এভাবে বৈশ্বিক জ্ঞান–আদান–প্রদান বাড়লে আমাদের নিজের ব্যবস্থার দুর্বলতা কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে। যে যন্ত্রপাতি বা বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বাংলাদেশে নেই, তা হয়তো বিদেশের কারও সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে অর্জন করা সম্ভব। ক্রস–ডিসিপ্লিন এবং ক্রস–কালচারাল সহযোগিতা তাই আমাদের মতো সম্পদ–সীমিত দেশের জন্য কোনো বিলাসিতা নয়, বরং টিকে থাকার কৌশল।
ড. মো: জাবেদ হোসেন এর সাক্ষাৎকারের ভিডিওটি ইউটিউবে নিম্নের লিংক এ দেখুন: 👇👇👇
উপসংহার
অধ্যাপক হোসাইনএম জাবেদের জীবনের গল্পটি সন্দ্বীপের মাটির ঘর থেকে বৈশ্বিক গবেষণাগারের দোরগোড়া পর্যন্ত বিস্তৃত – এক কথায় এটি সংগ্রাম ও সাফল্যের এক অনুপম গাথা। এই যাত্রায় রয়েছে প্রচলিত পথে বাধা পেয়ে বিকল্প রাস্তা খুঁজে নেওয়ার দৃষ্টান্ত, রয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যেও জ্ঞান অর্জনের নেশায় অবিচল থাকার উদাহরণ। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা একটি বড় শিক্ষা নিতে পারে: স্বপ্ন বড় রাখো, কিন্তু সে স্বপ্নপূরণে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে কেউ যেন কমতি না থাকে। সন্দ্বীপের যে ঘরের ভিটে নদীতে হারিয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে উঠে আসা একটি ছেলে আজ বিশ্ববিজ্ঞানীর কাতারে দাঁড়িয়ে আছেন – এর চেয়ে বড় প্রেরণা তরুণদের জন্য আর কী হতে পারে!
অধ্যাপক জাবেদের কথোপকথনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশের তরুণদের মেধা আছে এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনাও আছে, তবে তার জন্য দরকার মনে সাহস ও মনে জেদ। গবেষণাকে ভীতিকর কিছু না ভেবে জানার আনন্দ হিসেবে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে নিজেদের প্রশ্ন খুঁজতে, নিজ থেকে পড়তে, নিজ থেকে initiative নিতে। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে যে স্থবিরতা আছে, তা দূর করতে নবীনদেরকেই সক্রিয় হতে হবে – শিক্ষক বা সরকারের দিকে চেয়ে সময় নষ্ট করলে ব্যক্তিগত উন্নতি অধরাই থেকে যাবে। অধ্যাপক জাবেদ এদেশের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে সেই আহ্বানটিই জানিয়েছেন: “নিজের পরিবর্তন নিজেকেই করতে হবে” – বাহ্যিক পরিবেশ প্রতিকূল হলেও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে যাও।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৃহত্তর সংকট মোকাবিলায়ও তিনি দেখিয়েছেন জ্ঞানই শক্তি। বাংলাদেশের মতো দেশ জলবায়ু বিপর্যয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে, কিন্তু সেই বাংলাদেশের এক বিজ্ঞানী যখন কার্বন নিঃসরণ কমাতে নতুন পথের সন্ধান দেন, তখন বোঝা যায় জ্ঞানচর্চার বৈশ্বিক প্রভাব কত দূর যেতে পারে। নতুন প্রজন্ম যদি অধ্যাপক জাবেদের দেখানো পথে চলতে পারে – লক্ষ্য স্থির রেখে অক্লান্ত পরিশ্রম, বহুমুখী দক্ষতা অর্জন এবং বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মানসিকতা – তাহলে আমরাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেতে পারি।
পরিশীলিত প্রমিত বাংলায় রচিত এই লিখনীটি একাধারে গল্প ও শিক্ষার সংমিশ্রণ। গল্পটি একজন মানুষের সাফল্যের, আর শিক্ষাটি সবার – যদি তিনি পারেন, তুমি কেন পারবে না? সন্দ্বীপের মাটিতে পা রেখে আকাশপানে চেয়েছিলেন হোসাইনএম জাবেদ; আজ তাঁর সাফল্যের আকাশছোঁয়া দৃষ্টান্ত অসংখ্য তরুণের胸中 নতুন আকাশের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলুক – এই প্রত্যাশা রইল।
অনুষ্ঠানটিতে উপস্থাপক ছিলেন বিজ্ঞানী অর্গ এর ভলেন্টিয়ার তাহসিন আহমেদ সুপ্তি। অনুষ্ঠানটি ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ এ অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। সার্বিকভাবে অনুষ্ঠানটি সমন্বয় করার জন্য বিজ্ঞানী অর্গ এর পক্ষ থেকে মহিউদ্দিন কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।

Leave a comment