আমরা যখন ইন্টারনেটের কথা ভাবি, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্যাটেলাইট, তারহীন যোগাযোগ আর ‘ক্লাউড’-এর ধোঁয়াটে কোনো ধারণা। কিন্তু বাস্তবতা অনেক বেশি ভিন্ন এবং আশ্চর্যজনক। পৃথিবীর প্রায় ৯৫ শতাংশ ডেটা আদান–প্রদান হয় মহাসাগরের তলদেশে শুয়ে থাকা কাঁচের সূক্ষ্ম তন্তুর ভেতর দিয়ে, যা একত্রে বাঁধা বিশালাকার সাবমেরিন কেবলের ভেতর দিয়ে মহাদেশ থেকে মহাদেশে ছুটে যায়। চুলের থেকেও পাতলা সেই ফাইবার অপটিক স্ট্র্যান্ডগুলোই প্রতিদিন ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক লেনদেন বহন করে, আন্তর্জাতিক ভিডিও কনফারেন্স চালু রাখে, আর শেয়ার বাজারের ক্রয়–বিক্রয় থেকে শুরু করে আমাদের সাধারণ চ্যাট পর্যন্ত সবকিছুকে সচল রাখে। এই কেবলগুলো যদি এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়, পৃথিবীর অর্থনীতি ও যোগাযোগ যেন শ্বাস বন্ধ করে ফেলবে।
এই অবকাঠামো আমাদের দৃষ্টির বাইরে, কিন্তু ক্ষমতায় বিদ্যুতের লাইনের মতোই অপরিহার্য, এমনকি অনেক দিক থেকে আরও বেশি কৌশলগত। তবু এর মালিকানা হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির হাতে। গুগল, মেটা, অ্যামাজন ও মাইক্রোসফট—এই প্রযুক্তি জায়ান্টরা নিজেদের প্রাইভেট কেবল নেটওয়ার্ক গড়তে ইতিমধ্যেই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তারা জানে, যিনি এই অদৃশ্য রাস্তাগুলোর মালিক, তিনিই ভবিষ্যতের তথ্য ও যোগাযোগ প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখবেন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে একগুচ্ছ নতুন নিয়ম, যা এই গোপন মেরুদণ্ডকে সুরক্ষিত রাখতে তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন (FCC) এখন থেকে সাবমেরিন কেবল স্থাপনের প্রকল্প দ্রুত অনুমোদন দেবে, তবে নিরাপত্তা যাচাই হবে আরও কঠোর। বিশেষ করে যেসব কোম্পানি বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত, যেমন চীনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই—না হলে অনুমোদন মিলবে না।
কারণ কেবল নষ্ট করা, নজরদারি চালানো বা তথ্য চুরি করা মোটেই কঠিন নয়। কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস, কখনো বা অনিচ্ছাকৃতভাবে—যেমন কোনো জাহাজের নোঙরের ধাক্কা—একটি লাইনে আঘাত করলেই তথ্যপ্রবাহ থমকে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো ইতিমধ্যেই এসব কেবলের মানচিত্র তৈরি করছে, তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে, আর নতুন রুটে বিনিয়োগ করছে। চীন গত কয়েক বছরে এই খাতে বিশাল উদ্যোগ নিয়েছে, যা ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নতুন মাত্রা তৈরি করেছে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এদের অস্তিত্ব অনুভব না করলেও, সাবমেরিন কেবল ছাড়া আধুনিক সভ্যতা চলতে পারবে না। এগুলো শুধু তথ্য বহন করে না, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, কূটনীতি, এমনকি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সেতুবন্ধন হিসেবেও কাজ করে। মহাসাগরের গভীরে শুয়ে থাকা এই নিঃশব্দ তারগুলো পৃথিবীর অর্থনীতির ধুকপুকানি ধরে রাখে—কিন্তু একই সঙ্গে এগুলোই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কৌশলগত সম্পদগুলোর একটি।
আগামী দিনে এই কেবলগুলোর গুরুত্ব আরও বাড়বে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক না কেন, উচ্চ ক্ষমতার, কম বিলম্বিত, সাশ্রয়ী ডেটা পরিবহনের জন্য সাগরতলের কেবলের বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিকম্প কিংবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে ঝুঁকি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে সাইবার নিরাপত্তা ও ভৌত নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি জায়ান্ট ও রাষ্ট্রগুলো এখন বুঝতে পারছে, এই অবকাঠামো রক্ষা করা মানেই নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রক্ষা করা।
অদৃশ্য এই নেটওয়ার্কের শক্তি ও দুর্বলতা দুই–ই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বয়ে আনে। শক্তি এই কারণে যে, এটি মহাদেশ ও সংস্কৃতিকে মুহূর্তে যুক্ত করতে পারে, জ্ঞানের প্রবাহকে অবাধ করে দেয়। দুর্বলতা এই কারণে যে, একটি মাত্র ফাইবারের বিচ্ছেদ বিশ্বব্যাপী অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে। ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত সুরক্ষা ও স্বচ্ছ নীতিমালা—সব মিলিয়ে এই মেরুদণ্ডকে সুরক্ষিত রাখা এখন সময়ের দাবি।
আমরা হয়তো কখনো সেই মহাসাগরের তলদেশের অন্ধকারে নামব না, কিংবা দেখব না এই কেবলগুলোর মাইলের পর মাইল বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। কিন্তু প্রতিবার যখন আমরা একটি বার্তা পাঠাই, একটি ভিডিও চালাই বা একটি অনলাইন লেনদেন সম্পন্ন করি, তখনই আমরা এই অদৃশ্য সেতুর উপর দিয়ে চলছি—যার গতি, স্থায়িত্ব আর নিরাপত্তার উপর নির্ভর করছে পুরো পৃথিবীর ডিজিটাল প্রাণপ্রবাহ। ভবিষ্যতের ভূরাজনীতি ও প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় লড়াই হয়তো এই নীরব, লুকিয়ে থাকা তারের জন্যই হবে।
Leave a comment