নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ |
বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার চেষ্টা অনেকটা একটা গোলকধাঁধার ভিতরে দৌড়ে বেড়ানোর মতো। আমরা প্রতিনিয়ত শুনি “বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত,” “গবেষণায় দেখা গেছে,” কিংবা “তথ্য-নির্ভর বিশ্লেষণ।” কিন্তু এসবের পেছনে যে দার্শনিক কাঠামো কাজ করে, তা নিয়ে আমাদের চিন্তা করার সুযোগ হয় খুব কম। স্টিভেন গিমবেলের লেখা Introduction to the Scientific Method বইটি এই অভাব পূরণে এক অনন্য সংযোজন। এটি শুধুমাত্র বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত দিক ব্যাখ্যা করে না, বরং বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত যুক্তি ও দর্শনের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। যারা বিজ্ঞানের প্রাত্যহিক প্রয়োগ ছাড়াও এর প্রজ্ঞা ও নৈতিকতা অনুধাবন করতে চান, তাদের জন্য বইটি একটি চিন্তার জানালা খুলে দেয়।
বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষাকে আমরা প্রায়শই একটি রুটিন পরীক্ষাভিত্তিক বিষয় হিসেবে দেখি। সূত্র মুখস্থ করা, পরীক্ষার জন্য ব্যাখ্যা লেখা, কিংবা অঙ্ক কষার চর্চা—এসবের মাঝেই বিজ্ঞান শিক্ষার পাঠ সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। অথচ বিজ্ঞান মানে কেবল তথ্য সংগ্রহ বা প্রযুক্তি উদ্ভাবন নয়; এটি একটি চিন্তার পদ্ধতি। গিমবেল আমাদের শেখান যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এক ধরনের দর্শন, যা মানুষকে বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শেখায় এবং প্রতিনিয়ত নিজের জ্ঞানকে যাচাই করতে উদ্বুদ্ধ করে।
গিমবেল বইয়ের শুরুতেই প্রশ্ন তোলেন: কীভাবে আমরা জানি যে কিছু সত্য? একটি বক্তব্যকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে আমাদের কি কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত? প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের সময় থেকে শুরু করে গ্যালিলিও, নিউটন, হিউম, কার্ল পপার, থমাস কুন, এমনকি ফেমিনিস্ট এপিস্টেমোলজিস্টদের চিন্তাধারাও আলোচিত হয়েছে এই বইয়ে। এই আলোচনার মাধ্যমে পাঠক বুঝতে পারেন যে বিজ্ঞান একটি অভিন্ন, স্থির পদ্ধতির নাম নয়; বরং এটি একটি চলমান বিতর্ক, একটি চিন্তার চর্চা।
স্টিভেন গিমবেল একদিকে যেমন যুক্তি এবং প্রমাণের গুরুত্ব বোঝান, অন্যদিকে তেমনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেন। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন একটি পরীক্ষা চালাই, তখন আমাদের নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা থাকে, কিন্তু সেই নিরপেক্ষতাও আদৌ কি সম্ভব? আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি পরীক্ষার কাঠামোও প্রভাব ফেলে আমাদের সিদ্ধান্তে। গিমবেল এইসব জটিলতা সামনে এনে আমাদের বিজ্ঞানকে ভিন্ন চোখে দেখতে শেখান—একটি জীবন্ত, বিকশিত হওয়া ধারণা হিসেবে।
বইটি একটি মৌলিক প্রশ্নের মধ্য দিয়ে এগোয়—বিজ্ঞান কি সত্যকে অনাবৃত করে, নাকি শুধু একটি কার্যকর ব্যাখ্যা তৈরি করে? অনেক পাঠকের জন্য এটি একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন হতে পারে। আমরা বরাবরই ধরে নিই বিজ্ঞান মানেই সর্বোচ্চ সত্যের খোঁজ। কিন্তু গিমবেল দেখান, বিজ্ঞান অনেক সময়ই নির্ভর করে ‘সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা’-র ওপর, যা ভবিষ্যতে ভেঙেও যেতে পারে। নিউটনের গ্র্যাভিটির ধারণা যেমন এক সময় সঠিক বলে মনে হয়েছে, পরে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব সেটিকে নতুন আলোয় ব্যাখ্যা করেছে। বিজ্ঞান এই পরিবর্তনশীলতাকে নিজের শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে, এটিই তার সৌন্দর্য।
গিমবেল তাঁর আলোচনায় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ধারণা এবং কুনের ‘পারাডাইম শিফট’ তত্ত্বও তুলে ধরেন। বিজ্ঞান একটি রৈখিক অগ্রগতির ফল নয়, বরং এটি একটি ধারাবাহিক ‘বিশ্বাস পরিবর্তনের’ ইতিহাস। কখনো নতুন প্রমাণ, কখনো দর্শনের পরিবর্তন, আবার কখনো রাজনৈতিক বা সামাজিক চাহিদা একটি বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক ধারা ভেঙে নতুন পথ দেখায়। এই ধারণা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিজ্ঞান এক ধরনের সমাজ-সচেতন চর্চা, এটি একা একা ঘটে না।
এই বইটি পড়তে পড়তে একজন পাঠক নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন—আমার চারপাশের বিজ্ঞাপন, স্বাস্থ্য পরামর্শ, কিংবা সংবাদে যে বৈজ্ঞানিক তথ্য উঠে আসে, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? বৈজ্ঞানিক ভাষা ব্যবহার মানেই কি প্রামাণিকতা? গিমবেলের লেখার সৌন্দর্য এখানেই—তিনি পাঠকের মনে এমন প্রশ্নের উদ্রেক ঘটান, যার উত্তর খোঁজাই বিজ্ঞানের প্রকৃত চর্চা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বইটির গুরুত্ব আরও গভীর। কারণ আমাদের সমাজে এখনও বিজ্ঞানকে এক ধরনের ‘নির্বিকার সত্য’-এর উৎস হিসেবে দেখা হয়। বিজ্ঞানীরা যা বলেন, সেটাই চূড়ান্ত—এমন মনোভাব বিদ্যমান। অথচ গিমবেল দেখান যে বিজ্ঞানী হওয়া মানে নিজে সন্দেহপ্রবণ থাকা, নিজের তত্ত্বের দুর্বলতা খুঁজে বের করা, এবং যুক্তির আলোকে সত্যকে পর্যালোচনা করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার কাঠামোকে আরও উন্মুক্ত ও জবাবদিহিমূলক করতে পারে।
স্টিভেন গিমবেলের লেখায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার যুক্তিনির্ভরতা এবং সাধারণ ভাষার ব্যবহারে দক্ষতা। দর্শনের মতো জটিল বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি কখনো পাঠককে ভয় পাইয়ে দেন না। বরং উদাহরণ, রসিকতা, এবং বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া প্রসঙ্গের মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞান-দর্শনের আলোচনা করে তুলেছেন প্রাণবন্ত। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে দর্শন কেবল দার্শনিকদের জন্য নয়, একজন সাধারণ মানুষেরও চিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
বইটি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শিক্ষক, বিজ্ঞান লেখক, এমনকি সাংবাদিকদের জন্যও এটি এক অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক পঠন। কারণ বৈজ্ঞানিক তথ্য পরিবেশনের আগে সেই তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও ভিত্তি বুঝতে পারা অত্যাবশ্যক। সংবাদে “নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে…” শিরোনাম দিয়ে যে সংবাদ পরিবেশন করা হয়, তার বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন করার জন্য এই বইয়ের দর্শন-ভিত্তিক চর্চা অত্যন্ত প্রয়োজন।
অবশেষে বলা যায়, Introduction to the Scientific Method কেবল একটি বই নয়, এটি আমাদের চিন্তার পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি সাহসী আহ্বান। এটি পাঠককে শেখায়—কীভাবে সন্দেহ করতে হয়, কীভাবে যুক্তিকে তীক্ষ্ণ করতে হয়, এবং কীভাবে জ্ঞানের পথচলায় নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখতে হয়। গিমবেলের চোখ দিয়ে আমরা বিজ্ঞানের দিকে তাকালে দেখি এটি কেবল একটি পরীক্ষাগার নয়, এটি একটি মানবিক অভিযাত্রা—যেখানে সত্যকে আবিষ্কার নয়, বরং তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
আমরা যারা বাংলাদেশে একটি বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখি, তাদের জন্য এই বইটি হতে পারে একটি দিকনির্দেশনা। কারণ বিজ্ঞান শুধু আবিষ্কারের গল্প নয়, এটি চিন্তা ও যুক্তির অবিরাম অনুশীলন। আর এই অনুশীলন শুরু হয় তখনই, যখন আমরা প্রশ্ন করি—”আমি যা জানি, তা কি সত্যিই সত্য?”

Leave a comment