পদার্থবিদ্যামহাকাশ

মহাকাশে কি শব্দ শোনা যায়?

Share
Share

“মহাকাশে কেউ তোমার চিৎকার শুনতে পাবে না।”
বিশ্বখ্যাত সায়েন্স-ফিকশন হরর মুভি Alien-এর এই বিখ্যাত স্লোগান আমাদের মনে করিয়ে দেয় মহাকাশ কতটা শূন্য। সত্যিই কি তাই? মহাকাশ কি পুরোপুরি নিরব? একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে, গল্পটা ততটা সরল নয়।

শব্দ কীভাবে কাজ করে?

শব্দ আসলে হলো কম্পন, যা কোনো মাধ্যমের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। যেমন এখন যদি আপনি গান শুনছেন, তা আপনার কম্পিউটার বা স্পিকারের চুম্বকের মাধ্যেমে বাতাসে কম্পন তৈরি করে, যা আপনার কানে পৌঁছে মস্তিষ্কে অনূদিত হয় সুর হিসেবে। শব্দের জন্য প্রয়োজন হয় মাধ্যম—হোক তা বাতাস, জল বা কঠিন বস্তু।

এখন প্রশ্ন হলো, যদি কোথাও কোনো মাধ্যম না থাকে—যেমন পুরোপুরি খালি শূন্যতা—তাহলে শব্দ কীভাবে যাবে? এ কারণেই বলা হয় মহাকাশে শব্দ নেই। কিন্তু, আসলে মহাকাশ পুরোপুরি খালি নয়!

মহাকাশের শূন্যতা কতটা শূন্য?

পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ল্যাবরেটরির ভ্যাকুয়াম চেম্বারেও এক সেন্টিমিটারে প্রায় এক ট্রিলিয়ন কণিকা থাকে। অথচ মহাকাশে, বিশেষ করে গ্রহগুলোর মাঝামাঝি স্থানে, এক সেন্টিমিটারে মাত্র কয়েক ডজন কণিকা পাওয়া যায়! তার মানে পৃথিবীর বাতাসের তুলনায় লক্ষ লক্ষ গুণ পাতলা।

তার চেয়েও দূরত্বের জায়গা—তারাদের মাঝের “ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম”—আরও ফাঁকা। সেখানে গড়ে এক কিউবিক মিটারে মাত্র ১০০টি কণিকা পাওয়া যায়। আর গ্যালাক্সির মাঝখানে, “ইন্টারগ্যালাকটিক স্পেস”-এ তো অবস্থা আরো করুণ—এক মিটারে মাত্র ১টি কণিকা!

এমন ফাঁকা জায়গায় চিৎকার করলেও শব্দ পৌঁছাবে না। তবে মহাকাশের সব জায়গা সমান নয়। কোনো কোনো অঞ্চলে—যেমন নেবিউলা বা ধুলো ও গ্যাসের ঘন মেঘের মধ্যে—কণিকার ঘনত্ব অনেক বেশি হয়। যেমন, বিখ্যাত ওরিয়ন নেবিউলায় এক সেন্টিমিটারে প্রায় ১০,০০০ কণিকা থাকে, এবং বার্নার্ড ৬৮ নামক মলিকিউলার ক্লাউডে তা এক মিলিয়ন পর্যন্ত হতে পারে।

মহাকাশে কোথায় শব্দ সৃষ্টি হয়?

মহাকাশে যদি সত্যিই শব্দ তৈরি হয়, তাহলে সেটা সবচেয়ে বেশি হয় বিশাল মহাজাগতিক বিস্ফোরণের সময়—যেমন সুপারনোভা। যখন কোনো বিশাল তারা বিস্ফোরিত হয়, তখন প্রচণ্ড গতিতে ছিটকে যাওয়া বস্তুপুঞ্জ চারপাশের গ্যাস ও ধুলোর সঙ্গে ধাক্কা খায়। এই ধাক্কা থেকে তৈরি হয় শক ওয়েভ—যা এক ধরনের শব্দতরঙ্গ।

এই শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে প্রতি সেকেন্ডে ১০ কিলোমিটার গতিতে! পৃথিবীতে শব্দের গতি যেখানে প্রতি সেকেন্ডে ০.৩৩ কিলোমিটার, সেখানে মহাকাশের এই নেবিউলায় শব্দ ছুটছে আমাদের কল্পনার সীমানার বাইরে!

শব্দ ছাড়া পৃথিবী হতো না?

অদ্ভুত মনে হলেও, মহাকাশে শব্দের অস্তিত্ব আমাদের অস্তিত্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যখন কোনো মলিকিউলার ক্লাউড (ধুলো ও গ্যাসের মেঘ) সংকুচিত হয়ে একটি নতুন নক্ষত্র তৈরি করে, তখন তার চারপাশে একটি ডিস্কের মতো গঠন তৈরি হয়। সেই ডিস্কের মধ্যেও শব্দতরঙ্গ চলে। শব্দ না থাকলে, সেই গ্যাস আর ধুলো কখনো একত্রিত হয়ে গ্রহ তৈরি করতে পারত না। তাহলে পৃথিবীও হতো না!

অতএব, শব্দ শুধু আমাদের কানে গান পৌঁছায় না, শব্দই আমাদের জন্মের জন্যও এক ধরনের নীরব ভূমিকা রেখেছে।

শেষ কথা

হ্যাঁ, মহাকাশ বেশিরভাগ জায়গায় নিশ্চুপ। তবে ঠিক জায়গায় যদি আপনি যথেষ্ট জোরে চিৎকার করতে পারেন, আর যদি যথেষ্ট পরিমাণ কণিকা থাকে, তাহলে আপনার চিৎকার সত্যিই শোনা যেতে পারে—অবশ্য সেটা মানব কানে নয়, বিশাল মহাজাগতিক কান দিয়ে!

শব্দের এমন রহস্যময় ভূমিকা মহাকাশকে আরো বিস্ময়কর করে তোলে। আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে শব্দ এত গভীরভাবে জড়িয়ে আছে, তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
পদার্থবিদ্যাপরিবেশ ও পৃথিবী

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের ঘূর্ণন ও আকৃতি বদলের ইঙ্গিত

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র সম্পর্কে যুগান্তকারী আবিষ্কার আবিষ্কার করুন - এর আশ্চর্যজনক ঘূর্ণনশীল...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

মঙ্গলগ্রহে মানুষ কতদিন টিকে থাকতে পারে? নতুন গবেষণা বলছে – সর্বোচ্চ ৪ বছর!

নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে মহাজাগতিক বিকিরণের ঝুঁকির কারণে মানুষ সর্বোচ্চ ৪...

পদার্থবিদ্যামহাকাশ

অদৃশ্য মহাবিশ্ব: যে ৯৫ শতাংশ এখনো অজানা

বাংলায় অন্ধকার মহাবিশ্বের রহস্য অন্বেষণ করুন — অন্ধকার পদার্থ এবং অন্ধকার শক্তি...

পদার্থবিদ্যামহাকাশ

নিঃশব্দ আগুনের নৃত্য: মহাকাশে এক অচেনা শিখার গল্প

মহাকাশের ওজনহীন পরিবেশে আগুন কীভাবে আচরণ করে তা আবিষ্কার করুন। এই গল্পটি...

পদার্থবিদ্যাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

বিজ্ঞান ভুল পথে? কোয়ান্টাম বলছে ‘হ্যাঁ’—না কি?

কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা কি আমাদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে? নোবেল বিজয়ী জেরার্ড হুফ্ট কোয়ান্টাম...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.