বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে আমরা প্রায়ই এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হই, যেখানে কোনো প্রাণী সূর্যালোক থেকে নিজের খাদ্য তৈরি করছে। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে এই চমকপ্রদ কাহিনি অনেকটা সত্যি করে তুলেছে এক অনন্য সামুদ্রিক প্রাণী—এলিসিয়া ক্লোরোটিকা নামের এক সবুজ সমুদ্রশামুক। দেখতে অনেকটা পাতার মতো এই প্রাণীটিকে বলা হয় “সোলার-পাওয়ার্ড সি স্লাগ।” প্রাণীদের জগতে এটি এক ব্যতিক্রম, কারণ এরা সূর্যের আলো ব্যবহার করে ঠিক উদ্ভিদের মতো শক্তি উৎপাদন করতে পারে।
কিন্তু এরা আসলে নিজেরা গাছের মতো জন্মগতভাবে ফটোসিন্থেসিস করতে পারে না। এর রহস্য লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত অভিযোজন প্রক্রিয়ায়, যার নাম “ক্লেপ্টোপ্লাস্টি।” সমুদ্রশামুকটি যখন Vaucheria litorea নামের শৈবাল খায়, তখন শুধু শৈবালের কোষ ভাঙে না, বরং শৈবালের ভেতরে থাকা ক্লোরোপ্লাস্ট নামক আলোক-সংবেদনশীল অঙ্গাণুগুলোকে নিজের শরীরের কোষে ধরে রাখে। এভাবে শামুকের দেহে একপ্রকার “ধার করা” সূর্যালোক কারখানা কাজ শুরু করে, যা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত শামুকটিকে বাড়তি শক্তি জোগায়।
এই অভিযোজনের তাৎপর্য গভীর। প্রাণীরা সাধারণত উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল, কারণ উদ্ভিদই সূর্যের আলো ব্যবহার করে শর্করা তৈরি করে এবং খাদ্যশৃঙ্খলের গোড়ায় শক্তি সরবরাহ করে। অথচ এখানে এক প্রাণী নিজেই সূর্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে পারছে। প্রাণী ও উদ্ভিদের সীমানা যেখানে এতটা স্পষ্ট বলে আমরা ভেবেছিলাম, সেখানে এমন উদাহরণ পুরো সংজ্ঞাটাকেই ঝাপসা করে দেয়।
এলিসিয়া ক্লোরোটিকা একমাত্র উদাহরণ নয়। সামুদ্রিক আরও কিছু শামুক প্রজাতি একই কৌশল ব্যবহার করে, তবে তারা এতটা দক্ষ নয়। বেশিরভাগ শামুক কয়েক দিনের মধ্যেই শৈবালের ক্লোরোপ্লাস্ট নষ্ট করে ফেলে, ফলে ফটোসিন্থেসিস টিকিয়ে রাখতে পারে না। এলিসিয়া ক্লোরোটিকা এই দিক থেকে এক বিশেষ প্রাণী, কারণ এটি মাসের পর মাস “সবুজ” থেকে যায়।
শুধু শামুক নয়, পৃথিবীর আরও কিছু প্রাণী সূর্যের আলো থেকে শক্তি নেওয়ার অদ্ভুত উপায় উদ্ভাবন করেছে। প্রবাল ও সামুদ্রিক অ্যানেমোনেরা নিজের টিস্যুর ভেতর ক্ষুদ্র শৈবাল “জুকজ্যানথেলি” পোষে। এরা আলো থেকে খাদ্য তৈরি করে এবং প্রবালকে শেয়ার করে দেয়। আবার প্রবালও তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় আর পুষ্টি জোগায়। এই সহাবস্থান এতটাই সফল যে প্রবালপ্রাচীর আজ পৃথিবীর সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যময় আবাসস্থল।
আমরা এমনকি মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যেও এই কৌশলের আভাস পাই। উত্তর আমেরিকার স্পটেড সালাম্যান্ডারের ডিমের ভেতরে বিশেষ ধরনের শৈবাল বাস করে। ডিমের ভেতর শৈবালগুলো সূর্যের আলো থেকে অক্সিজেন ও শক্তি তৈরি করে, যা ছোট্ট ভ্রূণকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। প্রাণীজগতের ইতিহাসে এটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত, কারণ এখানে ফটোসিন্থেসিসের সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে সরাসরি মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরের ভেতরে।
আরেকটি বিতর্কিত উদাহরণ হলো মটর এফিড বা পি এফিড নামের এক ক্ষুদ্র পতঙ্গ। গবেষণায় দেখা গেছে, এরা দেহে বিশেষ ধরনের রঞ্জক পদার্থ—ক্যারোটিনয়েড ব্যবহার করে সূর্যালোক থেকে সামান্য শক্তি উৎপন্ন করতে সক্ষম। যদিও এর প্রমাণ এখনো সীমিত এবং বিতর্কিত, তবুও এটি সূর্যালোক-নির্ভর প্রাণী অভিযোজনের এক ব্যতিক্রম উদাহরণ।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে—যদি সূর্যের আলো থেকে খাদ্য পাওয়া এত উপকারী হয়, তবে আরও বেশি প্রাণী কেন এই পথ অনুসরণ করেনি? উত্তরটি লুকিয়ে আছে প্রাণীর জটিল শারীরবৃত্তীয় চাহিদায়। প্রাণীর কোষে ফটোসিন্থেসিসের জন্য যে সূক্ষ্ম কাঠামো ও জিনগত সমন্বয় প্রয়োজন, তা সহজে গড়ে ওঠে না। উদ্ভিদের কোটি বছরের বিবর্তনের ফল এই দক্ষতা, যা প্রাণীদের জন্য নতুনভাবে গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। ফলে কেবল অল্প কিছু প্রাণী বিশেষ কৌশলে, হয় শৈবাল পোষে, নয়তো শৈবালের অংশ চুরি করে, সূর্যের শক্তি ব্যবহার করতে শিখেছে।
এখানে এক ধরনের দার্শনিক প্রশ্নও উঠে আসে। আমরা প্রাণী আর উদ্ভিদকে আলাদা দুনিয়ার বাসিন্দা ভেবে এসেছি। কিন্তু এলিসিয়া ক্লোরোটিকা বা প্রবালের মতো প্রাণী আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতির সীমানা আসলে এতটা শক্ত নয়। জীবন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল আবিষ্কার করেছে বেঁচে থাকার জন্য, আর সূর্যালোক ব্যবহারের এই অদ্ভুত উপায়গুলো তারই ব্যতিক্রমী নিদর্শন।
অবশেষে, এই আলোচনার একটি প্রাসঙ্গিক সামাজিক দিকও আছে। আজ যখন মানবসভ্যতা টেকসই শক্তির খোঁজে ব্যস্ত, তখন প্রকৃতি আমাদের সামনে এক অদ্ভুত অনুপ্রেরণা হাজির করছে। প্রাণীরা যেভাবে সীমিত হলেও সূর্যালোক ব্যবহার করে শক্তি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শক্তির সবচেয়ে মৌলিক উৎস সূর্য। হয়তো একদিন জীববিজ্ঞান ও প্রকৌশলের মেলবন্ধনে মানুষও এই প্রাকৃতিক কৌশলগুলোর অনুসরণ করে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবে।
সূর্যালোক থেকে শক্তি সংগ্রহকারী প্রাণীদের গল্প তাই শুধু বিজ্ঞানের কৌতূহল নয়, বরং টিকে থাকার চিরন্তন সংগ্রামেরই প্রতিফলন। এলিসিয়া ক্লোরোটিকা নামের ক্ষুদ্র শামুকটি আমাদের শেখায়, জীবনকে সংজ্ঞায়িত করা কোনো কঠোর বাক্সবন্দি নিয়ম নয়, বরং সৃজনশীল অভিযোজনের এক অবিরাম যাত্রা। আর সেই যাত্রাতেই লুকিয়ে আছে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় বিস্ময়—বেঁচে থাকার শিল্প।
 
                                                                                                                                                 
                                                                                                     
                            
 
                             
                                 
 
			         
 
			         
 
			         
 
			         
 
			        
Leave a comment