নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
আজকাল হাতের মোবাইল ফোনে আঙুল চালালেই একের পর এক শর্ট ভিডিও আমাদের সামনে হাজির—কখনো ১৫ সেকেন্ড, কখনো ৩০, কখনোবা এক মিনিট। কুকুরের কাণ্ড, রান্নার রেসিপি, নাচের স্টেপ বা হাসির খোরাক—একেকটা ভিডিও শেষ হতে না হতেই নতুন একটা ঢুকে পড়ে। কিন্তু আপনি জানেন কি, এই নিরবিচারে স্ক্রল করা কেবল আপনার সময় নষ্টই করছে না, এটি আপনার মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালীও ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছে?
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে (Chang Liu et al., NeuroImage, মে ২০২৫) দেখা গেছে, স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিও–নির্ভরতা বা অ্যাডিকশন মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে।
📊 গবেষণার মূল বিষয়: ভিডিও আসক্তি ও মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালী
গবেষণাটি চীনের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের ওপর চালানো হয়, যারা শর্ট ভিডিওর প্রতি আসক্তির লক্ষণ দেখাচ্ছিল। অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্ক স্ক্যান এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্তমূলক পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা খুঁজে পান—
- শর্ট ভিডিও আসক্তদের আর্থিক ক্ষতির ভয় কম,
- তারা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত বেশি নেয়,
- সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময় কম নেয় এবং চিন্তা-ভাবনা কম করে।
এই ব্যবহারগত বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি, ব্রেইন ইমেজিং (MRI)-এর মাধ্যমে দেখা যায়:
- Prefrontal cortex, যা আত্মনিয়ন্ত্রণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত, সেখানে কম সক্রিয়তা দেখা গেছে।
- Sensory-motor অঞ্চলে ছিল অতিরিক্ত সক্রিয়তা, বিশেষ করে যখন কোনো সম্ভাব্য ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল।
এটি অনেকটা জুয়া খেলার আসক্তি বা গেমিং অ্যাডিকশনের মতোই—তখনকার মস্তিষ্কও ভবিষ্যতের ঝুঁকির চেয়ে তাৎক্ষণিক পুরস্কারের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়।
⏱️ স্বল্পমেয়াদি আনন্দ বনাম দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি
একেকটা শর্ট ভিডিওর দৈর্ঘ্য হয়তো মাত্র ২০–৩০ সেকেন্ড। কিন্তু এই স্বল্প মেয়াদি আনন্দে মগ্ন হয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় হারিয়ে ফেলি। শুধু সময় নয়, এতে:
- ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে,
- মেন্টাল ফ্যাটিগ বা মানসিক ক্লান্তি বাড়ে,
- মনোযোগে ঘাটতি দেখা দেয়,
- এবং স্মৃতিশক্তিও দুর্বল হতে থাকে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, যারা শর্ট ভিডিওতে আসক্ত, তারা বাস্তব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তেও হঠকারী আচরণ করে, যেমন: impulsive কেনাকাটা, অপ্রস্তুত চাকরির সিদ্ধান্ত, সম্পর্কের বিষয়ে অবিবেচক পদক্ষেপ ইত্যাদি।
🧠 “রিওয়ার্ড লুপ” ও মস্তিষ্কের নিউরাল সার্কিট
বিজ্ঞানীরা বলছেন, শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলো একটি “fast-reward loop” তৈরি করে। অর্থাৎ, আপনি কিছু একটা দেখলেন, মজা পেলেন, ব্রেইনে ডোপামিন নিঃসরণ হলো—এই ডোপামিন হল আনন্দ বা পুরস্কার সংক্রান্ত নিউরোট্রান্সমিটার। এরপর মস্তিষ্ক আবার সেই আনন্দ চায়, তাই আপনি আবার স্ক্রল করেন, আবার একটা নতুন ভিডিও…
এই চক্র এমনভাবে গেঁথে যায় যে, মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক আনন্দের উৎস থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বাস্তব জীবনে যেসব কাজে সময়, শ্রম ও ধৈর্য লাগে (যেমন বই পড়া, গবেষণা, সৃজনশীল কাজ)—তা আর আগের মতো তৃপ্তি দেয় না।
🧬 ছোট ভিডিও, বড় প্রভাব: তরুণ সমাজ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণরা এখন সবচেয়ে বেশি শর্ট ভিডিও ব্যবহার করে। এ বয়সেই মানুষের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স গঠনের শেষ ধাপ চলছে—এটিই ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা, নৈতিক বিচার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র।
এই সময় যদি মস্তিষ্ক “বাতাসে উড়তে থাকা বিনোদনে” অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব অংশগ্রহণকারী শর্ট ভিডিওতে সবচেয়ে বেশি আসক্ত ছিল, তাদের ব্রেইন রেসপন্স প্যাটার্ন প্রায় অভিন্ন, যা আরও ইঙ্গিত দেয়—এই আসক্তি নিছক ব্যক্তিগত নয়, এটি নিউরোবায়োলজিক্যাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে।
📱 টিকটক, রিলস, শর্টস—কে দায়ী?
এখানে প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং এর ব্যবহারের ধরন–এর বিরুদ্ধে সতর্কতা জানানো জরুরি।
- সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এখন AI ভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে যা আপনাকে আরও সেইসব ভিডিও দেখায় যেগুলোর প্রতি আপনি দুর্বল। এটি একধরনের পার্সোনালাইজড আসক্তির চক্র তৈরি করে।
- ভিডিওগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে ব্যবহারকারী একটার পর একটা দেখতেই থাকে—একে বলে “infinite scroll design”।
- আপনি থামতে চান, কিন্তু পারছেন না—এটিই হল আসক্তির মূল চিহ্ন।
🧭 কীভাবে বোঝা যাবে আপনি শর্ট ভিডিওতে আসক্ত?
আপনি যদি নিয়মিত নিচের লক্ষণগুলো অনুভব করেন, তাহলে সতর্ক হোন:
- সময় বাঁচানোর কথা ভেবে ভিডিও দেখা শুরু করেও ১ ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে,
- ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভিডিও দেখতে গিয়ে দেরি হচ্ছে,
- ভিডিও না দেখলে অস্বস্তি লাগে বা বিরক্তি হয়,
- কাজের ফাঁকে বারবার মোবাইল হাতে নিচ্ছেন শুধু স্ক্রল করার জন্য,
- ভিডিও দেখার পরেও মাথা ভার মনে হচ্ছে, কিন্তু থামতে পারছেন না।
🧩 সমাধান কোথায়? নিজের হাতে ব্রেক টানুন
প্রযুক্তি আমাদের শত্রু নয়, তবে এর উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সেটাই শত্রুতে পরিণত হতে পারে। নিচে কিছু করণীয় তুলে ধরা হলো:
- ডিজিটাল ডায়েট শুরু করুন: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ভিডিও দেখুন, বাকি সময় ভিডিও অ্যাপ ব্লক করে রাখুন।
- সারপ্রাইজ বিরতি: ৩০ মিনিট অন্তর অন্তর স্ক্রল বন্ধ করে ৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন।
- নিয়ন্ত্রণ অ্যাপ ব্যবহার করুন: যেমন Digital Wellbeing (Android), Screen Time (iOS)।
- আসল আনন্দের খোঁজ করুন: বই পড়া, প্রকৃতির মাঝে হাঁটা, বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা, নতুন কিছু শেখা—এসবেই রয়েছে স্থায়ী আনন্দ।
- রাত্রিকালীন স্ক্রল বন্ধ করুন: ঘুমের আগে ১ ঘণ্টা ভিডিও দেখা বন্ধ রাখুন, এতে ঘুমের মান বাড়বে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে।
📢 সামাজিক সচেতনতাও দরকার
বিশ্ববিদ্যালয় ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ডিজিটাল হাইজিন নিয়ে ক্লাস চালু করা উচিত—যেখানে ছাত্রছাত্রীরা জানতে পারবে স্ক্রিন টাইম, মস্তিষ্কের প্রভাব, আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে।
সরকারি উদ্যোগে শর্ট ভিডিও অ্যাপগুলোর জন্য নির্দিষ্ট “Usage Time Alert” বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
🔚 শেষ কথা
স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিওর জগৎ যেন এক মায়াবী গোলকধাঁধা—চাইলেও বের হওয়া যায় না। কিন্তু গবেষণা বলছে, আপনি যদি সচেতন না হন, তাহলে শুধু সময়ই নয়, আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, এবং মস্তিষ্কের সুস্থতাও এতে ঝুঁকির মুখে পড়বে।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে, আমাদের তরুণদের চিন্তা করতে হবে, শুধু দেখতে নয়। নিজের মস্তিষ্ককে নিজেই রক্ষা করুন—একটু থামুন, ভাবুন, তারপর স্ক্রল করুন।
Leave a comment