সম্পাদকীয়

গবেষকদের জন্য নতুন ধরনের সফটস্কিল: অন্তর্দৃষ্টি

Share
Share

ড. মশিউর রহমান

আমরা যারা গবেষণার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত—হোক তা ল্যাবরেটরি, কম্পিউটেশনাল মডেলিং, বায়োইনফরমেটিক্স, বা ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার সমাধান—আমরা প্রায়ই আমাদের হার্ডস্কিলগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকি। নতুন অ্যালগরিদম শেখা, উন্নততর পরিসংখ্যান বোঝা, ল্যাবটেকনিক আয়ত্ত করা বা পরিশীলিত প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট শিখে নেওয়া আমাদের দৈনন্দিন কাজের বড় অংশ জুড়ে থাকে। অথচ গবেষণার এই কঠোর নিয়মতান্ত্রিক জগতে এক ধরনের মানবিক সক্ষমতা আছে, যেটি আমরা প্রায়ই অবহেলা করি। সক্ষমতাটির নাম—অন্তর্দৃষ্টি

বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের জন্য এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সীমিত সম্পদ ও সীমিত জনবল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই জটিল সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হয়। সেখানে অন্তর্দৃষ্টি—যা যুক্তি, হিসাব, কিংবা কোনো স্পষ্ট বিশ্লেষণ ছাড়াই মনের গভীর স্তরে জন্ম নেয়—গবেষণার গতি ও মান, দুটিকেই বদলে দিতে পারে। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নয়। এটি দীর্ঘ অভিজ্ঞতার অনুশীলনে গড়ে ওঠা এক ধরনের নীরব বুদ্ধি, যা আমরা নিজেরাও টের পাই না কখন আমাদের ভেতরে পরিপক্ব হয়ে উঠেছে।

মানবমস্তিষ্কের চিন্তাপ্রক্রিয়া বিজ্ঞানীরা দুই স্তরে ভাগ করে দেখেন। প্রথম স্তর হচ্ছে সচেতন চিন্তা, যা যুক্তি, পরিমাপ, যাচাই ও বিশ্লেষণের জগতে কাজ করে—ধীর, মনোযোগী এবং পদ্ধতিগত। আর দ্বিতীয় স্তর, অচেতন চিন্তা, বহু অভিজ্ঞতার স্তর পেরিয়ে তৈরি হওয়া দ্রুত, স্বতঃস্ফূর্ত, গভীর এক প্রজ্ঞা। অনেক বড় আবিষ্কার, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত—যেমন আইনস্টাইনের চিন্তা-পরীক্ষা বা ওটো লোয়ির নিউরোট্রান্সমিটার আবিষ্কার—অচেতন মনেই প্রথম জন্মেছিল।

জার্মান মনোবিজ্ঞানী গার্ড গিগারেঞ্জার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Gut Feelings–এ দেখিয়েছেন, বহু ক্ষেত্রে কম তথ্যেও মানুষ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সঠিক দিকে এগোতে পারে। কারণ বছরের পর বছর ধরে অভিজ্ঞতার ভেতর যে ডেটা স্তরে স্তরে জমা থাকে, সেগুলো একসময় প্যাটার্ন হিসেবে মনের গভীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গবেষকের অন্তর্দৃষ্টি আসলে সেই প্যাটার্নেরই অভ্যন্তরীণ ভাষা।

গবেষণার বাস্তব কাজে অন্তর্দৃষ্টি কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তা আমরা প্রতিদিনই দেখি। একটি জটিল বায়োইনফরমেটিক্স পাইপলাইনে ভুলটি কোথায়, একজন অভিজ্ঞ গবেষক অনেক সময় কয়েক সেকেন্ডেই খুঁজে ফেলেন—যেখানে নতুন কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পদ্ধতি বিশ্লেষণ করেও আটকে থাকে। ল্যাবে কোনো পরীক্ষার ফল অদ্ভুত মনে হলে অভিজ্ঞ গবেষকের অন্তর্দৃষ্টি বলে দেয় কোথাও রিএজেন্ট পুরনো হতে পারে বা তাপমাত্রা প্রয়োজনমতো ছিল না। আবার কোনো গবেষণাপত্র পড়তে পড়তে কেন যেন একটি ফলাফল অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়—এই অনুভূতিও অন্তর্দৃষ্টিরই ফল।

আমার নিজের অভিজ্ঞতায়ও এমন মুহূর্ত এসেছে। একটি সফটওয়্যারভিত্তিক গবেষণামডেলের ত্রুটি অগণিত কোড পর্যালোচনার পরও মিলছিল না। টিম যখন বিভ্রান্ত, তখন হঠাৎ করেই কোডের একটি লাইন অদ্ভুত বলে মনে হলো—যার কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা তখনই দিতে পারিনি। কিন্তু পরবর্তীকালের পরীক্ষায় দেখা গেল, সেখানেই লুকিয়ে ছিল মূল সমস্যা। কেন ঠিক সেই লাইনটি চোখে পড়ল, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয়তো নেই; কিন্তু অভিজ্ঞতা যে মনের গভীরে এক অদৃশ্য সংকেত তৈরি করেছিল, তা আমরা আজও অস্বীকার করতে পারি না।

অন্তর্দৃষ্টি জন্মগত নয়; এটি গড়ে ওঠে বছরের পর বছর ধরে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষানিরীক্ষা, ভুল এবং শেখার ভেতর দিয়ে। গবেষক যত বেশি পরীক্ষা করবেন, যত বেশি ডেটা বিশ্লেষণ করবেন, যত বেশি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেবেন—ততই তাঁর ভেতরের প্যাটার্ন রিকগনিশন ক্ষমতা শক্তিশালী হবে। গবেষণার নোটবুক, প্রকাশনা, রিভিউয়ার মন্তব্য কিংবা ব্যর্থ পরীক্ষার ডায়েরি—এসবের ভেতরই জন্ম নেয় ভবিষ্যতের অন্তর্দৃষ্টি।

এমনকি নির্জনে বসে চিন্তা করা, ধ্যান করা, প্রকৃতির শব্দ শোনা—এসবও মনকে পরিষ্কার করে, অচেতন প্রজ্ঞাকে সক্রিয় করে। গবেষকের কৌতূহল, মানুষের কথা শোনার ক্ষমতা, অপ্রচলিত ধারণা বোঝার ইচ্ছা—সবই অন্তর্দৃষ্টির খাদ্য। বরং বলা যায়, অন্তর্দৃষ্টি হচ্ছে সেই মানসিক মাইক্রোস্কোপ, যা অদেখা সংকেতগুলোকে বড় করে দেখার ক্ষমতা দেয়।

তবে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি: আকস্মিক সিদ্ধান্ত বা খামখেয়ালি আচরণ অন্তর্দৃষ্টি নয়। কোনো প্রমাণ ছাড়াই শুধু অনুভূতির ওপর দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক আত্মবিশ্বাস মাত্র। আসল অন্তর্দৃষ্টি সমৃদ্ধ হয় অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণ, ব্যর্থতা, পরিশ্রম ও মননশীলতার ধারাবাহিক চর্চায়।

বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের জন্য এই মানবিক দক্ষতা বিশেষভাবে মূল্যবান। কারণ আমাদের গবেষণা-বাস্তবতার বড় অংশ জুড়ে আছে সীমাবদ্ধতা, চাপ, অপ্রাপ্তির ভেতরেও নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার প্রয়োজন। অন্তর্দৃষ্টি সেই অনুসন্ধানকে দ্রুত, পরিশীলিত এবং কার্যকর করে তোলে। অনেক সময় এটি আমাদের এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়, যা কেবল যুক্তিক্রম অনুসরণ করে পাওয়া সম্ভব নয়।

গার্ড গিগারেঞ্জারের গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের মস্তিষ্ক কেবল তথ্য বিশ্লেষণের যন্ত্র নয়; এটি একটি অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা-যন্ত্রও বটে। তাই গবেষকের দক্ষতা শুধুই হার্ডস্কিলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না—তার ভেতরে থাকে বহু বছরের নীরব অনুশীলনে গড়ে ওঠা গভীর প্রজ্ঞা, যা নাম না জানা সত্ত্বেও গবেষণাকে বেগবান করে তোলে।

শেষ পর্যন্ত, অন্তর্দৃষ্টি হচ্ছে গবেষকের নীরব সঙ্গী। এটি জন্মায় না তাড়াহুড়োতে, আসে ধীরে ধীরে—দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এবং অদম্য কৌতূহলের মধ্য দিয়ে। আর একবার বিকশিত হলে এটি গবেষকের কাজকে শুধু সহজই করে না, করে আরও সৃজনশীল, আরও মানবিক, এবং অনেক সময়—আরও বৈপ্লবিক।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org