আমরা প্রায়ই শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে বলি—বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। কিন্তু আসলে এই ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ শব্দটির মানে কী? অনেকে ভাবে, বিজ্ঞানমনস্ক মানেই গবেষক বা বিজ্ঞানী হয়ে যাওয়া। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে একেবারেই তা নয়। বিজ্ঞানমনস্কতা হলো এমন এক মানসিকতা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এবং যা সবার জন্যই প্রয়োজনীয়।
ধরা যাক, একদিন হঠাৎ বৃষ্টি হলো। রাস্তায় হাঁটার সময় দেখলেন, কোথাও পানি জমে আছে, কোথাও আবার একেবারেই নেই। বিজ্ঞানমনস্ক মন তখন প্রশ্ন করে—কেন এমন হলো? রাস্তার ঢাল বা নকশা কি এর জন্য দায়ী? এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় অনুসন্ধান। এটাই হলো বিজ্ঞানমনস্কতার মূল চাবিকাঠি—যেকোনো ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা।
আলবার্ট আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন: “প্রশ্ন করা বন্ধ করা উচিত নয়। কৌতূহলেরই আছে অস্তিত্বের আসল কারণ।”
মানুষের এই প্রশ্ন করার স্বভাবই বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছে। প্রাচীন গ্রিসে এরিস্টটল বা আর্কিমিডিস যখন প্রকৃতির নিয়মগুলো বোঝার চেষ্টা করেছিলেন, তখনো তাঁরা মূলত বিজ্ঞানমনস্কতারই পরিচয় দিচ্ছিলেন। বাংলার বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু গাছপালার সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন কেবল এই কারণে যে, তাঁর মনে প্রশ্ন এসেছিল—গাছ কি নিঃসাড় প্রাণী, নাকি তারাও আমাদের মতো প্রতিক্রিয়া জানায়? তিনি নিজেই বলেছিলেন: “সত্যিকারের পরীক্ষাগার হলো মানুষের মন, যেখানে মায়ার আড়াল ভেদ করে আমরা সত্যের নিয়ম আবিষ্কার করি।”
চলু দেখা যাক দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানমনস্কতা কিভাবে কাজে লাগে। আমাদের জীবনের অসংখ্য ছোট ছোট সিদ্ধান্তে বিজ্ঞানমনস্কতা কাজে লাগে। পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার বদলে যদি বোঝার চেষ্টা করি, তবে তা দীর্ঘদিন মনে থাকে। অন্ধবিশ্বাসের বদলে যুক্তি দিয়ে বিচার করলে ভুল সিদ্ধান্ত থেকে বাঁচা যায়। এমনকি রান্নাঘরেও—ভাত ঝরঝরে হবে নাকি খিচুড়ির মতো হবে—তা নির্ভর করে পানির পরিমাণের বিজ্ঞানভিত্তিক হিসাবের ওপর।
চলুন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান মনষ্কতার কিছু বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক। প্রথমত, ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা কিভাবে কাজে লাগানো যায়? বাংলাদেশে প্রতিবছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। অনেকে কেবল ওষুধ ছিটিয়ে সমস্যা মিটবে মনে করেন। কিন্তু একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ জানে—ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে, আর এডিস মশা জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডিম দেয়। তাই অকারণে ওষুধ ছিটানো নয়, বরং বাড়ির চারপাশে পানির পাত্র, ফুলের টব বা টায়ারে যেন পানি জমে না থাকে—এটাই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
দ্বিতীয়ত, কৃষিতে বৈজ্ঞানিক কৌশল। বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষকরা আগে শুধু অভ্যাসের উপর নির্ভর করে জমিতে পানি দিতেন। এখন অনেকেই সেচে সোলার পাম্প, আধুনিক সেচপদ্ধতি ও মাটির আর্দ্রতা সেন্সর ব্যবহার করছেন। এর ফলে পানির অপচয় কমে যাচ্ছে এবং উৎপাদনও বেড়ে যাচ্ছে। এটাই বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার ফল—অভ্যাসের বদলে তথ্য ও যুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া।
তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য সচেতনতা। অনেকে এখনো বিশ্বাস করেন, “ঠান্ডা পানি খেলেই সর্দি হবে।” কিন্তু বিজ্ঞান বলে—সর্দি হয় ভাইরাসের কারণে, ঠান্ডা পানির জন্য নয়। একজন বিজ্ঞানমনস্ক কিশোর জানে, হাঁচি-কাশির সময় মুখ-নাক ঢেকে রাখা এবং হাত ধোয়া সর্দি-জ্বর প্রতিরোধে বেশি কার্যকর।
এবার চলুন বিজ্ঞানমনষ্কতা নিয়ে কিছু মজার তথ্য দিই। বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান একবার বলেছিলেন, “প্রশ্ন করতে ভয় পেও না।” তাঁর মতে, জটিল বিজ্ঞানও শুরু হয় ছোট্ট প্রশ্ন থেকে। পৃথিবীর প্রায় সব বড় আবিষ্কার—বিদ্যুৎ, রেডিও, টেলিফোন বা কম্পিউটার—এসেছিল এই প্রশ্ন করার মনোভাব থেকে।
জাতিসংঘের এক জরিপে দেখা গেছে, বিজ্ঞানমনস্ক মনোভাবসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা সাধারণত সমস্যা সমাধানে অন্যদের চেয়ে ৪০% বেশি দক্ষ। বাংলাদেশে যেখানে তরুণ জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটিরও বেশি, সেখানে যদি তাদের একটি বড় অংশ বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠে, তবে দেশের উন্নয়নের গতি বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে।
পরিশেষে বলবো, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া মানে কেবল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষানিরীক্ষা করা নয়। বরং এটি হলো একটি অভ্যাস, যা আমাদের যুক্তিবাদী হতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায় এবং সমস্যার সমাধান খুঁজতে সাহায্য করে। উচ্চমাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে একজন সাধারণ গৃহিণী—সবাই বিজ্ঞানমনস্ক হলে সমাজ এগিয়ে যাবে যুক্তি ও প্রগতির পথে। কার্ল সেগান একবার বলেছিলেন: “বিজ্ঞান আসলে এক ধরনের চিন্তার পদ্ধতি, কেবল জ্ঞানের ভাণ্ডার নয়।” বিজ্ঞানমনস্কতা হলো আমাদের সবার জন্যই অপরিহার্য—এটাই আমাদের ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা।

Leave a comment