নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ | [email protected]
জগতের সবচেয়ে ছোট কণার গঠন দেখতে চাইলে আমাদের প্রয়োজন হয় এমন এক যন্ত্রের, যার দৃষ্টি সীমা পারমাণবিক স্তর পর্যন্ত প্রসারিত। সেই দৃষ্টির নাম Scanning Tunneling Microscope (STM) — একটি বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্র যা মানবজাতিকে প্রথমবারের মতো সরাসরি পরমাণুর অবয়ব দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও ন্যানোপ্রযুক্তির ভিত্তি নির্মাণে STM-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
যন্ত্রের জন্ম ও যুগান্তকারী আবিষ্কার
১৯৮১ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান IBM Zürich Research Laboratory-তে কাজ করছিলেন দুই বিজ্ঞানী: গার্ড বিনিগ (Gerd Binnig) এবং হেইনরিখ রোরার (Heinrich Rohrer)। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল — এমন একটি যন্ত্র তৈরি করা যা ধাতব বা অর্ধপরিবাহী পৃষ্ঠের ইলেকট্রন ঘনত্ব পারমাণবিক স্তরে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে। তাদের উদ্ভাবিত যন্ত্র STM বৈজ্ঞানিক বিশ্বের কাছে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল। ১৯৮৬ সালে, এই অসামান্য আবিষ্কারের জন্য তাঁরা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন পদার্থবিজ্ঞানে।
প্রযুক্তির মূলনীতি: টানেলিং ইফেক্ট
STM-এর প্রযুক্তির ভিত্তি কোয়ান্টাম টানেলিং — একটি কোয়ান্টাম-যান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেখানে ইলেকট্রন একটি প্রতিবন্ধকতা পার হতে পারে এমনকি তার শক্তি না থাকলেও। STM যন্ত্রে একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ধাতব সূঁচ (tip) একটি কন্ডাক্টিভ পৃষ্ঠের উপর কয়েক অ্যাংস্ট্রম দূরত্বে রাখা হয়। যখন এই সূঁচ ও নমুনার মাঝে ক্ষুদ্র একটি ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয়, তখন ইলেকট্রন টানেলিং-এর মাধ্যমে একপাশ থেকে অন্যপাশে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহিত টানেলিং কারেন্ট নির্ভর করে পৃষ্ঠের ইলেকট্রন ঘনত্বের উপর। তাই সূঁচটি যখন পৃষ্ঠের উপর স্ক্যান করে, তখন আমরা প্রতিটি পরমাণুর অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চিত্র পেতে পারি।
STM দিয়ে কী কী গবেষণা সম্ভব?
STM একটি অত্যন্ত শক্তিশালী উপকরণ যা গবেষকরা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উপকরণবিজ্ঞানে ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে আপনি—
- সেমিকন্ডাক্টরের পৃষ্ঠে পরমাণুর বিন্যাস দেখতে পারেন
- একক পরমাণু বা অণুকে স্থানান্তর বা পুনর্বিন্যাস করতে পারেন
- বিভিন্ন পদার্থে ইলেকট্রনিক ঘনত্ব ও ব্যান্ড স্ট্রাকচার পর্যালোচনা করতে পারেন
- ধাতব পৃষ্ঠে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাইক্রো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন
- ন্যানোটেকনোলজিতে একক পরমাণু দিয়ে কাঠামো তৈরি করতে পারেন
বিশ্বজুড়ে গবেষণা ল্যাবে STM ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যানোস্কেল ইঞ্জিনিয়ারিং, গবেষণামূলক সেমিকন্ডাক্টর, জৈব অনুর কনফিগারেশন, এবং ক্যাটালাইসিস রিসার্চ-এ।
ব্যবহার সহজ, কিন্তু সূক্ষ্মতার চূড়ান্ত
STM একটি জটিল প্রযুক্তির যন্ত্র হলেও অভিজ্ঞ ব্যবহারকারীর জন্য এর ব্যবহার অনেকটাই সহজ হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু এটি পিকোমিটার স্তরে তথ্য সংগ্রহ করে, তাই এর সংবেদনশীলতা খুব বেশি। ল্যাবরেটরি অবশ্যই ভাইব্রেশন-ফ্রি পরিবেশ, টেম্পারেচার কন্ট্রোল, এবং হাই-ভ্যাকুয়াম বা ইনার্ট গ্যাস পরিবেশে পরিচালিত হতে হয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখন খরচ সাশ্রয়ী STM সেটআপ তৈরি করছে যাতে উন্নয়নশীল দেশের গবেষকরা প্রশিক্ষণের সুযোগ পান।
STM-এর হাত ধরে যে বিপ্লব
STM-এর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো সরাসরি পরমাণুর ছবি তুলতে সক্ষম হন। ১৯৮৩ সালে IBM-র গবেষকরা সিলিকন পৃষ্ঠে একটি একক জার্মেনিয়াম পরমাণু শনাক্ত করেন। পরবর্তীতে STM-এর মাধ্যমে গবেষকরা ন্যানোস্কেল ডিভাইস নির্মাণ শুরু করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯০ সালে IBM-এর বিজ্ঞানীরা STM দিয়ে “IBM” শব্দটি জেনোন পরমাণু দিয়ে লিখেছিলেন — প্রতিটি অক্ষর তৈরি হয়েছিল মাত্র কয়েকটি পরমাণু দিয়ে। এই ঘটনা পুরো বিশ্বের সামনে ন্যানোটেকনোলজির সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে STM-এর সম্ভাবনা
STM এখনো বাংলাদেশে সব ল্যাবে সহজলভ্য নয়। তবে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, অনলাইন প্রশিক্ষণ এবং ওপেন-সোর্স সিমুলেটর বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, “Gwyddion” একটি ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার যা STM ও AFM ডেটা বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কিছু আন্তর্জাতিক প্রকল্প যেমন IAEA বা JICA-এর সহযোগিতায় অনেক সময় STM ট্রেনিং ও হস্তান্তরের সুযোগ তৈরি হয়।
যদি বাংলাদেশের গবেষকরা STM-এর ব্যবহার, ধারণা ও বিশ্লেষণ শিখে ফেলেন, তবে বিদেশি ল্যাবে গবেষণার সময় তাঁরা অনেক বেশি প্রস্তুত ও আত্মবিশ্বাসী হবেন। অনেক সময় আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় গবেষণার শর্ত থাকে যে গবেষককে যন্ত্র সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকতে হবে।
উপসংহার: জ্ঞানের সূক্ষ্ম পথের দরজা খুলে দেয় STM
Scanning Tunneling Microscope কোনো সাধারণ যন্ত্র নয়। এটি আমাদের পরমাণুর জগতে প্রবেশের প্রবেশদ্বার — যেখানে বিজ্ঞানী নিজেই আণুবীক্ষণিক স্থপতির ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের গবেষকদের জন্য STM শুধু একটি প্রযুক্তি নয়, এটি ভবিষ্যতের সম্ভাবনার চাবিকাঠি। যদি আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের এই যন্ত্রের ইতিহাস, বিজ্ঞান, ব্যবহার ও বিশ্লেষণ শেখাতে পারি, তবে তারা আন্তর্জাতিক গবেষণার পরিসরে আরও জোরালোভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।
আরও জানুন
- IBM STM Demo Video: https://www.ibm.com
- Gwyddion Software: http://gwyddion.net
- Nobel Prize Lecture (Binnig & Rohrer): https://www.nobelprize.org/prizes/physics/1986
Leave a comment