নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
২০০৮ সালে ইকুয়েডর একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটায়। নতুন সংবিধানের ৭১ থেকে ৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদে দেশটি প্রথমবারের মতো ঘোষণা করে যে প্রকৃতিরও নিজস্ব অধিকার রয়েছে। এই অধিকার প্রকৃতির অস্তিত্ব, মানুষের জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সেবা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি। যখন প্রকৃতির অধিকার লঙ্ঘিত হয়, রাষ্ট্র বাধ্য থাকে তা রক্ষা এবং পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নিতে। এই যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ইকুয়েডর বিশ্বকে নতুন ভাবনার দিকে ধাবিত করেছে: একটি নদীর কি নিজস্ব প্রাণ থাকতে পারে?
বিশিষ্ট প্রকৃতি লেখক রবার্ট ম্যাকফারলেন তার সাম্প্রতিক বই “Is a River Alive?”-এ এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন। ম্যাকফারলেনের যাত্রা তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশের নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে: ইকুয়েডরের গভীর বনাঞ্চলের নদী, ভারতের ঐতিহাসিক গঙ্গা এবং কানাডার পূর্বাঞ্চলের দূরবর্তী নদীগুলো। বইটিতে তিনি নদীর নিজস্ব সার্বভৌমত্ব এবং প্রাণবন্ত উপস্থিতি নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও আলোচনা করেছেন।
নদী কেবল জলের প্রবাহ নয়, এটি একটি জীবন্ত ব্যবস্থা। নদীর সঙ্গে যুক্ত থাকে অসংখ্য উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবের একটি আন্তঃসংযুক্ত ও প্রায়শই ভঙ্গুর জগত। এই জীববৈচিত্র্য মানুষের জীবনকে পুষ্ট করে, জীবিকাকে সমর্থন করে এবং পরিবেশকে সুস্থ রাখে। হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে শ্রদ্ধা ও উপাসনা করে এসেছে। তাদের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নদী শুধুমাত্র ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণকারী নয়, বরং প্রকৃতির আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক সত্তার প্রতিনিধিও বটে।
তবে আধুনিক যুগে এসে নদীগুলো চরম সংকটের মুখে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, শিল্প ও কর্পোরেট দূষণ, এবং সরকারি উদাসীনতা নদীর অস্তিত্ব ও কার্যক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ম্যাকফারলেন তার বইয়ে এসব সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে দেখান, নদীগুলো কীভাবে প্রাণ হারাচ্ছে এবং তার ফলাফল কী ভয়াবহ হতে পারে। তিনি বলেন, “নদী একইসাথে শক্তিশালী, দৃঢ়সংকল্প, পবিত্র এবং অবহেলিত। দীর্ঘকাল ধরে নদীগুলো ভূতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের মাঝামাঝি অবস্থান করে আসছে।”
ভারতের গঙ্গার উদাহরণ তিনি বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন। হাজার বছর ধরে গঙ্গা শুধু ভারতের ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দুই নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরও প্রাণকেন্দ্র। গঙ্গার জলকে পবিত্র বলে মনে করা হলেও, আজকের দিনে শিল্পকারখানা ও আবর্জনার কারণে তা দূষিত হয়ে পড়েছে। এই দূষণ এতটাই গুরুতর যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে গঙ্গা এখন বিশ্বের অন্যতম দূষিত নদী। এই পরিস্থিতি গঙ্গাকে পুনরুজ্জীবিত করতে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ও সরকারি পদক্ষেপের গুরুত্ব স্পষ্ট করে তোলে।
অন্যদিকে, কানাডার পূর্বাঞ্চলের নদীগুলো, যেমন সেন্ট লরেন্স, প্রকৃতি ও মানুষের সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে সেখানকার নদীগুলোও রক্ষা পায়নি। বিশেষ করে উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলছে, যা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। নদীগুলোর পানি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে বিজ্ঞানসম্মত এবং আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার গুরুত্ব তাই বেড়েই চলেছে।
ইকুয়েডরের আমাজনের গভীর অরণ্যের নদীগুলো আরও গভীর সংকটে পড়েছে। সেখানে খনিজ আহরণ, কাঠ চোরাচালান এবং তেল অনুসন্ধান কার্যক্রম নদীর প্রাকৃতিক সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই পরিবেশগত ক্ষতির প্রেক্ষাপটে ইকুয়েডর সরকার প্রকৃতির অধিকারকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে।
রবার্ট ম্যাকফারলেনের বইটি আমাদের ভাবায় যে, নদীগুলো আমাদের সঙ্গী, আমাদের সহযাত্রী। তিনি মনে করেন, “আমরা কখনো নদীর মতো ভাবতে পারব না, কিন্তু নদীর সঙ্গে একত্রে ভাবতে পারি।” এই চিন্তাধারা আমাদের নদীর প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। নদীকে শুধু জড় পদার্থ হিসেবে দেখলে চলবে না, দেখতে হবে জীবন ও পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই বার্তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশ নদীমাতৃক, যেখানে কয়েকশ নদী পরিবেশ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু নদীগুলো আজ দখল, দূষণ ও অবহেলার শিকার। বাংলাদেশের জন্য নদীর জীবনকে সম্মান করা এবং এর বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করার উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করতে হবে।
শেষ কথায়, নদীর জীবন নিয়ে প্রশ্ন আমাদের প্রত্যেককে স্পর্শ করে। নদী যদি সত্যিই জীবন্ত হয়, তবে তার অধিকারকে মর্যাদা দেওয়া এবং সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ম্যাকফারলেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু নদীর জন্য নয়, আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্যও একটি জরুরি আহ্বান।
Leave a comment